সাহিত্য চর্চায় সুযোগের জন্য সাবজেক্ট পরিবর্তন করি
পরিমার্জন-পরিবর্ধনে শুদ্ধতম সাহিত্যই কবিতা: ডা. হারিসুল হক

সাহিত্য চর্চার জন্য চিকিৎসা পেশায় ইনটারভেনশনাল কার্ডিওলজির পরিবর্তে নন ইনটারভেনশনাল কার্ডিওলজি বেছে নেন অধ্যাপক ডা. হারিসুল হক। এর সুবাদে ব্যস্ততা কমিয়ে সাহিত্যের সৃজনশীল কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত করার সুযোগ সৃষ্টিতে সক্ষম হন তিনি। চিকিৎসা প্রদানের পাশাপাশি বেশ কয়েকটি কাব্যগ্রন্থ লেখেন তিনি। তার রচিত বইয়ের সংখ্যা ২৮টি। তারই ধারাবাহিকতায় এবারের অমর একুশে বইমেলায় বেরিয়েছে ‘সময়ের বিশিষ্ট পেরেক’।
সাহিত্য চর্চায় হাতেখড়ি
মেঘনার পাড়ে বেড়ে ওঠা বাবা-মায়ের একমাত্র ছেলে ডা. হারিসুল হকের সাহিত্য চর্চায় হাতেখড়ি শৈশবে, গ্রামের স্কুল শিক্ষকদের কাছ থেকে।
সাহিত্য চর্চার সূচনার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘স্কুলে ভর্তির পর বাবা শিক্ষকদের বলেছিলেন, আমার ছেলের খেলা-ধুলার দরকার নেই। হাত-পা ভাঙবে। ও শুধু পড়াশোনার মধ্যে থাকবে। ফলে শিক্ষকরা পড়াশোনা করতে হবে, মাঠে যাওয়া যাবে না—এমন নিয়ম জারি করে দেন। জাতীয় সংগীতের সময় ছাড়া অন্য সময় মাঠে যেতাম না। শিক্ষকরা আমাকে লাইব্রেরিতে নিয়ে বললো, এখানে অনেক বই আছে, তুমি পড়বা। সেখানে শিশুদের ও বড়দের বই ছিল। যখন সুযোগ পেতাম, তখনই লাইব্রেরিতে বসে পা দুলে দুলে পড়তাম। স্কুল ছুটি হলেও আমি বাসায় যেতাম না। কারণ বড় দুই বোন একই স্কুলে পড়তেন। তারা স্কুল থেকে যাওয়ার সময় আমাকে নিয়ে যেতেন।’
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন স্কুল বন্ধ থাকায় বাড়িতে বসে বাবা-দাদার সংগৃহীত বই পড়তাম। স্বাধীনতার পর স্কুলে গেলে শিক্ষকরা বলতেন, এটার ওপর লিখ, ওটার ওপর লিখ। এ রকম করতে করতে তারা আমাকে লেখক বানিয়ে দিলেন। বলা চলে, লেখালেখি দিয়ে আমার জীবন শুরু।
তিনি বলেন, ‘বাংলা একাডেমিতে একটি প্রোগ্রামে একজন শ্রোতা প্রশ্ন করেছেন, আপনি কেন লেখক হলেন? আমি বললাম, গত্যন্তর ছিল না। হয়ে গেছি এবং থেকে গেছি, এখন ভালো লাগে।
‘সময়ের বিশিষ্ট পেরেক’ সম্পর্কে লেখক বলেন, পেরেক একটি অপ্রাণিবাচক জিনিস। আমি সেটিকে প্রাণ দিয়েছি। পেরেক ঠুকে দিলাম, আমি শেষ করে দিলাম। পেরেক ঠুকে দিলাম, শাস্তি দিলাম। পেরেক ঠুকে দিলাম, একজনকে লাঞ্ছিত করলাম। যেমন-৭ মার্চ নিয়ে কোনো কথা নেই। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন, এটি আমার স্বকর্ণে শোনা। এখানে ৭ মার্চ নিয়ে কবিতা আছে, জীবন ঘনিষ্ঠ কবিতা আছে, রাজনীতির কবিতা আছে।
এ কার্ডিওলজিস্টের এ পর্যন্ত ২৪টি কাব্যগ্রন্থ, ৩টি গদ্য ও মেডিকেলের একটি টেক্সট নিয়ে জার্মান থেকে একটি বই বের হয়েছে। এ ছাড়া নির্বাচিত ও নতুন কাব্যগ্রন্থ বের হয়েছে তাঁর। তাঁর রচিত দুই-একটি বইয়ের নাম শুনে একটু ভাল লাগা কাজ করবে পাঠকের মনে। যেমন: ‘তিরোহিত স্বপ্নের চাদর’ ও ‘আরাধ্য কষ্টের মহিমা’।
কীভাবে সমন্বয় করেন
এমন প্রশ্নের জবাবে অধ্যাপক হারিসুল হক বলেন, ‘বলাই চাঁদ মুখোপাধ্যায় একজন ডাক্তার ছিলেন। তিনি যখন লেখালেখির সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর ভাবলেন, ব্যস্ততা কমাতে হবে। এজন্য প্যথলোজি নিলেন, যাতে একটি নিজস্ব সময় থাবে। পরবর্তীতে তিনি মোটা মোটা বলিউম লিখে গেছেন। আমিও এ উপায় বের করলাম। কার্ডিওলজির দুইটি দিক আছে। একটি হলো ইনটারভেনশনাল কার্ডিওলজি, অন্যটি হলো নন ইনটারভেনশনাল কার্ডিওলজি। ক্লিনিক্যাল কার্ডিওলজির দায়-দায়িত্ব একটু কম থাকে। যেমন-আমার রিং বসাতে হয় না। আগে বসাতাম। সময় বের করে এভাবে সাহিত্য চালাচ্ছি।’
সাহিত্য প্রকাশের কৌশল
তিনি বলেন, সাহিত্যের ব্যাপারটা একেকজন একেকভাবে দেখতে পারেন। মূল সাহিত্যটা অন্য জায়গায়। সাহিত্য হলো একটা দর্শন। এ দর্শনটাকে আপনি কিভাবে ফোটাবেন, সেটি অনেক কিছুর ওপর নির্ভর করে। যেমন-একটি বাগানে অনেক রকম ফুল থাকতে পারে। সব ফুলকে ফুটতে দিতে হবে। কেউ ছবি আঁকার মাধ্যমে, কেউ গান-কবিতার মাধ্যমে, কেউ হয় তো উপন্যাস, কেউ হয় তো গল্পের মাধ্যমে চিত্রটি ফোটাতে পারেন।
প্রবন্ধকে সাহিত্যের নিরস শাখা হিসেবে ইঙ্গিত করে তিনি আরও বলেন, আমি মজা করে একটি কথাটি বলি, যারা সবগুলোতে ব্যর্থ হয়ে যান, তারা প্রবন্ধ লিখেন। আরও অনেকে এ কথা বলেন। সাহিত্য হলো সার্বক্ষণিক ও চলমান প্রক্রিয়া। এটি ভিতর থেকে জেগে উঠবে। এটি হলো সৃষ্টিশীল ব্যাপার।
সাহিত্য রচনায় নিজের সমৃদ্ধ উৎসের কথা জানিয়ে কবি হারিসুল হক বলেন, ‘আমার তো গল্পের বিশাল ভাণ্ডার রয়েছে। যেমন: রোগীরা এসে পয়সা দিয়ে অভিনব কথা বলে যায়।’
বিপরীতে অন্যান্য কবি-সাহিত্যিকদের রসদ জোগানোর ধকলের কথাও তুলে ধরেন তিনি। বলেন, ‘তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম সবাই জানেন। তিনি খুব ভালো উপন্যাসিক ও গীতিকার। তিনি অফিস সময় শেষে দৌড়ে চলে যেতেন গঙ্গার ঘাটে। সেখানে গিয়ে গরিব, দিন মজুদের বসাইয়া চা-মুড়ি খাওয়াতেন এবং গল্প শুনতেন। কারণ গল্প না হলে উপন্যাস কি করে হবে? আর আমি চেম্বারে বসে রোগীকে সময় দিই। গল্প বিনা পয়সায় গল্প শুনি। কোনো জটিলতা নেই? বলা চলে আমার এখানে গল্প এসে হাজির হয়।’
‘সাহিত্য আবোল-তাবোল লেখার জায়গা নয়। সাহিত্য খুব কঠিন ও খাটনির জিনিস। একটি মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে আমাকে প্রশ্ন করা হলো, সবাই কেনো কবিতা লিখেন? আমি বললাম, বাবা-মা, দাদা-দাদি, নানা-নানী ও ফুফু সবাই ছড়া পড়ে পড়ে শিশুদের ঘুম পাড়াতেন। ওই সুর ও ছন্দের পথ ধরেই একটি শিশু বড় হয়। তাই ভাবে যে, আমি ছন্দ দিয়ে কিছু লেখি। ওই লিখার মাধ্যমে সে পদ্যকার হয়ে যায়। কবিতা লেখার চেষ্টা করে, হয় তো কবি হতে পারে না’, যোগ করেন অধ্যাপক ডা. হারিসুল হক।
সর্বশেষ লেখক বলেন, ‘কত দাম দিবেন, একটি কবিতা ত্রিশ বছর ধরে লেখেছি। এমন ঘটনা আছে যে, তিনটা লাইন লিখে, সে লাইনের একটি শব্দও আমি পরিবর্তন করতে পারেনি। যুগোপযোগী করতে পারিনি। আমার নির্বাচিতের কাজ চলছে। পুরনো লেখা দেখে আমি অবাক হয়ে যাই, এগুলো আমার লিখা! কি আশ্চর্য! কে লিখলো? আমি যখন খুব কঠিন সম্পাদক হিসেবে দেখলাম, ভাবলাম, আমি কি করে এটি লিখলাম। এটির মানে কি, বাজে লেখাও আমি লিখেছি। পরিমার্জন আর পরিবর্ধন করতে করতে শুদ্ধতম একটা পর্যায়ে না আসলে কবিতা হয় না। কবিতা লেখা সাধনার ব্যাপার। গল্প, সেখানে গল্প থাকতে হবে। যা ইচ্ছে লিখলাম, সেটা ডায়েরি হবে।’
বেড়ে ওঠার গল্প
তিরোহিত স্বপ্নের চাদর, ছায়ামাছ, দ্বিতীয় সাঁতার, এখন আমার সময় আমিই শাসাব—ব্যতিক্রমী ও বৈচিত্রময় এ রকম বইয়ের লেখক ডা. হারিসুল হকের জন্ম ১৯৬২ সালে, কিশোরগঞ্জের ভৈরব উপজেলায় মেঘনা নদীর পাড়ে।
তিনি ভৈরব থেকে ১৯৭৬ সালে এসএসসি ও ১৯৭৮ সালে এইচএসসি পাস করেন। পরবর্তীতে ১৯৭৯ চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ভর্তি হন। ১৯৮৪ সালে সফলতার সঙ্গে এমবিবিএস ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি। বর্তমানে তিনি বঙ্গবন্ধু শেখমুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ক্লিনিক্যাল কার্ডিওলজির বিভাগীয় প্রধান হিসেবে কর্মরত আছেন।
এএইচ/এমইউ
-
২৮ ফেব্রুয়ারী, ২০২৩
সাহিত্য চর্চায় সুযোগের জন্য সাবজেক্ট পরিবর্তন করি
পরিমার্জন-পরিবর্ধনে শুদ্ধতম সাহিত্যই কবিতা: ডা. হারিসুল হক
-
১২ ফেব্রুয়ারী, ২০২৩
-
০৪ ফেব্রুয়ারী, ২০২৩
-
২৮ জানুয়ারী, ২০২৩
আসছে নতুন কাব্যগ্রন্থ
সাহিত্য চর্চায় আনন্দ খুঁজে পাই: অধ্যাপক মোশাররফ হোসেন
-
২২ জানুয়ারী, ২০২৩
-
১৫ মার্চ, ২০২২
-
১০ মার্চ, ২০২২
-
০৬ মার্চ, ২০২২
-
০৫ মার্চ, ২০২২
-
২৮ ফেব্রুয়ারী, ২০২২