অধ্যাপক ডা. এটিএম আতিকুর রহমান

অধ্যাপক ডা. এটিএম আতিকুর রহমান

চেয়ারম্যান, শিশু হেমাটোলজি অ্যান্ড অনকোলজি বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়


১৫ ফেব্রুয়ারী, ২০২৩ ০৬:১২ পিএম

শিশুদের ক্যান্সার কেন হয় এবং রোধে করণীয়

শিশুদের ক্যান্সার কেন হয় এবং রোধে করণীয়
ক্যান্সারের চিকিৎসায় অর্থনৈতিক প্রতিবন্ধকতা বড় নয়, সঠিক সময়ে চিকিৎসা নিতে না পারা হলো অন্যতম সমস্যা।

শিশুদের ক্যান্সার বা চাইল্ডহুড ক্যান্সার বলতে ১৮ বছরের কম বয়সীদের ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়াকে বোঝায়। কিছু ক্যান্সার রয়েছে যা শুধু শিশুদেরই হয়। যেমন-নিউরোব্লাস্টোমা, নেফ্রোব্লাস্টোমা, মেডুলোব্লাস্টোমা, এবং রেটিনোব্লাস্টোমা। কিডনি, মস্তিষ্ক ও রক্তের কিছু ক্যান্সার শিশুদের বেশি হয়। ক্যান্সার আক্রান্ত শিশুদের মধ্যে এক-তৃতীয়াংশই লিউকেমিয়া বা রক্তের ক্যান্সারে আক্রান্ত। এ ছাড়া আরো যে ধরণের ক্যান্সার হয় সেগুলো হচ্ছে, লিম্ফোমাস ও কেন্দ্রীয় স্নায়ু ব্যবস্থায় বিভিন্ন ধরণের টিউমার। 

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, প্রতিবছর বিশ্বে অন্তত তিন লাখ শিশু ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়। এদের মধ্যে ৭০-৮০% শিশুকেই চিকিৎসার মাধ্যমে সুস্থ করে তোলা সম্ভব। তবে চিকিৎসা না পেয়ে নিম্ন আয়ের দেশগুলোতে ৯০ ভাগ ক্যান্সার আক্রান্ত শিশুই মারা যায়। 

ব্লাড ক্যান্সার বা অন্যান্য ক্যান্সারে আক্রান্ত শিশুদেরকে চিকিৎসার মাধ্যমে পরিপূর্ণ সুস্থ করে তোলা সম্ভব। শিশুদের শরীরে ক্যান্সারের লক্ষণ প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে এবং নির্দেশনা মেনে চলতে হবে।

শিশুদের ক্যান্সার কেন হয়

শিশুদের বেশির ভাগ ক্যান্সার হয় অজ্ঞাত কারণে। তা ছাড়া পারিপার্শ্বিক প্রভাবেও এই রোগটি হতে পারে। খাবারে ক্যামিকেল, ভাইরাস, জেনেটিক, বংশ পরস্পরায়সহ নানা কারণে হয়ে থাকে। বাবা-মা ধুমপায়ী হলে শিশুর ক্যান্সার হওয়ার আশঙ্কা বেশি। তা ছাড়া বিরূপ প্রাকৃতিক পরিবেশ, গর্ভকালে মায়ের ভুল খাদ্যাভ্যাস, শিশুর অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, হেপাটাইটিস বি, হিউম্যান হার্পিস এবং এইচআইভি ভাইরাসও শিশুদের ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ায়।

শিশুদের ব্লাড ক্যান্সার, দু’ভাবে বিভক্ত। একটি হলো একিউ লিম্ব ব্লাস্টিক লিকিউমিয়া, আরেকটি মায়লো ব্লাস্টিক লিকিউমিয়া। বড়দের মতো শিশুদেরও টিউমার হতে পারে। যেমন- ব্রেন টিউমার, কিডনি টিউমার, নিউরো ব্লাস্টোমা ও লিভারের টিউমার ইত্যাদি। শিশুদের ব্লাড ক্যান্সারের আরেকটি ধরন আছে, সেটাকে লিম্ফোমা বলে। অর্থাৎ শিশুদের সব ধরনেরই ক্যান্সার হতে পারে স্থানে ভেদে নামটা ভিন্ন ভিন্ন হয়।

উপসর্গ

শিশুর ক্যান্সার লক্ষণ বুঝা যায় ধরনের উপর ভিত্তি করে। যেসব উপসর্গ দেখা দিতে পারে-

১. শিশুর রক্তশূন্যতা দেখা দিবে। 
২. দাঁতের গোড়া, চোখ ও শরীরের বিভিন্ন অংশে রক্তের দাগ দেখা দিবে। 
৩. জ্বর আসবে এবং বিভিন্ন সংক্রমণ দেখা দিবে। 

এগুলো হলো ক্যান্সারের প্রাথমিক লক্ষণ। দুই থেকে দশ বছরের মধ্যে শিশুদের ব্লাড ক্যান্সার বেশি হয়। অন্যান্য ক্যান্সারগুলোও সাধারণত দুই থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে হয়ে থাকে।

প্রতিরোধে করণীয়

শিশুদের ক্যান্সার নিরাময় যোগ্য। খাবার ও পরিবেশের উন্নয়ন করতে হবে। খাবারের মধ্যে যে কোন প্রকার ক্যামিকেল-আর্সেনিক বা ভেজাল মিশানো বন্ধ করতে হবে। পরিবেশও শিশুদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এজন্য ধূমপান, অতিরিক্ত হর্ণ বাজানো, বায়ু দূষণ এগুলো থেকে শিশুদেরকে দূরে রাখতে হবে। অনেক সময় শিশুর বাবা-মা ধূমপানে আসক্ত থাকেন, তাতেও শিশুরা ক্যান্সারে আক্রান্ত হতে পারে। ধূমপান শুধু  ধূমপায়ী ব্যক্তিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে এমন নয়, আশপাশের মানুষেরও তারা ক্ষতিগ্রস্ত করেন। 

চিকিৎসা

শিশুদের ক্যান্সারগুলোর চিকিৎসা বাংলাদেশে পরিপূর্ণভাবে বিদ্যমান রয়েছে। এই চিকিৎসার মান আন্তর্জাতিক মানের। এখানের যেসব  প্রোটোকল বা নিয়ম-নীতি অনুসরণ করা হয়, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও তা করা হয়ে থাকে। রাজধানীর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিশু হেমাটোলজি অ্যান্ড অনকোলজি বিভাগের শিশুদের ক্যান্সারের সকল চিকিৎসা রয়েছে। এ ছাড়া দেশের বড় বড় মেডিকেলে এই চিকিৎসার বিভাগ এবং প্রশিক্ষিত জনবল রয়েছে। শিশুদের ক্যান্সারের চিকিৎসার জন্য বিদেশ যাওয়ার কোন দরকার নেই। শত করা ৭০-৯০ শতাংশ রোগী সম্পূর্ণ ভালো হয়ে যায়। বিএসএমএমইউর শিশু অনকোলজি বিভাগে শেখ রাসেল চাইল্ড হুড অ্যান্ড সার্ভে কেয়ার গ্যালারি রয়েছে। এই বিভাগের গ্যালারি দেখে অনেকে অনুপ্রাণিত হচ্ছে।

১৯৯৩ সালে এদেশে শিশু ক্যান্সারের চিকিৎসা শুরু হয়। এ পর্যন্ত প্রায় দশ হাজার ক্যান্সার আক্রান্ত শিশু সুস্থ হয়ে কাজ বাসায় ফিরেছে এবং সুস্থ স্বাভাবিক জীবন যাপন করছে, কাজকর্ম ঠিকঠাক মতো করতে পারছে। ক্যান্সার জয়ী অনেক শিশু ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়রও হয়েছে। কাজেই দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা ও চিকিৎসকদের প্রতি সবার আস্থা রাখতে হবে এবং লেগে থাকতে হবে। 

ব্যয়

শিশু ক্যান্সারের ওষুধগুলো কিছুটা ব্যয়বহুল। তবে দুই থেকে তিন বছর চিকিৎসা নিতে হয়। এতে দুই থেকে তিন লাখ টাকা খরচ হতে পারে। এরমধ্যে অনেকগুলোর ওষুধ সরকার ভুর্তকি দিচ্ছে।

আক্রান্তের পরিসংখ্যান

শিশু ক্যান্সার আক্রান্তদের পরিসংখ্যানে কেন্দ্রীয়ভাবে তেমন তথ্য পাওয়া যায় না। তবে প্রতিষ্ঠানিক হিসাব মতে, প্রতি বছরে প্রায় ছয় থেকে আট হাজার শিশু নতুন করে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়। দেশের বেশির ভাগ শিশু চিকিৎসা না নিয়ে মৃত্যুবরণ করে। যারা চিকিৎসা নেন তাদের মধ্যে ৭০-৮০ ভাগ রোগী ভালো হয়। বাকি যারা থাকে, তারা ক্যান্সারসহ বিভিন্ন জটিলতা নিয়ে মারা যায়।

শহরের শিশুরা ক্যান্সার আক্রান্ত হয় বেশি

এটা নিয়ে বাংলাদেশে বৈজ্ঞানিকভাবে কোনো গবেষণা বা পরিসংখ্যা করা হয়নি। তবে চিকিৎসকদের ধারণা, শহরের শিশুরা ক্যান্সারের আক্রান্ত বেশি। যেহেতু শহরে পলিউশন বেশি, কাজেই এই রোগ শহরে বেশি। শহরের ভালো দিক হলো ক্যান্সারের বিভিন্ন পরীক্ষা তাড়াতাড়ি করা যায়, রোগ নির্ণয় সহজ হয়।

চিকিৎসায় প্রতিবন্ধকতা

ক্যান্সারের চিকিৎসায় অর্থনৈতিক প্রতিবন্ধকতা বড় নয়, সঠিক সময়ে চিকিৎসা নিতে না পারা হলো অন্যতম সমস্যা। শিশু ক্যান্সারের চিকিৎসায় চিকিৎসকরা এখনও আস্থা অর্জন করতে পারেনি। সচেতনতা ও প্রচার-প্রচারণার অনেক ঘাটতি রয়েছে। আমরা যে স্মার্ট বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখি, দেশের চিকিৎসকরা আস্থা অর্জন করতে পারলে সে লক্ষে পোঁছা যাবে।

মেডিভয়েসের জনপ্রিয় ভিডিও কন্টেন্টগুলো দেখতে সাবস্ক্রাইব করুন MedivoiceBD ইউটিউব চ্যানেল। আপনার মতামত/লেখা পাঠান [email protected] এ।
  ঘটনা প্রবাহ : শিশু ক্যান্সার
কমিউনিটি ক্লিনিকের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির অনুষ্ঠানে ডা. মোদাচ্ছের

কমিউনিটি ক্লিনিক: বঙ্গবন্ধুর দর্শনই প্রধানমন্ত্রীর হাতে বাস্তবায়ন

কমিউনিটি ক্লিনিকের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির অনুষ্ঠানে ডা. মোদাচ্ছের

কমিউনিটি ক্লিনিক: বঙ্গবন্ধুর দর্শনই প্রধানমন্ত্রীর হাতে বাস্তবায়ন

  এই বিভাগের সর্বাধিক পঠিত
এক দিনে চিরবিদায় পাঁচ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক
করোনা ও বার্ধক্যজনিত অসুস্থতা

এক দিনে চিরবিদায় পাঁচ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক