১৫ ফেব্রুয়ারী, ২০২৩ ০২:০৬ পিএম
ক্যান্সার আক্রান্ত শিশু আদিবের মায়ের অসহায়ত্ব

‘ছেলেকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন ছিল, এখন খুবই দুশ্চিন্তা হয়’

‘ছেলেকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন ছিল, এখন খুবই দুশ্চিন্তা হয়’
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্বডিদ্যালয়ে শিশু ক্যান্সার ইউনিটে চিকিৎসাধীন আদিব ইসলাম। ছবি: সাঈদ

সাখাওয়াত হোসাইন: দশ বছরের শিশু আদিব ইসলাম। সম্প্রতি তার শরীরে ধরা পড়েছে মরণব্যধি ব্লাড ক্যান্সার। চিকিৎসার জন্য তাকে গ্রামের বাড়ি কুমিল্লা থেকে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) নিয়ে আসেন মা মৌসুমি। হাসপাতালের শয্যায় আদিবের পাশে বসে থাকা মায়ের সঙ্গে কথা হয় মেডিভয়েসের। তিনি জানান, জন্মের পর থেকে অন্যান্য শিশুদের মতো সব কিছুই স্বাভাবিক ছিল, কিন্তু হঠাৎ এক দিন মুখের তার মুখের মধ্যে রক্ত জমাট বাধা দেখা যায়। পরে প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাওয়া হলে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে চিকিৎসক জানান আদিব ব্লাড ক্যান্সার আক্রান্ত।

জানতে চাইলে মৌসুমি ইসলাম বলেন, আদিবকে নিয়ে অনেক কষ্ট হচ্ছে, যা বলার মতো নয়। পরীক্ষা-নিরীক্ষায় একটা রিপোর্ট ভালো আসলে, আরেকটা খারাপ আসে। এভাবেই হাসপাতালে দিন কাটছে। চিকিৎসকরা আশ্বাস দিয়েছেন, সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা আছে। তবে কত দিনে সুস্থ হবে বা সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা কতটুকু, তা বলেননি।

তিনি বলেন, জন্মের পর থেকে আবিদ অন্য পাঁচ-দশটা শিশুর মতোই চলাফেরা করতো এবং মেধা বিকাশ খুবই ভালো ছিল। ছেলেকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন ছিল। নিয়মিত স্কুলে যেত। হঠাৎ এ রোগে আক্রান্ত হবে কখনও ভাবেনি। এখন আমার খুবই দুশ্চিন্তা হয়, কখন কি হয়ে যায়? কথাগুলো বলতে বলতে কণ্ঠ ভারী হয়ে আসে মৌসুমির।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, প্রতিবছর বিশ্বে অন্তত তিন লাখ শিশু ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়। এদের মধ্যে ৭০-৮০% শিশুকেই চিকিৎসার মাধ্যমে সুস্থ করে তোলা সম্ভব। তবে চিকিৎসা না পেয়ে নিম্ন আয়ের দেশগুলোতে ৯০ ভাগ ক্যান্সার আক্রান্ত শিশুই মারা যায়। 

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, ব্লাড ক্যান্সার বা অন্যান্য ক্যান্সারে আক্রান্ত শিশুদেরকে চিকিৎসার মাধ্যমে পরিপূর্ণ সুস্থ করে তোলা সম্ভব। শিশুদের শরীরে ক্যান্সারের লক্ষণ প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে এবং নির্দেশনা মেনে চলতে হবে।

শিশু ক্যান্সার চিকিৎসায় যা বলছেন বিশেষজ্ঞরা

জানতে চাইলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) শিশু হেমাটোলজি অ্যান্ড অনকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. এটিএম আতিকুর রহমান মেডিভয়েসকে বলেন, শিশুদের ক্যান্সার চিকিৎসা বাংলাদেশে পরিপূর্ণভাবে বিদ্যমান রয়েছে, এবং এই চিকিৎসা আন্তর্জাতিক মানের। দেশে যেসব প্রোটোকল বা নিয়ম-নীতি অনুসরণ করা হয়, বৈশ্বিক পরিমণ্ডলেও তা করা হয়ে থাকে। শিশুদের ক্যান্সারের চিকিৎসার জন্য বিদেশ যাওয়ার কোন দরকার নেই। শত করা ৭০-৮০ শতাংশ রোগী সম্পূর্ণ ভালো হয়ে যায়।

তিনি বলেন, বিএসএমএমইউ’র শিশু হেমাটোলজি অ্যান্ড অনকোলজি বিভাগে শিশুদের ক্যান্সারের সকল চিকিৎসা রয়েছে। দেশের বড় বড় মেডিকেলে এই চিকিৎসার জন্য আলাদা বিভাগ এবং প্রশিক্ষিত জনবল রয়েছে। বিএসএমএমইউর শিশু অনকোলজি বিভাগে শেখ রাসেল চাইল্ড হুড অ্যান্ড সার্ভে কেয়ার গ্যালারি রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের এই বিভাগের গ্যালারি দেখে অনেকে অনুপ্রাণিত হচ্ছে। এখান থেকে অনেকে শিশু সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরেছে। প্রাথমিকভাবে এ রোগ শনাক্ত করা গেলে বেশিরভাগ শিশুরই সুস্থ হওয়ার সম্ভবনা রয়েছে। শিশুদের ক্যান্সার মোকাবিলায় সবার আগে সচেতনতা বাড়াতে হবে। 

শিশুদের যেসব ক্যান্সার হয়

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, শিশুদের ক্যান্সার বা চাইল্ডহুড ক্যান্সার বলতে ১৮ বছরের কম বয়সীদের ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়াকে বোঝায়। কিছু ক্যান্সার রয়েছে যা শুধু শিশুদেরই হয়। যেমন-নিউরোব্লাস্টোমা, নেফ্রোব্লাস্টোমা, মেডুলোব্লাস্টোমা, এবং রেটিনোব্লাস্টোমা। কিডনি, মস্তিষ্ক ও রক্তের কিছু ক্যান্সার শিশুদের বেশি হয়। ক্যান্সার আক্রান্ত শিশুদের মধ্যে এক-তৃতীয়াংশই লিউকেমিয়া বা রক্তের ক্যান্সারে আক্রান্ত। এ ছাড়া আরো যে ধরণের ক্যান্সার হয় সেগুলো হচ্ছে, লিম্ফোমাস ও কেন্দ্রীয় স্নায়ু ব্যবস্থায় বিভিন্ন ধরণের টিউমার। 

শিশুদের ক্যান্সার কেন হয়

চিকিৎসকদের মতে, শিশুদের বেশির ভাগ ক্যান্সার হয় অজ্ঞাত কারণে। তা ছাড়া পারিপার্শ্বিক প্রভাবেও এই রোগটি হতে পারে। খাবারে ক্যামিকেল, ভাইরাস, জেনেটিক, বংশ পরস্পরায়সহ নানা কারণে হয়ে থাকে। বাবা-মা ধুমপায়ী হলে শিশুর ক্যান্সার হওয়ার আশঙ্কা বেশি। 

বিএসএমএমইউ’র শিশু অনকোলজি বিভাগের রেসিডেন্ট ডা. রেজওয়ানা রহমান মেডিভয়েসকে বলেন, ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত শিশুই আমরা বেশি পেয়ে থাকি। এর পাশাপাশি হেপাটো ব্লাস্টোমা, নিউরো ব্লাস্টোমার রোগীগুলোও পেয়ে থাকি। তাড়াতাড়ি রোগ শনাক্ত করা এবং চিকিৎসা শুরু করতে পারলে, সুস্থ হতে বেশি সময় লাগে না। 

শহরের শিশুরা ক্যান্সার আক্রান্ত হয় বেশি

শহরের শিশুরা তুলনামূলক ক্যান্সার আক্রান্ত বেশি হয় জানিয়ে অধ্যাপক ডা. আতিকুর রহমান বলেন, এটা নিয়ে বাংলাদেশে বৈজ্ঞানিকভাবে কোনো গবেষণা বা পরিসংখ্যা করা হয়নি। তবে চিকিৎসকদের ধারণা, শহরের শিশুরা ক্যান্সারের আক্রান্ত বেশি। যেহেতু শহরে পলিউশন বেশি, কাজেই এই রোগ শহরে বেশি। তবে শহরের ভালো দিক হলো ক্যান্সারের বিভিন্ন পরীক্ষা তাড়াতাড়ি করা যায়, রোগ নির্ণয় সহজ হয়।

দেশের চিকিৎসায় আস্থার অভাব

অধ্যাপক আতিকুর রহমান বলেন, ক্যান্সারের চিকিৎসায় অর্থনৈতিক প্রতিবন্ধকতা বড় নয়, অনেকেই সঠিক সময়ে চিকিৎসা নিতে পারে না। শিশু ক্যান্সারের চিকিৎসায় চিকিৎসকরা এখনও আস্থা অর্জন করতে পারেনি। সচেতনতা ও প্রচার-প্রচারণার অনেক ঘাটতি রয়েছে।

চিকিৎসায় ঘাটতি

দেশে বর্তমানে সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল রয়েছে ৩৩টি। এগুলোর মধ্যে শিশু হেমাটোলজি ও অনকোলজি বিভাগ রয়েছে ৮টিতে। এরমধ্যেও সবগুলোতে দেওয়া হয় না পরিপূর্ণ শিশু ক্যান্সারের চিকিৎসা। তবে জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) এবং ঢাকা শিশু হাসপাতালে এই চিকিৎসাসেবা দেওয়া হয়।

বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ, প্রতি বিভাগীয় এবং জেলা শহরে শিশু ক্যান্সারের চিকিৎসা ব্যবস্থা করতে হবে। তাতে অনেক শিশু সঠিক চিকিৎসা পাবে এবং মৃত্যুহার অনেক কমে আসবে।  

আশার বাণী

সম্প্রতি ক্যান্সারের চিকিৎসায় দেশের প্রতিটি বিভাগীয় শহরে হাসপাতাল করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। সেখানে একটি করে শিশুদের ক্যান্সার চিকিৎসা ইউনিট চালু থাকবে।

জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অসংক্রামক রোগনিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির লাইন ডিরেক্টর মোহাম্মদ রোবেদ আমিন মেডিভয়েসকে বলেন, সরকার আটটি বিভাগের ক্যান্সার হাসপাতাল তৈরির কাজ শুরু করেছে। এগুলো চালু হওয়ার পর সেখানে কোমলমতি শিশুরা সম্পূর্ণ চিকিৎসা পাবে। তাদের আর ঢাকায় আসতে হবে না। হাসপাতালগুলো হতে সময় লাগবে, ভবন তৈরি হচ্ছে।

আক্রান্ত রোগীর পরিসংখ্যান

প্রতিষ্ঠানিক হিসাব মতে, প্রতি বছর বাংলাদেশের প্রায় ছয় থেকে আট হাজার শিশু নতুন করে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়। এরমধ্যে গ্রামের বেশির ভাগ শিশু চিকিৎসা না নিয়ে মৃত্যুবরণ করে। যারা চিকিৎসা নেন, তাদের মধ্যে ৭০-৮০ ভাগ রোগী ভালো হয়। বাকি যারা থাকে, তারা ক্যান্সারসহ বিভিন্ন জটিলতা নিয়ে মারা যায়।

এএইচ/এমইউ 

মেডিভয়েসের জনপ্রিয় ভিডিও কন্টেন্টগুলো দেখতে সাবস্ক্রাইব করুন MedivoiceBD ইউটিউব চ্যানেল। আপনার মতামত/লেখা পাঠান [email protected] এ।
  ঘটনা প্রবাহ : শিশু ক্যান্সার
  এই বিভাগের সর্বাধিক পঠিত
এক দিনে চিরবিদায় পাঁচ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক
করোনা ও বার্ধক্যজনিত অসুস্থতা

এক দিনে চিরবিদায় পাঁচ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক