০১ এপ্রিল, ২০২৩ ০৭:০২ পিএম

প্রফে ভালো করার চেয়ে হতাশা কাটিয়ে উঠাই বড় সাফল্য

প্রফে ভালো করার চেয়ে হতাশা কাটিয়ে উঠাই বড় সাফল্য
তৌহিদুল ইসলাম। ছবি: মেডিভয়েস

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) অধিভুক্ত মেডিকেল কলেজগুলোর মে ২০২২ সালের এমবিবিএস প্রথম প্রফেশনাল পরীক্ষায় সব বিষয়ে অনার্স মার্ক পেয়ে প্রথম স্থান অর্জন করেছেন রাজধানীর স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের তৌহিদুল ইসলাম। ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষে এমবিবিএস ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেলের ৪৯তম ব্যাচে ভর্তি হন এ শিক্ষার্থী।

ঢাবি মেডিসিন অনুষদের ডিন অফিস সূত্রে জানা যায়, এ বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে প্রায় ছয় হাজার শিক্ষার্থী এমবিবিএস প্রথম প্রফেশনাল পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন। এর মধ্যে সব বিষয়ে অনার্স মার্ক পেয়ে ঢাবিতে প্রথম স্থান অধিকার করেন তৌহিদুল ইসলাম। 

সম্প্রতি মেধাবী এ শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা হয় মেডিভয়েসের। জানান, চিকিৎসা পেশা ঘিরে তার পরিকল্পনা। সেই সঙ্গে উঠে আসে ঈর্ষণীয় সাফল্যের নেপথ্যের কথা। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন: সাখাওয়াত হোসাইনক্যামেরায় ছিলেন আব্দুল লতিফ সাদ্দাম

মেডিভয়েস: প্রায় ছয় হাজার মেডিকেল শিক্ষার্থীর মাঝে প্রথম হয়েছেন। আপনার অনুভূতি জানতে চাই।

তৌহিদুল ইসলাম: এ ফলাফলে মা-বাবা, শিক্ষক-শিক্ষিকা ও বন্ধু-বান্ধবরা আনন্দে উচ্ছ্বাসিত। ভালো ফলাফল করলে যেকোনো শিক্ষার্থীর কাছেই ভালো লাগে, আমার কাছেও তাই। ভালো ফলাফল অর্জন করার জন্য আমি চেষ্টা করেছি, মহান আল্লাহ আমাকে হতাশ করেননি। আমি খুবই আনন্দিত।

মেডিভয়েস: কোন অনুপ্রেরণায় এ পর্যন্ত আসা?

তৌহিদুল ইসলাম: মা-বাবা সবসময় আমাকে অনুপ্রেরণা দিয়েছেন। সেইসঙ্গে সমর্থনও দিয়েছেন। তাঁরা বলেছেন, তুমি অবশ্যই পারবে। আর আমরা যারা মেডিকেলে পড়তে এসেছি, আমাদের মধ্যে মানব সেবার একটা অনুপ্রেরণা কাজ করে। আমাদের সবারই ভালো চিকিৎসক হওয়ার চিন্তা থাকে। ছোটবেলা থেকে এ পর্যন্ত আমার যত শিক্ষক-শিক্ষিকারা আছেন, তাদেরও যথেষ্ট অবদান রয়েছে। আমার পরিবারে সদস্যরা আমাকে সহায়তা করেছেন। আমার খুব কাছের বন্ধু-বান্ধবরাও সহায়তা করেছেন। আশেপাশের মানুষ থেকেও শিক্ষা নিয়েছি। কিছু সফল মানুষকে দেখে মনে হয়েছে, আমিও চাইলে তাদের মতো পারবো। সেই অনুপ্রেরণা কাজে লাগিয়ে এখন পর্যন্ত আসা।

মেডিভয়েস: আপনার পড়ার কৌশল কেমন ছিল?

তৌহিদুল ইসলাম: প্রফে ভালো করার জন্য আলাদাভাবে পড়াশোনা করতে হয় এমন কিছু না। নিয়মিত পড়াশোনা করলেই হয়। তবে পরীক্ষা কেন্দ্রিক পড়াশোনায় গুরুত্ব দিতে হবে। পরীক্ষায় প্রশ্নের উত্তরগুলোকে একটু ভিন্নভাবে উপস্থাপন করতে হবে। অর্থাৎ পরীক্ষার খাতায় উত্তরগুলো অন্যদের চেয়ে আলাদাভাবে উপস্থাপন করতে হবে।

শুধু প্রফে ভালো করার জন্য পড়াশোনা করা ঠিক নয়। শিক্ষা জীবন শেষে মানুষের সেবা করার জন্য যোগ্য চিকিৎসক হতে ভালোভাবে পড়াশোনা করা উচিৎ। প্রফে ভালো করা ছোট একটি উদ্দেশ্য। আমাদের উদ্দেশ্য হওয়া উচিত মানব সেবার মাধ্যমে পৃথিবীকে ব্যতিক্রম কিছু উপহার দেওয়া। 

মেডিভয়েস: প্রথম হওয়ার অভিজ্ঞতা থেকে নবীন শিক্ষার্থীদের প্রতি আপনার পরামর্শ কী?

তৌহিদুল ইসলাম: আমাকে অনেক জুনিয়র ইনবক্সে নানা রকম প্রশ্ন করেছে, তাদের জন্য কিছু বলার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য মেডিভয়েসকে ধন্যবাদ জানাই। জুনিয়রদের জন্য পরামর্শ হলো-প্রথম থেকে পড়াশোনা নিয়ে আন্তরিক হতে হবে। তবে সবকিছু ছেড়ে শুধু পড়াশোনা করলেই হবে না। কারণ, যারা সব কিছু বাদ দিয়ে শুধু পড়াশোনা করে, তাদের ফলাফল যে খুব ভালো হয়-এমন নয়। ভালো ফল করতে একটু ভিন্নভাবে পড়াশোনা করতে হবে। শুরু থেকে প্রশ্নের ধরন সম্পর্কে জানতে হবে, বিগত বছরের প্রশ্ন দেখতে হবে। সিনিয়রদের থেকে ভাইবার অভিজ্ঞতা শুনে মানসিকভাবে নিজেকে প্রস্তুত করতে হবে। 

প্রথম প্রফে এনাটমি, ফিজিওলজি এবং বায়োকেমেস্ট্রি এই তিনটা সাবজেক্ট রয়েছে। যেকোনো বিষয় পড়ার সময় একটি নিজস্ব পদ্ধতি নির্ধারণ করবে। নির্ধারণ করা মানে হলো আমি একটি প্রশ্ন থেকে কয়টি লাইন ও পয়েন্ট লিখবো। ভাইবায় এই প্রশ্নটা করা হলে কোন কোন পয়েন্ট আমি বলবো এবং কোন কোন পয়েন্ট শিক্ষক শুনতে পছন্দ করবেন। কত সময় পড়লে তোমার সিলেবাস শেষ হবে, কোন কোন সময় পড়লে তোমার মনে থাকবে এবং কোন জায়গা থেকে পড়বা- এটি শিক্ষার্থীকে নির্ধারণ করতে হবে। মনে রাখবে, এমবিবিএস পর্যায়ে শিক্ষকরা কখনোই আশা করেন না, আমরা সবকিছু পারবো। কিন্তু শিক্ষকরা কিছু জিনিস প্রত্যাশা করেন, যেটা ছাড়া আমাদের প্রফটা সুন্দর হবে না। এই জিনিসগুলো মাথায় রেখে পড়াশোনা করতে হবে। এর জন্য লেকচার, টিউটোরিয়াল, আইটেম থেকে প্রস্তুতি নিতে হবে। পড়াশোনায় কোন গ্যাপ রাখা যাবে না। কারণ মেডিকেলে কোন বিষয়ে পড়ার কোথাও ঘাটতি হলে-তা পরবর্তীতে আর পূরণ করার সময় থাকে না।  

মেডিভয়েস: যারা প্রফে অকৃতকার্য হয়েছে, তাদের প্রতি আপনার পরামর্শ কী?

তৌহিদুল ইসলাম: কোন কাজকে আগেই যদি ভেবে নেওয়া হয় কঠিন, তখন সত্যি সত্যি কাজটা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। এজন্য কঠিনের চিন্তা না করে, আমরা পড়াশোনাকে উপভোগ করবো। উপভোগ করেই পড়াশোনা করা উচিত। 

মেডিকেলকে নিজের জন্য অভিশাপ বা চাপ কখনো ভাবা উচিৎ নয়। কারণ এক লাখ ২০ হাজারেরও বেশি শিক্ষার্থীর সঙ্গে প্রতিযোগিতা করেই মেডিকেলে চান্স পেয়েছি। সৃষ্টিকর্তা চেয়েছেন বলে এ পর্যন্ত এসেছি। আমরা মেডিকেলের জন্য উপযুক্ত বলেই তিনি আমাদেরকে পড়ার সুযোগ দিয়েছেন। মহান সৃষ্টিকর্তার এই সিদ্ধান্তের প্রতি সম্মান জানিয়ে আমাদের উচিত পড়ালেখাটাকে উপভোগ করা। যতটুকু সম্ভব পড়ুন। কারও সাথে নিজেকে তুলনা করা উচিত নয়।

মেডিভয়েস: মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার সাফল্য অনেকে প্রফগুলোতে ধরে রাখতে পারেন না, কী কী কারণ থাকতে পারে?

তৌহিদুল ইসলাম: মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষা প্রশ্ন কাঠামো আর মেডিকেলের সিলেবাস একেবারে আলাদা। বুয়েট, রুয়েট, কুয়েটের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নের সাথে একাডেমিক যথেষ্ট মিল পাওয়া গেলেও মেডিকেলে পাওয়া যায় না। মেডিকেলের ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে আসি এমসিকিউ ভিত্তিক। ভর্তি হওয়ার পর সম্পূর্ণ অন্য রকম পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হয়।

আরেকটা ব্যাপার হলো-মেডিকেলে চান্স পাওয়ার সময় যে অনুপ্রেরণাটা কাজ করে, সেটা ভর্তি হওয়ার পর তেমন থাকে না। ভর্তি পরীক্ষার পূর্বে মেডিকেলে চান্স পেতে হবে বা যেকোনোভাবে মেডিকেলে একটা সিট পেতে হবে এরকম প্রতিজ্ঞা থাকে। কিন্তু মেডিকেলে ভর্তি হওয়ার পর শিক্ষার্থীদের কাছে মনে হয়, প্রফে ভালো করে লাভ কী? বা এতো ভালো পড়াশোনা করেও কি হবে? যে পড়াশোনা কম করে সেও চিকিৎসক হবে, আমিও চিকিৎসক হবো। এখানে প্রফে প্রস্তুতির জায়গাটায় কিছুটা দুর্বলতা চলে আসে এবং শিক্ষার্থীরা পড়াশোনার প্রতি কিছুটা আগ্রহ হারিয়ে ফেলে।

মেডিভয়েস: কোন বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হতে চান? 

তৌহিদুল ইসলাম: আমি গবেষণাখাতকে বেশি প্রাধান্য দিবো। কারণ আমার কাছে মনে হয়, প্রচলিতভাবে চিকিৎসা দিয়ে যতটুকু মানুষের উপকার বা সেবা দিতে পারবো, তার চেয়ে বেশি সেবা দিতে পারবো গবেষণায় করে। এতে বৃহৎ কমিউনিটির উপকার হবে। এমনও হতে পারে আমি বিশ্বকে কিছু উপহার দিতে পারবো। এখান থেকে মনে হয়, গবেষণায় গেলে ভালো কিছু করতে পারবো। আর আমি মাক্রোবায়োলজি এবং পাবলিক হেলথে আমার যথেষ্ট আগ্রহ আছে। এগুলো আমার কাছে ভালো লাগে।

মেডিভয়েস: স্বপ্নের মেডিকেল পড়া কেমন উপভোগ করছেন? কোন কৌশলে টপকে যান?

তৌহিদুল ইসলাম: বিশ্ববিদ্যালয় লেভেলে বেশ কিছু সংগ্রাম করা লাগে। অনেক বিষয় থাকে, যেগুলো ইন্টারমিডিয়েট লেভেল পর্যান্ত আমাদের মাথায়ই আসে না। এখানে আসার পর অনেক কিছু দেখেছি এবং শিখেছি। মেডিকেলে ভালো লাগা এবং খারাপ লাগা দুটিই আছে। মেডিকেলে খারাপ লাগাটাকেও আমি উপভোগ করি।

মেডিভয়েস: যেকোনো চ্যালেঞ্জ কীভাবে অতিক্রম করেন?

তৌহিদুল ইসলাম: মেডিকেল সেক্টর পুরোটাই একটা চ্যালেঞ্জ। এখানে রোগীকে ব্যবস্থাপনা করতে হয়। অর্থ্যাৎ মানুষের জীবন-মরণ নিয়ে ব্যবস্থাপনার কাজ করতে হয়। প্রতিদিনের ছোট ছোট পরীক্ষা বা বড় পরীক্ষা আমার কাছে সবই মনে হয় একেকটা করে চ্যালেঞ্জ। আমার কোনো দিন পড়া বাকি থাকলে সেটা আমার কাছে সম্পূর্ণ করা চ্যালেঞ্জ মনে হয়। পরের দিন টার্ম থাকলে টার্মই একটা বড় চ্যালেঞ্জ। যখন প্রফ থাকে, তখন মনে হয় প্রফে ভালো করা একটা চ্যালেঞ্জ। এখন ওয়ার্ডে প্লেসমেন্টে আছি, ওয়ার্ডের যে ব্যাপারগুলো থার্ড ইয়ারে গিয়ে শিখতে হবে, সেগুলো হলো আমার কাছে চ্যালেঞ্জ। সুতরাং মেডিকেলের প্রতিটি ধাপই একেকটা চ্যালেঞ্জ আর এগুলো সফলভাবে পার হওয়াও চ্যালেঞ্জ। এর মাধ্যমেই একটা মানুষ ভালো চিকিৎসক হতে পারে।

মেডিভয়েস: মেডিকেলে পড়ার স্বপ্ন কোথা থেকে পেলেন? ভর্তিচ্ছুদের প্রতি আপনার পরামর্শ জানতে চাই।

তৌহিদুল ইসলাম: মেডিকেলে পড়ার স্বপ্ন ছোটবেলা থেকেই ছিল। আব্বু-আম্মু আর পরিবারের সবাই চেয়েছিল আমি যেন মেডিকেলে পড়ি। সেখান থেকেই স্বপ্ন দেখা। মেডিকেলে আসার পর কখনও হতাশায় পড়িনি কথাটা বললে ভুল হবে। শুরুর থেকে পড়ার সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে কষ্ট হয়েছে। আমি নিজেও বুঝতাম না, কি এবং কীভাবে করা উচিত। এই জায়গাটায় সর্বোচ্চ সহযোগিতা পেয়েছি আমার বাবা এবং মায়ের।

মেডিভয়েস: প্রফে অকৃতকার্য হওয়ার পিছনে সোশ্যাল মিডিয়া, বাজে বন্ধু কিংবা অন্যান্য কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ততায় যুক্ত হয়ে যাওয়াকেও এক্ষেত্রে দায়ী করেন অনেকে। আপনার দৃষ্টিতে এর ভূমিকা কতটুকু?

তৌহিদুল ইসলাম: সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ঘুরলে আমরা যে হা হুতাশার পোস্ট দেখি, এটি বাড়িয়ে বলার মতো কিছু না। মেডিকেল আসলে হতাশ হওয়ার মতো জায়গা। আর হতাশা কাটিয়ে উঠাই বড় স্বার্থকতা। সেইসঙ্গে নিয়মিত পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারা। মেডিকেল লাইফে প্রফে ভালো করার চেয়ে হতাশা কাটিয়ে উঠাই বড় সাফল্য। আর হতাশা কাটিয়ে উঠার জন্য বড় মাধ্যম হতে পারে আমাদের বন্ধু-বান্ধব, সিনিয়র ভাই-আপু ও শিক্ষকরা। আমরা যারা হলে থাকি, কেউ শারীরিক বা মানসিক অসুস্থ হলে একে অন্যকে সহযোগিতা করি। এ ছাড়া পরিবার যে কোন খবর শুনলে ছুটে আসে। যেসব খারাপ বা দুর্ঘটনার সংবাদ শুনি, তা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এসব শিক্ষার্থীরা কোন খারাপ পরিস্থিতির মুখোমুখি হলে, কোথাও গিয়ে ভরসার জায়গা পায় না। এজন্য হয়তো তারা অন্যপথটি বেচে নেয়। যেটি মোটেও কাম্য নয়।

এসএএইচ/এইচএ

মেডিভয়েসের জনপ্রিয় ভিডিও কন্টেন্টগুলো দেখতে সাবস্ক্রাইব করুন MedivoiceBD ইউটিউব চ্যানেল। আপনার মতামত/লেখা পাঠান [email protected] এ।
  ঘটনা প্রবাহ : সলিমুল্লাহ মেডিকেল
  এই বিভাগের সর্বাধিক পঠিত
এক দিনে চিরবিদায় পাঁচ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক
করোনা ও বার্ধক্যজনিত অসুস্থতা

এক দিনে চিরবিদায় পাঁচ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক