০৯ মার্চ, ২০২৩ ০৩:০২ পিএম

কিডনি বিশেষজ্ঞ থাকলেও কাজের পরিধি কম, সৃষ্টি হয় না পদ

কিডনি বিশেষজ্ঞ থাকলেও কাজের পরিধি কম, সৃষ্টি হয় না পদ
স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, প্রতিবছর কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট হওয়ার প্রয়োজন ৫ হাজার, সেখানে মাত্র ২০০ জনের হচ্ছে। দেশে প্রতি বছর ৩০ থেকে ৪০ হাজার মানুষ কিডনি রোগে আক্রান্ত হয়।

সাখাওয়াত হোসাইন: দেশে প্রতিনিয়ত বাড়ছে কিডনি রোগীর সংখ্যা। সেই সঙ্গে যথাসময়ে চিকিৎসা নিশ্চিত না হওয়াসহ নানা কারণে কারও কারও দুটি কিডনিই বিকল হয়ে যাচ্ছে। জীবন চলার অপরিহার্য এ অঙ্গটির চিকিৎসা ব্যয়বহুল হওয়ায় সেবা নিতে পারছেন না বলে অনেক রোগীর অভিযোগ। আবারও কেউ কেউ উন্নত চিকিৎসা নিতে চলে যান ভারত, সিঙ্গাপুর ও থাইল্যান্ডসহ উন্নত রাষ্ট্রগুলোতে। এতে দেশের প্রচুর অর্থ চলে যাচ্ছে বিদেশে। এদিকে দেশের চিকিৎসায় পর্যাপ্ত সুযোগ বৃদ্ধির পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের।

তারা বলছেন, কিডনি রোগীদের বড় একটা অংশ চিকিৎসা নিতে দেশের বাইরে চলে যান। এজন্য রোগীদের বিদেশমুখিতা কমাতে নিতে হবে নানান পদক্ষেপ।

তারা জানান, দেশে কিডনি রোগের পুরোপুরি সেবা সম্ভব হলেও নানাবিধ কারণে চিকিৎসার প্রতি রোগীদের বড় একটা অংশের রয়েছে অনাস্থা। এটা কাটাতে ব্যাপকহারে প্রচার-প্রচারণা চালাতে হবে। সেই সঙ্গে দেশের জেলা, উপজেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে কিডনি রোগের চিকিৎসা সেবা চালু করতে হবে।

কিডনি রোগীদের বিদেশমুখিতার কারণ

জানতে চাইলে জাতীয় কিডনি ডিজিজেস অ্যান্ড ইউরোলজি ইনস্টিটিউটের (নিকডু) সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. মিজানুর রহমান মেডিভয়েসকে বলেন, জনগণের মাঝে ব্যাপকভাবে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে যে, দেশে কিডনি রোগের চিকিৎসা পুরোপুরি বিদ্যমান আছে। অনেকেই বিদেশ গিয়ে কিডনি রোগের অপচিকিৎসার শিকার হচ্ছে। সেই সঙ্গে কিডনি ট্যান্সপ্লান্টেশনের নিয়ম আরও শিথিল করতে হবে।

তিনি বলেন, কিডনি ট্যান্সপ্লান্টের বেশির ভাগ রোগী বিদেশ চলে যায়। আর আমাদের দেশে রোগীর ১২ সম্পর্কের আত্মীয় কিডনি দিতে পারে। বিদেশে দূর সম্পর্কের লোক নিয়ে গিয়েও আপন লোক বলে চাচাতো, মামাতো ভাই-বোন ইত্যাদি বানিয়ে কিডনি ট্যান্সপ্লান্ট করে। আর আমাদের দেশে এটা করা যায় না। কিডনি ট্যান্সপ্লান্টের আইন শিথিল করা প্রয়োজন, তাতে রোগীদের বিদেশমুখিতা কমে যাবে।

কিডনি চিকিৎসায় ঘাটতি

স্বাধীনতার ৫০ বছর পার হলেও এখনও জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে কিডনি রোগের চিকিৎসা পাওয়া যায় না। কোনো কোনো বিভাগীয় শহরে পাওয়া গেলেও তা পর্যাপ্ত নয়।

বিশেষজ্ঞদের তথ্য অনুযায়ী, সরকারি হাসপাতালে যে পরিমাণে শয্যাসহ সুযোগ-সুবিধা থাকা প্রয়োজন, তা নেই। কিডনি রোগের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদেরকে আরও প্রশিক্ষণ দিতে হবে। যেসব হাসপাতালে কিডনির চিকিৎসা দেওয়া হয়, সেসব হাসপাতালে নেই অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি ও সুযোগ-সুবিধা। উপজেলা এবং জেলা পর্যায়ে এখনও কিডনি রোগের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নেই। বিভাগীয় পর্যায়ে পাওয়া গেলেও তা পর্যাপ্ত নয় এবং তাতে রোগীরা সন্তুষ্ট না। জেলা, উপজেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে কিডনি চিকিৎসায় পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি জোর দাবি বিশেষজ্ঞদের।

বিশেষজ্ঞ থাকলেও কাজের পরিধি কম

অধ্যাপক ডা. মিজানুর রহমান বলেন, দেশে কিডনি রোগের পর্যাপ্ত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক থাকলেও কাজ করার তেমন সুযোগ নেই। তাদের জন্য পদ সৃষ্টি করা হয় না দীর্ঘ সময় ধরে। পেরিফেরির কোনো মেডিকেল কলেজে নেই ইউরোলজি-নেফ্রোলজির পদ ও ইউনিট। পুরাতন মেডিকেল কলেজ ছাড়া কোনো মেডিকেলে কিডনির বিশেষজ্ঞের পদ নেই। সেই সঙ্গে কাজের জন্য যেসব অর্গানুগ্রাম দরকার, তা সঠিকভাবে করা হয় না। যে পরিমাণে পদ সৃষ্টি করা প্রয়োজন, তা করা হয় না। এগুলো আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় আটকে আছে।

তিনি আরও বলেন, প্রতিটি জেলা পর্যায়ের হাসপাতালে ও সরকারি মেডিকেল কলেজে কিডনি বিভাগ ও ইউনিট চালু করতে হবে। কিডনি বিভাগের অধ্যাপক, সহযোগী ও সহকারী অধ্যাপকসহ পর্যাপ্ত পদ সৃষ্টি করলে কিডনি চিকিৎসার পরিধি বেড়ে যাবে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ইউরোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. কার্তিক চন্দ্র ঘোষের মতে, কিডনি রোগের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক সংখ্যা এখনও অপ্রতুল, জনসংখ্যার তুলনায় যে পরিমাণ বিশেষজ্ঞ দরকার তা নেই। তবে প্রতি বছরই কিডনি বিশেষজ্ঞ তৈরি হচ্ছে। নিকট ভবিষ্যেতে এ সংখ্যাটা বেড়ে যাবে, এতে কিডনি চিকিৎসকের অভাব অনেকটা পূরণ হবে।

কিডনি চিকিৎসায় বরাদ্দ বাড়াতে হবে

কিডনি ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী, ‘বাংলাদেশের প্রায় ১৭ শতাংশ মানুষ দীর্ঘমেয়াদি কিডনি রোগে আক্রান্ত। ২০২০ সালে ১৮ হাজার ৯০০ জন রোগী নিয়মিত ডায়ালাইসিস নিচ্ছিলেন। প্রতি বছর এর সঙ্গে ১ হাজার নতুন রোগী যোগ হয়। এ সংখ্যা মোট আক্রান্তের ২০ থেকে ২৫ শতাংশ। এ ছাড়া বাকি কিডনি রোগে আক্রান্ত ৭৫ থেকে ৮০ শতাংশ মানুষ ডায়ালাইসিস নিতে পারেন না। তার মানে নিশ্চিত মৃত্যু। বাংলাদেশে এত মানুষকে ডায়ালাইসিস সেবা দেওয়া সম্ভবও না। সবাইকে এ সেবার আওতায় নিতে স্বাস্থ্যসেবায় আরও ৫ গুণ বেশি বাজেট প্রয়োজন হবে।’

৫ হাজারের জায়গায় দুইশ’ ট্রান্সপ্লান্ট

দেশে কিডনি রোগে ভুগছেন অন্তত দুই কোটি মানুষ। প্রতি বছর আরও ৪০ হাজার মানুষের কিডনি পুরোপুরি বিকল হয়ে পড়ছে। এসব রোগীর মধ্যে সর্বসাকুল্যে ২০ শতাংশ চিকিৎসার আওতায় এলেও ৮০ শতাংশই বাইরে থাকছে।

স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, প্রতি বছর কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট হওয়ার প্রয়োজন ৫ হাজার, সেখানে মাত্র ২০০ জনের হচ্ছে। কিডনি চিকিৎসার আরও উন্নতি হওয়া দরকার, যেখানে কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট হওয়ার প্রয়োজন ৫ হাজার, সেখানে মাত্র ২০০ জনের হচ্ছে। যেসব হাসপাতালে কিডনি বিভাগ নেই, সেখানে কিডনি বিভাগ চালুর কথা জানিয়েছে মন্ত্রণালয়।

কিডনি রোগের ও প্রতিকার 

অস্বাস্থ্যকর জীবন যাপনের ফলে অধিকাংশ মানুষের কিডনি রোগ হয় বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, সিগারেট, মাদক, অনিয়মিত খাদ্যাভ্যাস, অস্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণ ইত্যাদির কারণে সাধারণত কিডনি রোগ হতে পারে।

বিএসএমএমইউর প্রক্টর ও কিডনি রোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. হাবিবুর রহমান দুলাল মেডিভয়েসকে বলেন, কিডনির দুই ধরনের সমস্যা নিয়ে রোগীরা আসেন। একটা হলো ইউরোলজিক্যাল, আরেকটা হলো নেফ্রোলজিক্যাল। নেফ্রোলজিক্যাল হলো কিডনি ফেইলিয়র বা দুর্বলতা, খাবার অরুচি, হাইপারটেনশন ও পেটে পানি জমা। ইউরোলজিক্যাল যেটা প্রস্রাবের সাথে রক্ত ঝরে, প্রস্রাব আটকে যায়, পেটে ব্যথা হয়, কিডনিতে পাথর জমে।

এ প্রসঙ্গে ডা. কার্তিক ঘোষ বলেন, কিডনি রোগীরা অনেক সময় প্রাথমিক পর্যায়ে বুঝতে পারেন না। যখন শরীর খুব দুর্বল হয়ে যায় বা হিমোগ্লোবিন কমে যায়, তখন রোগীরা বুঝতে পারেন। তখনই তারা চিকিৎসকের কাছে যান, কিডনি রোগটি ধরা পড়ে। রোগীরা আগে থেকে সচেতন হলে রোগটি প্রতিরোধ করা যায়। নিয়মিত ডায়াবেটিস, ব্লাড প্রেশার পরীক্ষা করলে অনেকটা উপকার পাওয়া যায়।

দেশে কিডনিতে পাথর বেশি হয়

অধ্যাপক ডা. হাবিবুর রহমান বলেন, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, ব্লাড প্রেশারের কারণে কিডনিতে সমস্যা দেখা দেয়। এ ছাড়া বাংলাদেশে রোগীদের কিডনিতে পাথর বেশি হয়, ফলে নষ্ট হয়ে যায় কিডনি এবং কমে যায় কার্যক্ষমতা। সামাজিক অবক্ষয়ের যুগে অস্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণের কারণে অনেকেই কিডনি জটিলতায় ভোগেন। সিগারেট, তামাক, মাদক কিডনির উপর ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

বেদনানাশক ওষুধ যত্রতত্র পাওয়া যায় উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, এগুলো মানুষ অবাধে সেবন করেন। এ ছাড়া কিডনি রোগ প্রতিরোধে অ্যান্টিবায়োটিকের যথেচ্চ ব্যবহার কমাতে হবে। যে কেউ অ্যান্টিবায়োটিক লিখতে পারবে না। ওষুধ আইনের পুরোপুরি প্রয়োগ করতে হবে। আর রেজিস্ট্রার্ড চিকিৎসকের প্রেক্রিপশন ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি করলে ২৫ হাজার টাকা জরিমানার বিধান বাস্তবায়ন করতে হবে।

বিএসএমএমইউর প্রক্টর বলেন, কিডনি দুটি বিকল হলে কারও কারও সপ্তাহে দুই-তিন ডায়ালাইসিস করতে হয় বা কিডনি ট্যান্সপ্লান্টেশন করতে হয়। আর ডায়ালাইসিস খুবই ব্যয়বহুল চিকিৎসা, ব্যাপক সময় নষ্ট হয়, কর্মক্ষমতা শেষ হয়ে যায়। এ ছাড়া ডায়ালাইসিস সেবায়ও রয়েছে অপ্রতুলতা। প্রতিটি জেলা সদরেও নেই ডায়ালাইসিস সেন্টার। এজন্য কিডনি রোগীদের অনেক দুর্ভোগ পোহাতে হয়।

মেডিভয়েসের জনপ্রিয় ভিডিও কন্টেন্টগুলো দেখতে সাবস্ক্রাইব করুন MedivoiceBD ইউটিউব চ্যানেল। আপনার মতামত/লেখা পাঠান [email protected] এ।
  এই বিভাগের সর্বাধিক পঠিত
এক দিনে চিরবিদায় পাঁচ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক
করোনা ও বার্ধক্যজনিত অসুস্থতা

এক দিনে চিরবিদায় পাঁচ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক