হেপাটাইটিস: যেই ধাপের রোগীদের চিকিৎসা কঠিন

১৯৬৪ সালে প্রথম হেপাটাইটিস বি আবিষ্কার করেন স্যার স্যামুয়েল ব্লুমবার্গ। চিকিৎসাবিদ্যায় এই অবদানকে স্বীকৃতি জানাতে তাঁর জন্মদিনে (২৮ জুলাই) বিশ্বজুড়ে হেপাটাইটিস দিবস পালিত হয়। এ বছর হেপাটাইটিস দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় হলো, ‘আর অপেক্ষা নয়, হেপাটাইটিস প্রতিরোধের এখনই সময়।’
হেপাটাইটিস বি একটি নিরব ঘাতক। বাংলাদেশের গ্যাস্ট্রোলিভার বিশেষজ্ঞরা সারাদেশে হেপাটাইটিস বি প্রতিরোধে সামাজিক ও গণসচেতনতামূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে আসছে। বাংলাদেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে এ রোগের চিকিৎসাব্যয় ভুক্তভোগী পরিবারের জন্য অনেক বড় বোঝা। হেপাটাইটিসের উপসর্গ নিয়ে আমাদের কাছে আসা রোগীকে শুরুতেই স্ক্রিনিংয়ের মাধ্যমে তিনি আক্রান্ত কি-না, তা জানার চেষ্টা করি। আক্রান্ত হলে যথাযথ চিকিৎসা প্রদান করা হয়, না হলে তৎক্ষণাৎ হেপাটাইটিস বি প্রতিরোধী টিকা নিতে উৎসাহ প্রদান করি। একই সঙ্গে তাদের পরিবার এবং আশপাশের লোকজনসহ হেপাটাইটিস বি প্রতিরোধী টিকা নিতে উৎসাহ প্রদান করি। ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে হেপাটাইটিস বি নির্মূল করার জন্য সরকারের যে প্রত্যয়, তা বাস্তবায়ন করার জন্য আমরা এগিয়ে যাচ্ছি।
লক্ষণ
হেপাটাইটিস হচ্ছে লিভারের প্রদাহজনিত সমস্যা। এখানে দুটি ভাইরাসের সংক্রমণ হয়, ক্রনিক হেপাটাইটিস বি ও হেপাটাইটিস সি। এক গবেষণায় দেখা গেছে, আমাদের দেশে ৬-৭ শতাংশ মানুষ ক্রনিক হেপাটাইটিস বি ভাইরাসে আক্রান্ত হয় এবং এক শতাংশ মানুষ হেপাটাইটিস সিতে আক্রান্ত হয়। এই দুটি ভাইরাসকে নিরব ঘাতক হিসেবে অবহিত করা হয়। কারণ এই দুই ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার পর রোগ চূড়ান্ত পর্যায়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত বোঝার উপায় নেই যে, রোগী এতে আক্রান্ত হয়েছেন। তাই সাধারণভাবে দেখা যায়, ক্রনিক হেপাটাইটিস বি ও ক্রনিক হেপাটাইটিস সি’র তেমন কোনো লক্ষণ নেই।
আমাদের কাছে চিকিৎসা নিতে আসা হেপাটাইটিস বি ও হেপাটাইটিস সিতে আক্রান্ত অধিকাংশ রোগীই অন্য রোগের পরীক্ষা করতে গিয়ে নিজের হেপাটাইটিসে আক্রান্ত হওয়ার কথা জেনেছেন। অনেকেই গর্ভাবস্থায় পরীক্ষা করতে গিয়ে কিংবা চাকরির সময় স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে গিয়ে হেপাটাইটিসে আক্রান্ত হওয়ার কথা জানতে পারেন। কেউ কেউ রক্তদান করতে গিয়ে কিংবা বিদেশ গমনের প্রাক্কালে জানতে পারেন তিনি হেপাটাইটিস আক্রান্ত। বাংলাদেশের অনেক জনবহুল এলাকায় হেপাটাইটিস প্রতিরোধী টিকা দেওয়ার ক্যাম্পেইন করা হয়। ক্যাম্পেইনে স্ক্রিনিং করার সময় অনেকের হেপাটাইটিস ধরা পরে। এভাবেই সাধারণত এ রোগগুলো ধরা পড়ে।
আমাদের কাছে চূড়ান্ত পর্যায়ের কিছু রোগীও আসেন। দেখা গেলো কারও পেটে কিংবা পায়ে পানি চলে এসেছে, রক্তবমি হচ্ছে, কালো পায়খানা হচ্ছে, ঘনঘন অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছেন। এসব রোগীর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা যায়, তারা অনেক আগেই হেপাটাইটিস বি কিংবা সিতে আক্রান্ত হয়েছেন। একবার হেপাটাইটিস বি কিংবা সি ভাইরাসে আক্রান্ত হলে সেটি সিরোসিস হয়ে লক্ষণ-উপসর্গ প্রকাশ পেতে ২০-৩০ বছর সময় লাগে। তবে এ ধরনের রোগীরা আমাদের কাছে কমই আসেন, বেশিরভাগই আসেন হেপাটাইটিসে আক্রান্ত হয়েছেন, এমন রিপোর্ট নিয়ে।
চিকিৎসা
সারাদেশেই উপজেলা ও জেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলোতে হেপাটাইটিসের পরীক্ষা-নিরীক্ষাগুলো করা যায়। বড় বড় শহর ও বিশেষায়িত হাসপাতালগুলোতে হেপাটাইটিস নির্ণয়ের অত্যাধুনিক পরীক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে। সবগুলো পরীক্ষাই সুলভ মূল্যে ও জনসাধারণের ক্রয়-ক্ষমতার মধ্যেই রয়েছে।
পেটে কিংবা পায়ে পানি চলে আসা, রক্তবমি, কালো পায়খানা, ঘনঘন অজ্ঞান হওয়া—এসব হচ্ছে হেপাটাইটিসে আক্রান্তের চূড়ান্ত ধাপ। এ ধরনের রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া একটু কঠিন। শুধু তাই নয় এ পর্যায়ে আসা রোগীদের চিকিৎসা বেশ ব্যয়বহুল, কষ্টসাধ্য এবং আশাপ্রদ নয়। কিন্তু কারও প্রাথমিক পর্যায়ে রোগটি ধরা পড়লে তাদের চিকিৎসা দেওয়া অনেকটাই সহজ এবং আশাপ্রদ।
হেপাটাইটিস একটি দীর্ঘমেয়াদি রোগ এবং এর চিকিৎসাও দীর্ঘমেয়াদি হওয়ায় রোগীর চিকিৎসা শুরুর পূর্বে কাউন্সিলিং অত্যন্ত জরুরি। কেননা কারও কারও অর্থনৈতিক অস্বচ্ছলতার কারণে তারা মাঝপথে চিকিৎসা বন্ধ করে দেন। এজন্য তাদেরকে প্রাথমিকভাবে বিষয়গুলো ব্যাখ্যা করতে হয় এবং আশ্বস্ত করতে হয়। দীর্ঘমেয়াদি এ চিকিৎসায় প্যাকেজ পরীক্ষা করতে হয়। এসব পরীক্ষা করতে ১২-১৫ লাখ টাকা লাগতে পারে।
বড় বড় জেলা শহরগুলোতে সব ধরনের পরীক্ষার সুবিধাগুলো রয়েছে। এসব পরীক্ষা-নিরীক্ষা একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক পর্যালোচনা করে বলতে পারেন, তার চিকিৎসা লাগবে, কি লাগবে না। চিকিৎসার প্রয়োজন হলে ৯-১০ বছর চিকিৎসা নিতে হয়। আর যদি দেখা যায়, ভাইরাস নিষ্ক্রিয় রয়েছে তাহলে রোগীকে ফলোআপে থাকতে বলা হয়। রোগীকে ছয় মাস বা এক বছর পরপর ফলোআপ করতে বলা হয়। যেহেতু এটি একটি ভাইরাসজনিত রোগ তাই এর চিকিৎসা ওষুধ দিয়ে করা বাঞ্চনীয়।
এসএস/এমইউ
