২৩ মার্চ, ২০২৩ ০৭:৪৯ পিএম

মানসিক অসুস্থতা জয়: ২০ বছর পর ডাক্তার হলেন করিম জামাল

মানসিক অসুস্থতা জয়: ২০ বছর পর ডাক্তার হলেন করিম জামাল
ডা. আবদুল করিম জামাল।

জীবনের লক্ষ্য আর বাবার স্বপ্ন ছিল ছেলেকে সাদা এপ্রোনে ডাক্তার হিসেবে দেখতে। অবেশেষে সূর্যের আলোর মতো, সাদা এপ্রোন আলিঙ্গন করে নিয়েছে তাকে। তবে মাঝখানে কেটে গেছে জীবনের রঙ্গীন ২০টি বছর। অবিশ্বাস্য এরকম সফলতার গল্প একেঁছেন স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের ২৩তম ব্যাচের শিক্ষার্থী আবদুল করিম জামাল।

এমবিবিএস কোর্সের চূড়ান্ত পরীক্ষায় অংশগ্রহণের আগে মানসিক রোগে আক্রান্ত, দীর্ঘ বিরতির পর এমবিবেএস কোর্স সম্পন্ন, ইন্টার্ন চিকিৎস হিসেবে পথ চলা শুরু ও জীবনের বাঁকে ঘটে যাওয়া নানা বিষয়ে সম্প্রাতিক সময়ে মেডিভয়েসের মুখোমুখি হন ডা. করিম জামাল। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ওমর ফারুক ফাহিম, প্রতিবেদন তৈরি করেছেন সাখাওয়াত আল হোসাইন।

ডা. আবদুল করিম জামাল বলেন, ‘এসএসসি আর এইচএসসিতে আমার লেটার মার্কস ছিল। প্রথমবারেই আমি সরকারি মেডিকেলে চান্স পাই। বাবার স্বপ্নে আমি মেডিকেলে পড়তে এসেছি, আমারও স্বপ্ন ছিল। বাবা আজ বেঁচে নেই। বাবার কথা মনে পড়লে মাঝে মাঝে কষ্ট হয়। মেডিকেল জীবনের প্রথম দুই বছর ভালোই চলছিল, মেডিকেলে পড়াশোনা করছি, নিয়মিত ক্লাস করছি। ফাস্ট প্রফের এডমিট কার্ড বাসায় নেওয়ার পর হঠাৎ আমি অসুস্থ হয়ে পড়ি। অসুস্থতা নিয়ে তৃতীয় প্রফেশনাল পরীক্ষা শেষ করলেও আর এগোতে পারেনি। মানসিক অসুস্থতায় এক পর্যায়ে লেখাপড়া থেকে ছিটকে পড়তে হয়। 

এমবিবিএসের পড়া রিভিশন দিতে না পড়লে পরীক্ষা দিব কিভাবে? এক পর্যায়ে বাবা খবর পেয়ে মেডিকেল থেকে বাড়িতে নিয়ে যান। তারপর চিকিৎসা নেওয়ার পর সুস্থ হই। সুস্থ হওয়ার চার মাস পর পরীক্ষা দিয়ে ফাস্ট প্রফে পাস করি। আর সেকেন্ড প্রফ দুইবারে পাস করি। থার্ড প্রফে এসে মেডিসিন পাস করার পর সার্জারি আর গাইনি খারাপ হয়ে যায়। কয়েকবার পরীক্ষা দেওয়ার পরও পরীক্ষা খারাপ হয়। এক পর্যায়ে আমি ভেঙে পড়ি। কয়েক বছর চলে যায়, এভাবেই।’

এরপর শুধু অপেক্ষা আর হতাশার গল্প। বারবার চেষ্টা করেও পড়ালেখা চালিয়ে যেতে ব্যর্থ হন গুরুতর মানসিক রোগ সাইকোসিসে আক্রান্ত এ মেডিকেল শিক্ষার্থী।

তিনি বলেন, ‘আমি মানসিকভাবে হতাশায় ভুগতাম। স্যারেরা আমাকে বলেছে, তোমার মানসিক সমস্যা। সাময়িক ডিপ্রেশন সাইকোসিস হয়েছে। প্রফের পরীক্ষা দেওয়ার পর খারাপ হয়ে যেত। ৫০ পেলে পাস, আমি পেতাম ৪৮ বা ৪৯ এভাবে।’

দীর্ঘ চিকিৎসায় সুস্থ হয়ে আবারও ফিরে আসার পালা প্রিয় ক্যাম্পাসে। মাঝখানে এসেছে জীবনের নতুন বাঁক, করেছেন বিয়ে রয়েছে সাড়ে চার বছরের ছোট্ট মেয়ে। স্ত্রীর উৎসাহ আর প্রিয়জনের অনুপ্রেরণায় নানান সীমাবদ্ধতা ও প্রতিকূলতা পেরিয়ে আবারও ছুটে চলা স্বপ্নের গন্তব্যে। তার উদ্যমী মনোভাব দৃষ্টি কাড়ে কর্তৃপক্ষের, এর কল্যাণে সুযোগ মেলে পরীক্ষা দেওয়ার।

এ প্রসঙ্গে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. মো. নুরুল হুদা লেনিন মেডিভয়েসকে বলেন, ‘তাঁর পরীক্ষা দেওয়া নিয়ে একটাই বাঁধা ছিল সেটি হলো বয়স। আমি দেখেছি তার মধ্যে দৃড় সংকল্প ও ইচ্ছা শক্তি আছে। এতে যত বাঁধা আছে, তা পেরিয়ে যেতে পারবে। এটি ছিল প্রথম কথা। দ্বিতীয় ছিল আইনগত কিছু বাঁধা, আমি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে জানালাম, তখন তাঁরা অনুমতি দিয়ে দিলো।’ 

দীর্ঘ বিরতির পর আবারও ফিরে আসাকে সাধুবাদ জানিয়েছেন, হলের রুমমেট ও সহপাঠীরা। জানিয়েছে, বয়সে অনেক সিনিয়ার হলেও মানিয়ে নিতে একটুও বেগ পেতে হয়নি তাঁদের।

জানতে চাইলে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের ফাইনাল প্রফের শিক্ষার্থী এ এইচ আকাশ মেডিভয়েসকে বলেন, ‘আমার পাশে তাঁর সিট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। আমার কেন জানি মনে হলো উনার এখানে কোনো ব্যাচমেট বা বন্ধু নেই, তখন আমি নিজ থেকে গিয়ে উনার সাথে প্রায়ই কথা বলতাম। পরীক্ষা সময় পড়তে গিয়ে হতাশ হয়ে গেলে, তিনি আমার রুমেে আসতেন। আমিও যথেষ্ট চেষ্টা করেছি, ওনি যাতে হতাশ না হন।’

আরেক শিক্ষার্থী সৌরভ কুন্ড বলেন, ব্যক্তিগতভাবে যখন আমারও হতাশ লাগতো, তখন আমি ভাইয়ের ফিরে আসার গল্পটা জানতাম এবং সাহস পেতাম।

ডা. জামালের ব্যাচমেট ডা. মাহবুব আলম মেডিভয়েসকে বলেন, ‘তিনি আমাদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ করতেন। যদিও তাঁর বয়স বেশি, কখনও মনে হয়নি ডা. জামালের আমাদের চেয়ে বেশি বয়সী। পরীক্ষার আগে টানা এক সপ্তাহ বা দশ দিন চোখে কোনো ঘুম থাকতো না। আর ডা. জামাল ভাই ঠিকই রাত নয়টা বা দশটার দিকে ঘুমিয়ে যেত, আবার সকাল পাঁচটা বা ছয়টার দিকে উঠে নামাজ-কালাম শেষে পড়তে বসতেন।’

গত ৪ মার্চ প্রকাশিত ফলাফলে চূড়ান্ত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার সুবাদে জামালের নামের সাথে যুক্ত হয় বহুল প্রত্যাশার ডাক্তার শব্দ। এখন তিনি ডা. আব্দুল করিম জামাল।

জীবনের এই বয়সেও কঠোর পরিশ্রমে এমবিবিএস শেষ করায় উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন শিক্ষক, সহপাঠী ও পরিবারের সদস্যরা।

এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক ডা. মো. নুরুল হুদা লেনিন বলেন, ‘মা-বাবা কখন সবচেয়ে বেশি আনন্দিত হয়, যখন ছেলে-মেয়েরা লেখাপড়ায় উন্নতি করে বা তাদের জীবনে কোনো উন্নতি করে। এরা সবাই আমাদের কাছে সন্তান তুল্য। আমাদের ছেলে-মেয়েরা ভালো রেজাল্ট করলে এটি পরম পাওয়া।’

জানতে চাইলে সিলেটের ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মনোরোগ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. সাঈদ এনাম মেডিভয়েসকে বলেন, ‘ডা. জামাল আমার বন্ধু ছিলেন। প্রথম বর্ষ থেকে ফাইনাল ইয়ার পর্যন্ত আমরা প্রায় একসাথে ছিলাম। তিনি পাস করেছেন এবং চিকিৎসক হয়েছেন। এটা আমার জন্য সত্যি আনন্দ ও আবেগের বিষয়। তাঁর সাথে যখনই আমার দেখা হতো এবং কথা হতো, একটি কথাই বলতাম পড়াশোনা করার জন্য এবং পরীক্ষা দেওয়ার জন্য।’

এ প্রসঙ্গে ডা. জামালের বড় ভাই জয়নাল আবেদীন বলেন, ‘অদম্য ইচ্ছাশক্তির কারণে ডা. জামাল এত বছর পর এ সফলতা অর্জন করতে পেরেছে। এর পেছনে তার স্ত্রীরও ভালো একটা ভূমিকা রয়েছে। এছাড়া আমার ছোট ভাইয়েরও অনেক অবদান রয়েছে এবং আমার বড়বোনও তাঁর পেছনে সময় ও শ্রম দিয়েছেন।’

মানসিক রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিকে অবজ্ঞা-অবহেলা না করে যথাসময়ে চিকিৎসা নিশ্চিতের তাগিদ দিয়েছেন মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা। বলেন, সঠিক চিকিৎসা ও উপযুক্ত পরিচর্যা পেলে অল্প সময়ের ব্যবধানে আলোর সন্ধান পান এসব রোগী।  

জানতে চাইলে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের মনোরোগবিদ্যা বিভাগ সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. রাশিদুল হক মেডিভয়েসকে বলেন, ‘কারও মধ্যে যদি মানসিক রোগ দেখেন, সঙ্গে সঙ্গে একজন মানসিক বিশেষজ্ঞের কাছে যাবেন এবং যোগাযোগ করবেন। সেইসঙ্গে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে চিকিৎসা নিবেন। সঠিকভাবে চিকিৎসা নিলে অল্প সময়ের মধ্যে মানসিক রোগ ভালো হয়ে যায় এবং রোগী স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসবে।’ 

ডা. সাঈদ এনাম বলেন, ‘মানসিক রোগীদেরকে অবহেলা বা চিকিৎসায় কৃপণতা দেখানো, হাল ছেড়ে দেওয়া কখনই উচিত নয়। এর একটি উত্তম উদাহরণ ডা. জামাল।’

ভবিষ্যতে উচ্চতর শিক্ষা শেষ করে, মানবিক চিকিৎসক হিসেবে নিজেকে নিয়োজিত রাখতে চান সদ্য এমবিবিএস সম্পন্ন করা এই চিকিৎসক।

এএইচ/এসএএইচ/এসএস

 

মেডিভয়েসের জনপ্রিয় ভিডিও কন্টেন্টগুলো দেখতে সাবস্ক্রাইব করুন MedivoiceBD ইউটিউব চ্যানেল। আপনার মতামত/লেখা পাঠান [email protected] এ।
কমিউনিটি ক্লিনিকের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির অনুষ্ঠানে ডা. মোদাচ্ছের

কমিউনিটি ক্লিনিক: বঙ্গবন্ধুর দর্শনই প্রধানমন্ত্রীর হাতে বাস্তবায়ন

কমিউনিটি ক্লিনিকের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির অনুষ্ঠানে ডা. মোদাচ্ছের

কমিউনিটি ক্লিনিক: বঙ্গবন্ধুর দর্শনই প্রধানমন্ত্রীর হাতে বাস্তবায়ন

  এই বিভাগের সর্বাধিক পঠিত
এক দিনে চিরবিদায় পাঁচ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক
করোনা ও বার্ধক্যজনিত অসুস্থতা

এক দিনে চিরবিদায় পাঁচ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক