
ডা. রিফাত আল মাজিদ
প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, ক্যান্সার কেয়ার এন্ড রিসার্চ ট্রাস্ট, বাংলাদেশ।
ক্লিনিক্যাল কো-অর্ডিনেটর, র্যামফিট মেডিকেল কনসাল্টেশন সেন্টার, মগবাজার, ঢাকা।
১৬ মে, ২০২৩ ০৭:০৩ পিএম
উচ্চ রক্তচাপ-হার্ট অ্যাটাক: সচেতনতা ও প্রতিরোধ

রক্ত হচ্ছে মানুষের শরীরের প্রতিটি কোষে পুষ্টি সরবরাহকারী উপাদান। এটি শরীরের মধ্যে কিছু চিকন পাইপের মত নালিকা দিয়ে সারা শরীরে প্রবাহিত হয়। এ নালিকাগুলোকে রক্তনালী কিংবা ব্লাড ভেসেল বলা হয়। সবগুলো রক্তনালিকার উৎপত্তিস্থল হচ্ছে হার্ট, হার্ট থেকে রক্তনালি সারা শরীরে প্রবাহিত হয়।
হার্টকে যদি একটি মোটর পাম্পের মত কল্পনা করি, তাহলে রক্তনালী হচ্ছে মোটর পাম্পের মুখে আটকানো ডেলিভারি পাইপের মত। মোটর পাম্পের মুখে আটকানো ডেলিভারি পাইপ দিয়ে যেমন বাগানে পানি দেওয়া হয়, ঠিক তেমনি হার্ট নামক পাম্প দিয়ে সারা শরীরে রক্ত সরবরাহ করা হয়। যেখানে হার্ট পাম্পিং মেশিন হিসাবে কাজ করে, রক্তনালি ডেলিভারি পাইপের মত কাজ করে। একজন মানুষের রক্তনালিসমূহ যদি পাশাপাশি রেখে জোড়া লাগানো হয়, তাহলে একলাখ কিলোমিটার দীর্ঘ হবে। একজন প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষের শরীরে প্রায় ৫ লিটার রক্ত থাকে এবং এই ৫ লিটার রক্ত মাত্র এক মিনিটে হার্ট থেকে রক্তনালি হয়ে সারা শরীর ঘুরে আবার হার্টে আসে।
হার্টবিট
মোটর পাম্প যেমন বিদ্যুৎ দিয়ে চালু করলে কিছু ছোট চাকার ঘুর্ণনের ফলে পানি উঠে আসে, তেমনি হার্ট নামক পাম্পিং যন্ত্রটা প্রতি মিনিটে প্রায় গড়ে ৭৫ বার প্রকম্পিত হয়। ফলে ৭৫ বার হার্ট অটোমেটিকভাবে সামনের দিকে ধাক্কা খায়, আবার পিছনে ফিরে আসে। অর্থাৎ একবার সংকোচিত হয়, আর একবার সম্প্রসারিত হয়, যাকে হার্টবিট বলে। এই ধাক্কার ফলে হার্টের ভিতরের রক্তসমূহ রক্তনালিতে প্রবেশ করে, আবার অন্য রক্তনালি দিয়ে হার্টে ফিরে আসে।
রক্তচাপ
হার্ট থেকে রক্ত রক্তনালিতে চলাচলের সময়, রক্ত রক্তনালীর গায়ে এক ধরনের চাপ তথা প্রেশার প্রয়োগ করে তাকেই রক্তচাপ বা ব্লাড প্রেশার বলা হয়। যেমন-মোটর পাম্প থেকে পানি যখন ডেলিভারি পাইপে আসে, তখন পাইপগুলো হাতে নিলে পানির একটি প্রেশার বা চাপ পাওয়া যায়, ঠিক তেমনি রক্তনালিতে রক্ত একটি প্রেশার প্রয়োগ করে তাকে ব্লাড প্রেশার বা রক্তচাপ বলা হয়।
একটি মোটর পাম্প যদি পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ পেয়ে একই সমান্তরালভাবে চলতে থাকে এবং ডেলিভারি পাইপ যদি পরিষ্কার থাকে, কোথাও কোনো প্রতিবন্ধকতা না থাকে, তাহলে পানির পাম্পিং আর প্রবাহ স্বাভাবিক থাকবে। ঠিক তদ্রুপ হার্ট যদি সুস্থ থাকে, আর রক্তনালিসমূহে যদি কোনো প্রতিবন্ধকতা না থাকে, তাহলে রক্ত চলাচল স্বাভাবিক থাকবে। রক্ত চলাচল করতে বাড়তি প্রেশার লাগবে না।
উচ্চ রক্তচাপ
রক্তনালিগুলো যদি পরিষ্কার না থাকে, সেখানে যদি চর্বি (কোলেস্টেরল) জমা হয় কিংবা হার্টের পাম্পিং ক্ষমতা যদি বেড়ে যায়, তাহলে রক্তনালিতে রক্ত চলাচলের সময় একটি বাড়তি প্রেশার অনুভব করবে। যেমন- মনে করি, হার্টের পাম্পিং ক্ষমতা মিনিটে ৫ লিটার রক্ত, এখন যদি শরীরে রক্ত আর অতিরিক্ত ফ্লুইড জমা হয়, তাহলে বেশি ফ্লুইড একই সময়ে রক্তনালিতে স্বাভাবিকভাবে পরিবাহিত হওয়া কিংবা রক্ত চলাচলের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া বাঁধাগ্রস্ত হবে এবং রক্ত সঠিক পরিবহনের জন্য একটি বাড়তি প্রেশার লাগবে, যাকে হাইপ্রেশার কিংবা উচ্চ রক্তচাপ বলা হয়।
রক্তের এই প্রেশার স্পিগনোম্যানোমিটার (প্রেশার মাপার মেশিন) দিয়ে পরিমাপ করা হয়। হার্ট সংকোচনের (systole) সময় স্বাভাবিক প্রেশার থাকে ১০০-১২০ এমএমএইচজি (mmHg) আর হার্টের সম্প্রসারণের সময় স্বাভাবিক প্রেশার থাকে ৬০-৯০ এমএমএইচজি (mmHg) । এখন কারো ক্ষেত্রে যদি এই প্রেশারে তারতম্য ঘটে, তথা প্রেশার যদি ১৪০/৯০ এর উপরে চলে যায়, তাহলে এটাকে হাইপ্রেশার বলা হয়, যার অপর নাম হচ্ছে হাইপারটেনশন।
উচ্চ রক্তচাপের কারণ
১. বয়স্কদের হাইপ্রেশারের আশঙ্কা বেশি। কারণ বয়স বাড়ার সাথে সাথে রক্তনালিগুলো গাড় কিংবা শক্ত হতে থাকে, তাই সেই নালিকা দিয়ে রক্ত চলাচলের স্বাভাবিক চাপ বেড়ে যায়, যাকে হাই প্রেশার বা উচ্চ রক্তচাপ বলে।
২. মহিলাদের তুলনার পুরুষের রক্তচাপ বেশি থাকে।
৩. জেনেটিক কারণে অনেকের হাইপ্রেশার থাকে, তাদের হার্টের আউটপুট বেশি থাকে এবং হাইপ্রেশার হয়। বয়স, লিঙ্গ, বংশগত ( Age, sex, and Genetic) এই তিনটা কারণের মধ্যে আমাদের কোনো হাত থাকেনা, কিংবা আমরা চাইলেও এইটা পরিবর্তন করতে পারিনা। এ জন্য এই তিন কারণকে Non Modifiable Risk factor for Hypertension বলে।
হাইপারটেনশনের আরও কিছু কারণ আছে, যাকে ইচ্ছা করলে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি, তাকে Modifiable risk factor for Hypertension বলে। নিম্নে একটা তালিকা দেওয়া হলো, এইসব কারণে যদিও হাইপ্রেশার হয়, তবে তা নিয়ন্ত্রণ করা আমাদের পক্ষে সম্ভব।
১. ধুমপান: কারণ সিগারেটের মধ্যে নিকোটিন নামক এক প্রকার ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ থাকে, যা LDL cholesterol নামক এক প্রকার চর্বিকে রক্তনালিতে আটকিয়ে রাখে। এতে করে রক্তনালিসমূহ সরু হয়ে যায়, শক্ত হয়ে যায়, ইলাস্টিসিটি কমে যায় এবং রক্ত সঞ্চালনে বাধাগ্রস্ত হয়। যার কারণে রক্তচাপ বেড়ে যায়।
২. অতিরিক্ত চর্বিজাতীয় খাবার: গরুর মাংস, খাসির মাংস, হাঁস, তৈলাক্ত খাবার ও ডিম ইত্যাদি। এসব খাবারে রক্তে কোলেস্টেরল কিংবা চর্বির পরিমাণ বৃদ্ধি পায়, এবং তা রক্তনালির গায়ে জমা হয়ে রক্তনালী সরু হয় এবং রক্ত সঞ্চালনে বাধাগ্রস্ত হয়।
৩. অ্যালকোহল গ্রহণ।
৫. মানসিক চাপ।
৬. অতিরিক্ত শারীরিক ওজন
৭. বংশগত কারণ
৮. বয়স (৫৫ বছর পুরুষ) (৪০ মহিলা)।
৯. তামাক, জর্দা ও চুন খাওয়া।
১০. খাবারে অতিরিক্ত লবণ।
১১. কিছু হরমোনাল কারণ।
১২. কিডনি রোগ।
১৩. হাইপারথাইরয়েডিজম।
১৪. কুশিং সিন্ড্রোম ।
১৫. অ্যাথারোস্ক্লেরোসিস ডিজঅর্ডার।
উচ্চ রক্তচাপের প্রকারভেদ
উপরে আমরা জেনেছি, যদি রক্তচাপ ১৪০/৯০ এমএমএইচজি (mmHg) এর বেশি হয়, তবে তাকে হাই ব্লাডপ্রেশার হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। হাই প্রেশার বা হাইপারটেনশনকে আবার তিনটি গ্রেডে ভাগ করা হয়।
গ্রেড-১: যদি সিস্টোলিক প্রেশার ১৪০-১৫৯ এমএমএইচজি (mmHg) আর ডায়াস্টোলিক প্রেশার যদি ৯০-৯৯ এমএমএইচজি (mmHg) হয়। যাকে মাইল্ড হাইপারটেনশনও বলা হয়।
গ্রেড-২: যদি সিস্টোলিক প্রেশার ১৬০-১৭৯ এমএমএইচজি (mmHg) আর ডায়াস্টোলিক প্রেশার যদি ১০০-১০৯ এমএমএইচজি (mmHg) হয়। যাকে মডারেট হাইপারটেনশন বলে।
গ্রেড-৩: যদি সিস্টোলিক/ ডায়াস্টোলিক ১৮০/১১০ এর উপরে হয়, তবে তাকে সিভিয়ার হাইপারটেনশন বলে। এটাকে হাইপারটেনসিভ ক্রাইসিসও বলে। ম্যালিগন্যান্ট হাইপারটেনশন বা হাইপারটেনসিভ ইমার্জেন্সি নামেও চিহ্নিত করা হয়। এই প্রকার হাইপারটেনশন খুবই খারাপ। দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আনতে না পারলে হার্ট অ্যাটাক, ব্রেইন স্ট্রোকের ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়।
উপসর্গ
১. মাথা ব্যাথা।
২. ঘাড় ব্যাথা, সাধারণত বাম পাশে বাম বাহু থেকে উপরের দিকে ঘাড়ে ব্যাথা করে।
৩. চোখে ঝাপসা দেখা।
৪. বুকে ব্যাথা, যাকে অ্যানজাইনা বলে।
৫. মাথা ঘোরানো।
৬. নাক দিয়ে রক্ত পড়া।
৭. শ্বাসকষ্ট হওয়া।
৮. বুক ধরফর করা।
৯. অবসাদ লাগা ও ঘুম কম হওয়া।
জটিলতা
হাইপ্রেশারের সবচেয়ে বড় জটিলতা হচ্ছে হার্ট অ্যাটাক এবং ব্রেইন স্ট্রোক। প্রায় প্রতি বছর গ্লোবাল ডেথের ৩৩ শতাংশ হার্ট অ্যাটাক কিংবা ব্রেইন স্ট্রোকে মারা যায়, যাদের অনেকেই Undiagnosed থাকে। তাদের যে হাইপ্রেশার ছিলো, তাও তাদের জানা থাকেনা। তাই দেখা যায়, হঠাৎ করে বুকে ব্যাথা উঠে এবং কয়েক ঘণ্টার মধ্যে মারা যেতে পারেন।
অন্যান্য জটিলতা
১. বুকে অসহনীয় ব্যাথা বা unstable angina
২. ক্রনিক কিডনি ডিজিজ।
৩. ভাস্কুলার ডিজিজ ইত্যাদি।
প্রতিরোধ
১. ধুমপান থেকে বিরত থাকা।
২. অতিরিক্ত চর্বিযুক্ত খাবার থেকে বিশেষ করে গরুর মাংস খাবার থেকে বিরত থাকা।
৩. লবণ কম খাওয়া।
৪. ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা।
৫. নিয়মিত ব্যায়াম করা ।
৬. প্রচুর শাকসবজি খাওয়া বা ফাইবার খাওয়া।
৭. কাচা ফলমূল খাওয়া।
৮. ডায়াবেটিস থাকলে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা।
এ ছাড়া যে কোন জটিলতায় চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে এবং নিয়মিত ফলোআপে থাকতে হবে।
টিআই/ এএইচ