অধ্যাপক ডা. মো. আহসান হাবীব 

অধ্যাপক ডা. মো. আহসান হাবীব 

নিউরোলজি বিভাগ, বিএসএমএমইউ


১৫ মার্চ, ২০২৩ ১১:২২ এএম

বেলস পালসি বা মুখ বেঁকে যাওয়ায় আতঙ্ক নয়, চিকিৎসায় মিলে সমাধান

বেলস পালসি বা মুখ বেঁকে যাওয়ায় আতঙ্ক নয়, চিকিৎসায় মিলে সমাধান
এই রোগ প্রতিরোধে কোনো ব্যবস্থা না থাকলেও ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে থাকলে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কিছুটা কম থাকে। তা ছাড়া শুধু ফিজিওথেরাপি মাধ্যমেই এর চিকিৎসা সম্ভব।

বেলস পালসি মুখের পেশির প্যারালাইসিস। অর্থাৎ বেলস পালসি হলো এমন একটি অবস্থা, যা মুখের পেশীগুলোর অস্থায়ী দুর্বলতা বা পক্ষাঘাত ঘটায়। মস্তিষ্ক থেকে আসা ৭ নম্বর ক্রেনিয়াল নার্ভের নাম ফেসিয়াল নার্ভ, যা মুখের পেশির কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণ করে। এটি আংশিক বা সম্পূর্ণ প্যারালাইজড হয়ে গেলে তাকে ফেসিয়াল প্যারালাইসিস বা বেলস পালসি বলে। যেকোনো বয়সের নারী-পুরুষ এ রোগে আক্রান্ত হতে পারে।

চিকিৎসা বিজ্ঞানে এ রোগের কারণ এখনও অজানা। এই রোগের বা ভাইরাসের প্রতিরোধের কোনো ব্যবস্থা নেই। তবে ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে থাকলে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কিছুটা কম থাকে। আবার এই রোগের চিকিৎসা পদ্ধতিও খুবই সহজ। ফিজিওথেরাপিই হচ্ছে এর প্রধান চিকিৎসা।

স্কটিশ অ্যানাটমিস্ট চার্লস বেলের নামে এই স্বাস্থ্য সংকটটির নামকরণ করা হয়েছে।

বেলস পালসি কী?

বেলস পালসি হলো ফেসিয়াল পালসি। ফেসিয়াল পালসি দুই ধরনের হয়। 

১. মুখের এক পাশ কপাল থেকে শুরু করে একদম থুতনি পর্যন্ত যদি প্যারালাইজড হয়ে গেলে এটাকে লোয়ার মোটর নিউরন টাইপ অব ফেসিয়াল পালসি বলে। 
২. কপালের অংশ বাদে চোখ থেকে নিচের অংশ প্যারালাইজড হলে সেটাকে আপার মোটর নিউরন টাইপ অব ফেসিয়াল পালসি বলে। 

সহজ ভাষায় মুখের যেকোনো এক সাইডের প্যারালাইসিস হয়ে যাওয়াই বেলস পালসি। এর জেনেটিক কোনো কারণ নেই এবং যে কোনো বয়সের মানুষ এতে আক্রান্ত হতে পারে। তবে চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের পর্যবেক্ষণ হচ্ছে তরুণ বয়সে বেশি হয়। পুরুষ, মহিলা, এমনকি শিশুদেরও এ রোগ হতে পারে।

কেন হয়? 

এই রোগটি হওয়ার মূল কারণ অজানা। কিন্তু তথ্য প্রমাণ আছে যে, কিছু কিছু ভাইরাসের কারণে এই বেলস পালসি হয়। যেমন, হার্পিস সিমপ্লেক্স ভাইরাসের ও হার্পিস জোস্টার ভাইরাস দিয়ে বেলস পালসি হয়। এ ছাড়া সারকোডোসিস, লাইম ডিজিজের কারণেও বেলস পালসি হতে পারে। 

এই ভাইরাস কখন হয়

সিজনাল পরিবর্তন হলে তখন এই ভাইরাস হয়। শীতের পরে গরম অথবা গরমের পর শীতকালে ভাইরাসের বংশ বৃদ্ধির মোক্ষম সময়। বংশ বৃদ্ধি বেশি হলে তখন ভাইরাসের আক্রমণও বেশি হবে। এই সময়গুলোতে বেলস পালসি বেশি হয়। আবার অন্য সময়গুলোতেও হতে পারে। 

আক্রান্ত রোগীর পরিসংখ্যান

সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই। তবে আমাদের নিউরোলজির জার্নাল বা বই পত্রে দেখা যায়, প্রতি লাখে ২০ জন লোক এই রোগে আক্রান্ত। শতকরা হিসাব করলে দশমিক ০২ শতাংশ হতে পারে। 

শঙ্কা

অসুখ বড় না হরেও এটা ঘাবরানোর মতোই একটি রোগ। কারণ সুস্থ স্বাভাবিক একজন লোক হঠাৎ করে সকালে উঠে দেখেন নিজের মুখ এক দিকে বাঁকা হয়ে গেছে। চোখ একটা বন্ধ হচ্ছে, একটা হচ্ছে না। কুলি করতে গেলে কুলির পানি একদিকে পড়ে যাচ্ছে। এতে রোগী ভড়কে যান। মনে করেন স্ট্রোক হয়েছে। বেলস পালসিতে রোগীসহ তার আশপাশের মানুষজন আতঙ্কিত হয়ে যায়। অসুখ ছোট হলেও উপসর্গ দেখেই সবাই ভয় পেয়ে যায়। 

উপসর্গ

মুখ যেকোনো একদিকে বাঁকা হয়ে যাবে। ডান দিকে বেলস পালসি হলে মুখ বাম দিকে এবং বাম দিকে হলে ডান দিকে বাঁকা হবে। এক চোখ বন্ধ হলে অন্যটি বন্ধ হবে না। খাবার খেতে গেলে বেলস পালসিতে আক্রান্ত পাশের খাবার আটকে থাকবে। খাবার চিবিয়ে খেতে পারবে না, খাবার আটকে যাবে। কুলি করতে গেলে মুখের একপাশ দিয়ে পানি বের হয়ে যাবে। 

ফেসিয়াল নার্ভ

ফেসিয়াল নার্ভের একটা কোষ আছে। এটা কোথা থেকে উৎপত্তি? আমাদের ব্রেইনে ব্রেইন স্টেম নামে একটা জায়গা আছে। ব্রেইন স্টেমের একটা অংশ হলো পন্স। এই পন্স থেকে ফেসিয়াল নার্ভের উৎপত্তি হয়। ফেসিয়াল নার্ভ আক্রান্ত হলে কখনও কখনও একটা লোক কানে বেশি শুনতে পায়। এটাকে মেডিকেলের ভাষায় বলা হয় হাইপার এ্যাকিউসিস। যেহেতু ফেসিয়াল নার্ভের সঙ্গে কানের নার্ভের সংযুক্তি আছে, তাই ফেসিয়াল নার্ভ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কারণে কানের নার্ভটাও আক্রান্ত হয়। আর তখন বেশি বেশি শব্দ শোনা যায়। ফেসিয়াল নার্ভের কাজ হলো আমাদের জিহ্বাকে সাপ্লাই দেয়া। দেখা যায়, জিহ্বার যে পাশের নার্ভ আক্রান্ত হয়েছে সেই পাশের জিহ্বায় স্বাদ একটু কম হয়।

রোগ নির্ণয় 

একদম ক্লিনিক্যালি নির্ণয় করা হয়। রোগী দেখে, রোগীর ইতিহাস জেনে নির্ণয় করা হয়। শুধু মুখই আক্রান্ত হয়েছে নাকি, হাত-পায়ে কোথাও দুর্বলতা আছে। কারণ হাত পায়ে দুর্বলতা থাকলে তখন আর বেলস পালসি থাকবে না, এটা স্ট্রোকের দিকে চলে যাবে। এরপর আমরা পরীক্ষা করি অর্থাৎ রোগীকে বলি চোখ বন্ধ করেন, কপাল উপরের দিকে কুচকান, দাঁত দেখান। এসব দেখে আমরা বুঝি এটা বেলস পালসি কিনা। এর জন্য কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষার দরকার হয় না। যদি দেখা যায়, রোগীর এর সঙ্গে অন্য কোনো উপসর্গ আছে, তখন আমরা রোগীকে পরীক্ষা করি। এ ছাড়া বেলস পালসি নির্ণয় করতে পরীক্ষা লাগে না। যাদের ডায়াবেটিস থাকে, উচ্চ রক্তচাপ থাকে তাদের বেলস পালসি হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে। এ জন্য বেলস পালসি রোগীদের ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ আছে কিনা—এসব দেখে নিই।

চিকিৎসা

রোগ নির্ণয় হলে চিকিৎসা পদ্ধতি খুবই সহজ। একটা হলো, মেডিকেল চিকিৎসা আরেকটা হলো ফিজিওথেরাপি। ফেসিয়াল নার্ভ আক্রান্ত হলে এই রোগ হয়। এতে ফেসিয়াল নার্ভ ফুলে যায়। এই ফুলা কমানোর জন্য স্বল্প মেয়াদি হাই ডোজের স্টেরয়েড দেওয়া হয়। এতে দ্রুত ফেসিয়াল নার্ভের ফুলা কমে যায়। ফলে তার উপসর্গও দ্রুত কমতে থাকে। আমরা ইদানীং এন্টিভাইরাল ড্রাগও ব্যবহার করে থাকি। যদিও এটা নিয়ে নানান কথা আছে। কিন্তু আমাদের পর্যবেক্ষণ হলো, এন্টিভাইরাল ড্রাগ কাজ করে। এটাও স্বল্প মেয়াদের জন্য দেওয়া হয়। তবে ওষুধের চেয়ে মূল চিকিৎসা হচ্ছে ফিজিওথেরাপি। ফিজিওথেরাপি দিলে আর স্টেরয়েড স্বল্প মেয়াদি কোর্স খেলে রোগী দুই তিন সপ্তাহ বা এক মাসের মধ্যে ভালো হয়ে যায়। কারও কারও ক্ষেত্রে একটু সময় বেশি লাগে। তরুণরা দ্রুত সুস্থ হয়। বয়স্কদের সুস্থ হতে সময় লাগে। ৯০ শতাংশ পুরোপুরি সুস্থ হয়। ১০ শতাংশের ক্ষেত্রে কিছু দুর্বলতা থাকে। যেমন, মুখ কিছুটা বাঁকা থেকে যেতে পারে। তবে দীর্ঘ সময় ধরে ফিজিওথেরাপি দিতে পারলে সে বাঁকাটও ধীরে ধীরে ঠিক হয়ে যাবে। সঠিক চিকিৎসা পেতে হলে অবশ্যই নিউরোলজিস্টদের কাছে যেতে হবে।

প্রতিকার

এই ভাইরাসের প্রতিকারের কোনো ব্যবস্থা নেই। ভাইরাস তো বাতাসে ঘুরে, এটাকে কি দিয়ে ঠেকাবেন? প্রতিকার করার কোনোই সুযোগ নেই। যার হবে হবেই। কিছু কিছু ক্ষেত্রে বলা আছে, ডায়াবেটিস ও প্রেসার নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি অনেকটা কমে যায়। যাদের একটুতেই সর্দি কাশি হয়, তাদের ইনফ্লুয়েঞ্জার ভ্যাকসিন নেওয়া থাকলে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি একটু হলেও কম থাকে।

এই রোগে একবার আক্রান্ত হলে সুস্থ হওয়ার পর জীবন যাপন স্বাভাবিকই থাকবে। পরিবর্তন কোনো দরকার নেই। শুধু ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ থাকলে তা নিয়ন্ত্রণে রাখবে।

জটিলতা

৫ শতাংশ মানুষের বেলস পালসির কিছু জলিতা হতে পারে। মুখের এক অংশ কিছুটা দুর্বল থাকে। অনেক সময় ফেসিয়াল নার্ভের কোষ বেলস পালসিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এতে নার্ভ ঘুরে চোখের দিকে যেতে পারে। তখন খাবার খেলে নার্ভ কাজ করে চোখে অর্থাৎ দেখা যায়, মুখ দিয়ে খাবার খাচ্ছে আর চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। এটাকে বলা হয় ক্রোকোডাইল আই। এমনটা কারো কারো ক্ষেত্রে ঘটতে পারে।

টিআই/এমইউ

 

মেডিভয়েসের জনপ্রিয় ভিডিও কন্টেন্টগুলো দেখতে সাবস্ক্রাইব করুন MedivoiceBD ইউটিউব চ্যানেল। আপনার মতামত/লেখা পাঠান [email protected] এ।
কমিউনিটি ক্লিনিকের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির অনুষ্ঠানে ডা. মোদাচ্ছের

কমিউনিটি ক্লিনিক: বঙ্গবন্ধুর দর্শনই প্রধানমন্ত্রীর হাতে বাস্তবায়ন

কমিউনিটি ক্লিনিকের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির অনুষ্ঠানে ডা. মোদাচ্ছের

কমিউনিটি ক্লিনিক: বঙ্গবন্ধুর দর্শনই প্রধানমন্ত্রীর হাতে বাস্তবায়ন

  এই বিভাগের সর্বাধিক পঠিত
এক দিনে চিরবিদায় পাঁচ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক
করোনা ও বার্ধক্যজনিত অসুস্থতা

এক দিনে চিরবিদায় পাঁচ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক