০১ ফেব্রুয়ারী, ২০২৩ ০৭:০৩ পিএম

সন্তানকে সময় দিয়েও যে কৌশলে রেসিডেন্সিতে বাজিমাত ডা. কাশফিয়ার 

সন্তানকে সময় দিয়েও যে কৌশলে রেসিডেন্সিতে বাজিমাত ডা. কাশফিয়ার 
ডা. কাশফিয়া জামান। ছবি: মেডিভয়েস

ডা. কাশফিয়া জামান। সন্তানকে সময় দিতে গিয়ে রাত জেগে জেগে প্রস্তুতি নিয়েছেন। আর এভাবে সুযোগ হয়েছে দেশের মেডিকেল শিক্ষার সর্বোচ্চ বিদ্যাপীট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) রেসিডেন্সি কোর্সে পড়ার। শুধু তাই নয়, পেডিয়াট্রিক গ্যাস্ট্রোএন্টারলজিতে চান্স পাওয়া দেশের তিন সৌভাগ্যবান শিক্ষার্থীর একজনও তিনি। 

সম্প্রতি মেডিভয়েস মুখোমুখি হয় কৃতি এই চিকিৎসকের। আলাপচারিতায় উঠে আসে ঈর্ষণীয় সাফল্যের নেপথ্য কথা। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মো. মনির উদ্দিন, প্রতিবেদন সহযোগিতায় ছিলেন সাখাওয়াত হোসাইন।  

রেসিডেন্সিতে ভর্তির সুযোগ পাওয়ার অনুভূতি

মহান আল্লাহর কাছে অশেষ শুকরিয়া। এ ফলাফলের অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়, আমি সাফল্যে পৌঁছাতে পেরেছি এবং পছন্দের বিষয় পেয়েছি। এ বিষয়ে ক্যারিয়ার গড়বো এবং দেশকে সেবা প্রদান করবো। আমার উদ্দেশ্য সফল করতে পেরেছি। এটা আসলেই বড় একটা পাওয়া এবং বাবা-মা আমাকে যেখানে দেখতে চেয়েছেন, সেখানে আমি পৌঁছে গিয়েছি। এটা আমার অভিভাবকদের জন্যও বড় একটা সাফল্য। যারা আমাকে সহযোগিতা করেছেন এবং পাশে থেকেছেন, তাদের প্রতি আমি ভীষণ কৃতজ্ঞ। সাড়ে নয় হাজার পরীক্ষার্থীর জন্য এক হাজার সিট, তার মধ্যে আমার পছন্দের বিষয়ে সিট খুবই কম, মাত্র তিনটা সিট। আমি আসলেই অনেক খুশি।

প্রস্তুতির উপর আস্থা ছিল

আমার প্রত্যাশা ছিল, আমি যে পরীক্ষাগুলো দিয়েছি, সেগুলোর উপর আমার অনেক আস্থা ছিল। সবসময় আল্লাহ তায়ালার কাছে প্রার্থনা করেছি, আমি পরিশ্রম করে যাচ্ছি, আপনি আমাকে সহায়তা করেন। আমার যে মার্ক ছিল, তাতে আমি সন্তুষ্ট ছিলাম। আত্মবিশ্বাস ছিল, আমি স্বপ্নের জায়গায় পৌঁছাতে পারবো।

চার মাসের প্রস্তুতিতে বিস্ময়কর সাফল্য 

সত্যি কথা বলতে, আমি জার্নিটা সহজ ছিল না। আমার পরিবার, স্বামী-সন্তানও আছে। পরীক্ষার ঠিক চার মাস আগে আমার স্বামী কানাডায় চলে যান। সন্তানকে নিয়ে আমি একাই সংগ্রাম করেছি এবং পড়াশোনা করতে হয়েছে। বাবা-মা আমাকে সহযোগিতা করেছেন, কিন্তু পরিশ্রম আমাকেই করতে হয়েছে। সব মিলিয়ে আমার প্রস্তুতিটা চার মাসের ছিল। আর চার মাস নিয়মিত পড়াশোনা করে রেসিডেন্সিতে চান্স পাওয়া সম্ভব।

সন্তানকে সময় দিতে গিয়ে রাত জেগে প্রস্তুতি

আমি সন্তানকে সময় দেওয়া থেকে বঞ্চিত করিনি। আমি সন্তানকে পর্যাপ্ত সময় দিয়েছি। বাবা কানাডায় চলে যাওয়ায় সে যথেষ্ট আপসেট ছিল। কারণ আমি তাকে যে সময়টা দিয়েছি, তার বাবা এটা দিতো। দেখা গেছে, তার বাবা, তাকে বাহিরে নিয়ে যেত, স্কুলে নিয়ে যেত, আবার স্কুল থেকে নিয়ে আসতো। তার বাবা যখন কানাডায় চলে গেছে, তখন পুরো দায়িত্বটা আমার উপরে এসে পড়ে। আমি সন্তানকে স্কুলে নিয়ে যেতাম ও আসতাম। আবার তাকে বিকেলে খেলতে মাঠে নিয়ে যেতাম। সন্তানের মনটা যেন খারাপ না হয়ে যায়। সব কিছু মেনটেইন করে পড়াশোনা গুছিয়েছি, তাতে অনেক কষ্টও হয়েছে। সন্তান ঘুমিয়েছে, আমি রাত জেগে পড়াশোনা করেছি। এমনও হয়েছে আমি ফজরের নামাজ পড়ে ঘুমাতাম।

প্রস্তুতিতে যেসব বিষয়ে গুরুত্বারোপ

রেসিডেন্সির ফ্যাকাল্টিতে মোট ছয়টা সাবজেক্ট রয়েছে। তাতে পড়াশোনা টেকনিক্যাললি এগিয়ে নিতে হবে। যে বিষয়গুলো বেশি নম্বর পাওয়া যায়, যেমন- মাক্রোবায়োলজি, প্যাথলজি ও ফার্মাকোলজি–এ বিষয়গুলো ভালো মার্ক পাওয়া সম্ভব। এখান থেকে প্রশ্ন ভুল করলে সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যাবে। এক্ষেত্রে এ বিষয়গুলো বারবার পড়তে হবে এবং বারবার রিভিউ দিতে হবে। আর এনাটমি আর ফিজিওলজির প্রশ্নগুলো খুবই কঠিন হয়, অনেক পড়াশোনা করেও প্রশ্ন কমন পাওয়া যায় না। এই দুইটাতে বেশি পরিশ্রম করেও ভালো ফলাফল পাওয়া যায় না। তাই তুলনামূলক সহজ সাবজেক্টগুলোতে বেশি গুরুত্ব দেওয়া উচিত।

কেন্দ্রে যে কৌশল অবলম্বন

আমি যে কৌশলটা অবলম্বন করেছি, সেটা হলো রেসিডেন্সি ভর্তি পরীক্ষায় মোট পাঁচটা ধাপ থাকে একটা প্রশ্নের জন্য, সময়ও খুব বেশি থাকে না। একটা প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য ৩০ সেকেন্ড পাওয়া যাবে। এর বেশি গেলে বা এক মিনিট সময় নিলে, অন্য একটা প্রশ্ন মিস হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। প্রশ্নের দ্বিতীয় ধাপটা খুজতে হবে, যেটা সঠিক। এতে বাকিগুলো যে, ভুল, তা বোঝা যাবে। আর সবগুলো পড়ে পড়ে উত্তর দিতে গেলে ৩০ সেকেন্ডের বেশি লেগে যায়। আর প্রশ্ন দেখা মাত্রই সঠিক উত্তরটা খুঁজে বের করার চেষ্টা করতে হবে।

পরীক্ষার সময় ব্যবস্থাপনা

পরীক্ষার খাতায় কিছু টেকনিক্যাল প্রশ্ন থাকবে। যেগুলো বারবার পড়েও কাভার করা সম্ভব নয়, তাই না পারলে এ ধরনের প্রশ্নগুলো রেখে দিয়ে যেগুলো ভালো নম্বর পাওয়া সম্ভব, সেগুলোর উত্তর দিতে হবে। লক্ষ্য থাকতে হবে ৪৫ মিনিটে ৫০টা প্রশ্ন দাগানো। ৪৫ মিনিটে ৫০টা প্রশ্ন টাচ করে যেতেই হবে। এতে সময় নির্ধারণ করা সহজ হয়ে যাবে। আর কঠিন প্রশ্নগুলো শেষে দিতে হবে, তাতে সময় অপচয় কম হবে। আর একদমই কমন না পড়লে সময় নষ্ট না করে চোখ বন্ধ করে সত্য বা মিথ্যা দিয়ে যেতে হবে। এতে অনেক সময় বেঁচে যাবে।

পছন্দের বিষয় ঠিক করবেন যেভাবে

ফলাফলে কারও পছন্দের বিষয় চলে আসলে বা সাবজেক্ট চয়েজ করার ক্ষেত্রে সুযোগ-সুবিধাগুলো ভালোভাবে দেখতে হবে। নারী হিসেবে আমি আমার পরিবারকে সময় দিবো। তাই আমি কার্ডিও থোরাসিক সার্জারি বা এ ধরনের সাবজেক্টে যাওয়ার চিন্তা করতে পারি না। আমি বলবো না, এসব সাবজেক্ট নিয়ে নারীরা পড়েন না। এসব সাবজেক্ট নিলে নারীদের জন্য বড় একটা অসুবিধার কারণ হয়ে যায়, এ সাবজেক্টটা আমি ক্যারিয়া করতে পারবো কিনা। শুধু সাবজেক্ট নিলেই চলবে না। কোর্সে প্রবেশ করলাম, আবার কোর্স থেকে আউট হয়ে গেলাম, তাতে কোনো লাভ হলো না। এমন লক্ষ্য স্থির করে আগাতে হবে যে, শুরু করেছি, শেষ করতে হবে। এমন কোনো সাবজেক্ট পছন্দ করবো না যেটা আামাকে মাঝপথে রেখে আসতে হয়। এসব মাথায় রেখেই সাবজেক্ট পছন্দ করতে হবে।

রেসিডেন্সিতে ভর্তিচ্ছুদের প্রতি পরামর্শ

রেসিডেন্সিতে ভর্তিচ্ছুদের জন্য পরামর্শ থাকবে, যে ফ্যাকাল্টিতেই দেওয়া হোক না কেন, লক্ষ্য স্থির করে এগিয়ে যেতে হবে। বছরের পর বছর পড়ে গেলে হবে না। বারবার ভুল হচ্ছে কেন? আগে নিজস্ব টেকনিকগুলো শনাক্ত করতে হবে। আমার যেমন চার মাসে রেসিডেন্সিতে সুযোগ হয়েছে, চেষ্টা করলে আপনাদেরও হবে। পড়াশোনার নিজস্ব কিছু কৌশল থাকে, তা আবিষ্কার করে এগিয়ে যেতে হবে। পড়াগুলো গুছিয়ে পড়তে হবে এবং বারবার রিভিউ দিতে হবে।

ভুলগুলো চিহ্নিত করে আগামীর প্রস্তুতি 

আজকে আমার রেসিডেন্সিতে চান্স হয়নি, কিন্তু আমার বন্ধু বা বান্ধবীর হয়ে গেছে–এই ভেবে মন খারাপ করা যাবে না। আর বিশেষ করে মেডিকেলে যারা পড়েন, তাদের তো হতাশ হওয়ার কিছুই নেই। এবার হয়নি, সামনের বার হয়ে যাবে। সেটার জন্য ভালোভাবে প্রস্তুতি নিতে হবে এবং ভুলগুলো শনাক্ত করতে হবে। এতে সামনের পরীক্ষাতে হওয়ার সম্ভাবনাটাই বেশি থাকে।

পেডিয়াট্রিক গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজিতে সুযোগ পেতে করণীয়

পেডিয়াট্রিক ফ্যাকাল্টি মেডিসিন অনুষদের অধীনে ছিল। ২০১৯ সালে মেডিসিন থেকে আলাদা হয়েছে পেডিয়াট্রিক বিভাগ। এই ফ্যাকাল্টিতে যে প্রশ্নগুলো আসে, সেগুলো ঘুরে ঘুরে আসার মতো নয়। যারা এই সাবজেক্টে আসতে চান, তাদের ফিজিওলজিতে খুব গুরুত্ব দিতে হবে। কারণ বেশির ভাগ প্রশ্ন ফিজিওলজি থেকে আসে, আর এই প্রশ্নগুলো একটু কঠিন আসে, এটা বুঝেই পড়ার চেষ্টা করে যেতে হবে। এটাতে চান্স পেতে ফ্যাকাল্টির উপর খুব গুরুত্ব দিতে হবে। বাকি সাবজেক্টগুলোর বিষয়ে বলতে পারবো না, কিন্তু এখানে আসতে হলে ফ্যাকাল্টির উপর খুব গুরুত্ব দিতে হবে। এখানে সিট সংখ্যা খুব কম, এতে পয়েন্টের কারণেও সুযোগ না হতে পারে।

ফল প্রকাশে অপেক্ষমাণ তালিকা জরুরি

রেসিডেন্সিতে অপেক্ষমাণ তালিকা চালু রাখা প্রয়োজন আছে। কারণ অনেকে কাঙ্খিত সাবজেক্ট না পেয়ে বা অন্য কোনো কারণে রেসিডেন্সিতে ভর্তি হন না। আর রেসিডেন্সিতে মোটা একটা অংকের ফি দিয়ে ভর্তি হতে হয়। দেখা গেছে, অনেকে এই টাকা ম্যানেজ করতে পারে না, এসব কারণে অনেকে ভর্তি হয় না। আর যাদের অল্প মার্কের জন্য রেসিডেন্সিতে সুযোগ হয়নি, তারা যদি অপেক্ষমাণ তালিকায় থাকে, তাতে শূন্য থাকা আসনটা পূরণ হবে। ওয়েটিং লিস্ট না থাকার কারণে অনেক সিট ফাঁকা থেকে যায়। কর্তৃপক্ষের কাছে আমার আবেদন, অপেক্ষমাণ তালিকার বিষয়টি যেন চালু করা হয়।

মার্কসহ ফল প্রকাশের পরামর্শ

যারা সুযোগ পেয়ে গেছেন, এটা তাদের দরকার নেই। কারণ তারা সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েই জায়গা মতো গেছেন। আর যারা যেতে পারেননি, সযোগ পাননি, তাদের মার্কসিট দেওয়া যেতে পারে। কারণ তারা তাদের ভুলগুলো বুঝতে পারবেন। যাদের অল্পের জন্য হয়নি, তারা নিজেদের ভুলগুলো ধরতে পারবে। ফলে আগামীর পথচলায় অনেক দূর যাওয়া সম্ভব হবে। আমার মতে, যারা সুযোগ পাচ্ছে না, তাদেরকে মার্কশিটগুলো দেওয়া দরকার।

১০০ প্রশ্নের জন্য চাই ১০০ মিনিট 

রেসিডেন্সির কোর্সের লেভেল অনেক স্ট্যান্ডার্ড হয়ে যাচ্ছে। দেখা গেছে, যারা পাঁচ বছর আগে রেসিডেন্সি দিয়েছে, তারা পেনসিল দিয়ে ২০০ প্রশ্ন দাগাতো। তাতে ভুল প্রশ্ন দাগালে পরে তা মুছে ফেলা যেত। এখন বলপেন দিয়ে দাগানোর কারণে রিভার্স করার কোনো সুযোগ নেই। এ ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদেরকে চিন্তা করার সময়ও দেওয়া হচ্ছে না। প্রশ্ন ১০০ করে ৯০ মিনিট দেওয়া হচ্ছে, আবার প্রশ্নের ধরনও পরিবর্তন করা হয়েছে। প্রশ্নের উত্তর নিয়ে চিন্তাও করতে হচ্ছে, তাতে সময়ও দেওয়া হচ্ছে না। আবার খাতায় স্বাক্ষর করা, স্যারদের কিছু কাজও থাকে, এখানেও সময় নষ্ট হচ্ছে। এর এই প্রক্রিয়াগুলো স্যাররা যদি প্রশ্ন দেওয়ার আগে সেরে নেন, তাতে শিক্ষার্থীদের সময় বাঁচে। 

এমবিবিএসে অধ্যয়নরতদের প্রতি পরামর্শ

এমবিবিএসের বেসিক সাবজেক্টগুলো ভালো করে পড়তে হবে। এতে অনেকের থেকে এগিয়ে থাকা সম্ভব। পরবর্তীদের যারা রেসিডেন্সিতে আসবেন, তাদের জন্যই ভালো হবে। আর বেসিক সাবজেক্টগুলো থেকেই প্রশ্ন আসে। এমবিবিএসে যারা বেসিক সাবজেক্ট ভালো করে পড়েনি, তাদের অনেক কষ্ট করতে হয়। আগে থেকে পড়াশোনা করে আসলে পরিশ্রম অনেক কমে আসবে।

মেডিভয়েসের জনপ্রিয় ভিডিও কন্টেন্টগুলো দেখতে সাবস্ক্রাইব করুন MedivoiceBD ইউটিউব চ্যানেল। আপনার মতামত/লেখা পাঠান [email protected] এ।
  ঘটনা প্রবাহ : রেসিডেন্সি কোর্স
  এই বিভাগের সর্বাধিক পঠিত
এক দিনে চিরবিদায় পাঁচ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক
করোনা ও বার্ধক্যজনিত অসুস্থতা

এক দিনে চিরবিদায় পাঁচ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক