
ডা. আশিকুর রহমান রুপম
এমবিবিএস, বিসিএস (স্বাস্থ্য)
মেডিকেল প্রাবন্ধিক ও জেনারেল ফিজিশিয়ান
১২ মার্চ, ২০২৩ ১২:০১ পিএম
চিকিৎসকরা প্রেসক্রিপশনে এত ওষুধ লেখেন কেন?

অনেক রোগী এবং রোগীর স্বজন ডাক্তারের কাছে এসে অভিযোগ করেন- কেন এত ওষুধ দিয়েছেন? প্রেসক্রিপশন দেখে মনে হচ্ছে, ভাতের চাইতে ওষুধই বেশি খেতে হবে। কেন এত এত ওষুধ? এর উত্তর এক কথায় বললে অনেকের কাছেই বোধগম্য হবে না। তাই খুলে বলা যাক।
যখন কোনো রোগীর ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, উচ্চ রক্তচর্বি, হাঁপানি ইত্যাদি থাকে, তখন চিকিৎসকগণ ওই প্রত্যেকটা রোগের বিপরীতে এক বা একাধিক ওষুধ প্রেসক্রাইব করে থাকেন। প্রশ্ন হতে পারে, একটা রোগের জন্য একটা ওষুধ ঠিক ছিল, আবার একাধিক কেন? একাধিক বলতে কয়টা?
উত্তর: যদি এক ওষুধে ডায়াবেটিস/প্রেশার নিয়ন্ত্রণ হয়, তাহলে একটাই দেওয়া হবে। এমন কি ওষুধ ছাড়াও যদি লাইফ স্টাইল মোডিফাই করে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন, তাহলে কোনো ওষুধই দেওয়া হবে না। কিন্তু যদি এক ওষুধে নিয়ন্ত্রণ না হয়, তখন ২টা বা ৩টা পর্যন্ত ওষুধ লেখা হয়ে থাকে। এরপরও নিয়ন্ত্রণ না হলে, সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এখন যদি কারো ডায়াবেটিসের জন্য ২টা, প্রেশারের জন্য ২টা, হাঁপানির জন্য ৩টা, চর্বি কমানোর জন্য ১টা দেওয়া হয়। তাহলে ওই রোগীর পুরাতন রোগেরই (২+২+৩+১=৮টা ওষুধ চলবে। এরপর নতুন অসুখ থাকতেই পারে, যেমন: জ্বর, সর্দি, কাশি, প্রস্রাবে জ্বালা ও পেট ব্যাথা ইত্যাদি। তাহলে এখন যদি রোগীর পুরাতন অসুখের সাথে নতুন অসুখের চিকিৎসা দেওয়া হয় (যদি ২-৩ টা ওষুধও লেখা হয়) তবে তার মোট ওষুধের পরিমাণ দাঁড়াবে ১০-১১টা। এখন বলবেন এর জন্য কি চিকিৎসক দায়ী?
চিকিৎসক তো একজন রোগীর সবগুলো অসুখের জন্যই চিকিৎসা দেবেন। নাকি বলবেন, ‘আপনি জ্বরের জন্য এসেছেন, আমি শুধু জ্বরের ওষুধ লিখে ছেড়ে দিলাম, বাকি অন্য কোনো সমস্যা থাকলে অমুক ডাক্তারকে দেখিয়ে আলাদা করে তার প্রেসক্রিপশনে আপনার ওই সমস্যাগুলোর ওষুধ লিখে নিবেন?’ (যেটা অনেক উন্নত দেশে করা হয়।) তাহলে ভাবুন তো আপনাকে কতগুলো ডাক্তার দেখাতে হতো এবং কতগুলো প্রেসক্রিপশন ফলো করতে হতো?
এখন বলবেন, আপনারা কেন বারবার ডায়াবেটিস, প্রেশার বা হাঁপানির কথা তুলে নিয়ে আনেন?
উত্তর: আমাদের দেশে সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায় ডায়াবেটিস, প্রেশারের রোগী। আর মেডিকেল বিজ্ঞানে রোগীর ইতিহাস নোট করার সময় পাস্ট হিস্ট্রি (অতীত ইতিহাস) বলে একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আছে। এর মধ্যে পড়ে এসব ডায়াবেটিস, প্রেশার, হৃদরোগ, হাপানি ও স্ট্রোক ইত্যাদি। কারণ বহু রোগের সূত্রপাত হয় এইসব রোগ থেকে। যেমন: ডায়াবেটিস রোগীদের ঘন ঘন প্রস্রাবে ইনফেকশন হয়, চোখের সমস্যা (ছানি, রেটিনোপ্যাথি), দাঁতের সমস্যা হয়, পায়ে ঘা হয়, এ ছাড়া ডায়াবেটিস রোগীদের প্রেশার (উচ্চ রক্তচাপ) হয়, হৃদরোগ হয়, স্ট্রোক হয়, হাত পা জ্বালা পোড়া করে, পেট ভার ভার লাগে। এসব সমস্যার চিকিৎসার পাশাপাশি অবশ্যই মূল রোগ (মা রোগ/ শেকড় রোগ), তারও চিকিৎসা অবশ্যই করতে হয়। এই জন্য এই সব রোগের কথা বারবার জিজ্ঞাসা করা হয় এবং গুরুত্বের সাথে চিকিৎসা করা হয়।
প্রশ্ন: সবই বুঝলাম, তাহলে একবার হার্ট এটাক বা স্ট্রোক করলে এত এত ওষুধ কেন দেওয়া হয়?
উত্তর: এর কারণ যখন একবার কারো হার্ট এটাক বা স্ট্রোক হয়ে যায়, তখন আবারও হার্ট এটাক বা স্ট্রোক হওয়ার ঝুঁকি অন্যদের তুলনায় বহুগুণ বেশি। আর দ্বিতীয়বার এটাক হলে মৃত্যু ঝুঁকি আরো অনেক গুণ বেশি। যাতে আর পরবর্তী এটাক না হয়, তাই অন্যান্য সব ধরনের বন্দোবস্ত করতে হয়।
যেমন: একজন হার্ট এটাকের রোগীর ওষুধ দেওয়া হয়-
১. রক্ত পাতলা রাখার ওষুধ (Aspirin/Clopidogrel)
২. চর্বি কমানোর ওষুধ (Statin)
৩. হার্টে রক্তের প্রবাহ ঠিক রাখার ওষুধ (Trimetazidine, GTN)
৪. হার্ট রেট নিয়ন্ত্রণের ওষুধ (Beta blocker)
৫. হার্ট এটাকের ফলে ওই পঁচে যাওয়া অংশ যেন আরো পাতলা হয়ে হার্টের দেওয়াল ফুটো করতে বা ছিড়ে যেতে না পারে, তার ওষুধ (ACEI)
৬. হার্ট ফেইলিউর হয়ে গেলে- তার ওষুধ (Frusemide/Thiazide)
৭. ভাল ঘুম যাতে হয়, তার ওষুধ। কারণ ঘুম ভাল না হলে Anxiety বাড়ে ফলে নানা সমস্যার জন্ম হয়।
৮. উচ্চ রক্ত চাপের ওষুধ
৯. ডায়াবেটিসের ওষুধ
১০. গ্যাসের ওষুধ ইত্যাদি।
এসব কারণেই প্রেসক্রিপশনে ওষুধের পরিমাণ বেশি হয়। এটা একটা নমুনা প্রেসক্রিপশন দেওয়া হল। এ রকম অন্যান্য রোগের ক্ষেত্রেও বক্তব্য একই। রোগীদের এ রকম কথা বা অভিযোগের কারণে অনেক চিকিৎসক পুরাতন ওষুধগুলো নতুন প্রসক্রিপশনে না তুলে ‘পূর্বের ওষুধ চলবে/ডায়াবেটিস এবং উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ পূর্বের মত চলবে’ লিখে দেন।
অনেক রোগীর বুঝতে অসুবিধা হয়, তাই তারা ফ্রেশ করে একটা প্রেসক্রিপশনে সব ওষুধ লিখে দিতে বলেন। তখন তাদের অনুরোধে তাই-ই করা হয়। কিন্তু ওই প্রেসক্রিপশন দেখেই ওষুধের দোকানদার বা অন্য সাধারণ মানুষ নানান রকম তীর্যক মন্তব্য করেন, যা অত্যন্ত বেদনাদায়ক এবং এতে চিকিৎসকের প্রতি, চিকিৎসার প্রতি তার আত্মবিশ্বাস কমে যায়। এটা কখনই করা উচিত নয়।
প্রশ্ন: তাহলে কী করা উচিত?
উত্তর: আপনার চিকিৎসককে সরাসরি প্রশ্ন করুন, কোন ওষুধ কেন দেওয়া হয়েছে?- এটা যদি একটু বুঝিয়ে দিতেন। অর্থনৈতিক সমস্যা থাকলে চিকিৎসককে খোলামেলা বলুন। যদিও আপনার আর্থিক অবস্থার কথা জিজ্ঞেস করা চিকিৎসকের গুরুত্বপূর্ণ একটা দায়িত্ব এবং এটা রোগের ইতিহাস নেওয়ার সময়ই করা হয়। যাই হোক, যদি চিকিৎসক না জিজ্ঞেস করেন, তবে আপনি নিজ থেকে তাকে জানান যে, এটার কম দামি অন্য কোমপানির ওষুধ বাজারে আছে কি না? বা এই মুহূর্তে ওষুধ কেনার সামর্থ নেই, সেক্ষেত্রে কোন কোন ওষুধ এখনই জরুরি? ইত্যাদি প্রশ্ন খোলা মেলা করুন। তাতে চিকিৎসকও আপনার সাথে আলোচনা করা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবেন।
আসলে আমাদের দেশে চিকিৎসা করার সময় চিকিৎসককে বহু রকম চিন্তা করতে হয় রোগীর জন্য। চিকিৎসা তো দেওয়া হয়ই, তার পাশাপাশি সামাজিক দায়িত্বও পালন করতে হয়। মানসিক সাপোর্ট দিতে হয়। রোগী এবং রোগীর স্বজনদের উচিত চিকিৎসকের কাছ থেকে তার সর্বোচ্চ টুকু সেবা গ্রহণ করা এবং এর জন্য অভিযোগ নয়, বরং জানার জন্য প্রশ্ন করুন এবং মনোযগ দিয়ে উত্তর শুনুন।
আশা করি, সবার উদ্দেশ্যে কিছুটা সহজ করে লেখার চেষ্টা করলাম। জানি না কতটুকু জানাতে পারলাম বা আপনি এখান থেকে কতটুকু উপকৃত হতে পারবেন। যদি পারেন, তবে আমাদের এই প্রয়াস সার্থক হোক।
