৩১ জানুয়ারী, ২০২৩ ১১:৩৩ এএম
বিশেষ সাক্ষাৎকার

ইন্টার্নদের ভাতা ৩০ হাজার টাকা হওয়া উচিত: মুগদা মেডিকেল অধ্যক্ষ

ইন্টার্নদের ভাতা ৩০ হাজার টাকা হওয়া উচিত: মুগদা মেডিকেল অধ্যক্ষ
নবীন চিকিৎসকরা উপজেলায় সেবা দিতে গিয়ে বিভিন্নভাবে নিরুৎসাহিত হন। যেমন: ঠুনকো কারণে স্থানীয় লোকজন চিকিৎসকদের ওপর হামলা চালায়।

দেশের মেডিকেল শিক্ষাকে দেখতে চান আন্তর্জাতিক মানে, স্বাস্থ্য সেবায়ও প্রত্যাশা করেন কাঙিক্ষত উন্নতি, যাতে বিদেশিরা বাংলাদেশে দেশে এসে চিকিৎসা গ্রহণ করেন। এমনই স্বপ্নের কথা জানিয়েছেন মুগদা মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. মোস্তাফিজুর রহমান। দীর্ঘ ১৪ বছরের কর্মস্থল শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ ছেড়ে গত ৩ জানুয়ারি মুগদা মেডিকেল কলেজে অধ্যক্ষ হিসেবে যোগ দিয়েছেন তিনি

নতুন কর্মস্থল ঘিরে তাঁর পরিকল্পনা এবং দেশের স্বাস্থ্য শিক্ষা ও সেবা নিয়ে ভাবনা জানতে সম্প্রতি মেডিভয়েস মুখোমুখি হয় এই সার্জারি বিশেষজ্ঞের। অন্তরঙ্গ আলোচনায় উল্লেখ করেন স্বাস্থ্য খাতের ইতিবাচক নানা দিক। সেই সঙ্গে সীমাবদ্ধতাগুলো চিহ্নিত করে এর সমাধানে দেন যৌক্তিক বিভিন্ন পরামর্শ। মেডিভয়েস পাঠকদের জন্য কথোপকথনের পুরো অংশ তুলে ধরা হলো। 

সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আলী হোসাইন, ছবি তুলেছেন আব্দুল লতিফ সাদ্দাম

মেডিভয়েস: মেডিকেল শিক্ষার্থীদের পাঠ দানের পাশাপাশি রোগীও দেখেন। কোনটি বেশি উপভোগ্য?

অধ্যাপক ডা. মোস্তাফিজুর রহমান: চিকিৎসা এবং শিক্ষা একটির সঙ্গে আরেকটি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। শিক্ষার্থীদেরকে যখন পড়াই তখন মনে করি, এরাই আমার ভবিষ্যৎ। তাদেরকে ভালোভাবে প্রস্তুত করতে হবে। পরবর্তীতে তারাই চিকিৎসা দিবে। অর্থাৎ আমি পরবর্তী চিকিৎসক প্রজন্মকে তৈরি করতে চাই। আবার রোগীর কাছে যখন যাই, তখন চিন্তা করি, রোগীকে সেবা দেওয়াই আমার কাছে প্রধান কাজ। যে রোগীটা আমার কাছে সেবা নিতে এসেছেন, তাঁকে শতভাগ সেবা দিতে হবে। আমার যে মেধা এবং দক্ষতা সেটিকে কাজে লাগাতে হবে। তাই দুই জায়গার অনুভূতি দুভাবে উপভোগ করি।

মেভিয়েস: বেসিক সাবজেক্টে শিক্ষক সংকটে কি কি সমস্যা হচ্ছে? সমাধানে আপনার ভাবনা জানতে চাই।

অধ্যাপক ডা. মোস্তাফিজুর রহমান: মুগদা মেডিকেল কলেজে বেসিক সাবজেক্টের শিক্ষক সমস্যা প্রকট। এ সমস্যাগুলো কিছু ল্যাবরেটরি এবং কিছু শিক্ষক সংশ্লিষ্ট। তবে ক্লিনিক্যাল সাবেজেক্টে অনেক শিক্ষক রয়েছে। কারণ, রোগী আছে চিকিৎসক আছে।

এখানে বেশিরভাগ শিক্ষক এবং চিকিৎসক সংযুক্তিতে আছেন, নিয়মিত পদে নেই। সংকটের মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীরা তাদের সময় অনুসারে প্রথম বর্ষ থেকে দ্বিতীয় বর্ষে, দ্বিতীয় বর্ষে থেকে তৃতীয় বর্ষে, এভাবে চূড়ান্ত বর্ষে চলে যাবে। তাই সমাধানে বর্তমান যে পরিমাণ শিক্ষক রয়েছে, তা দিয়ে কাজ চালিয়ে নিতে হবে।

সাবজেক্ট অর্গানোগ্রাম অনুসারে, ৭৫ জন মেডিকেল শিক্ষার্থীর জন্য একজন অধ্যাপক, দুইজন সহযোগী অধ্যাপক, পাঁচজন সহকারী অধ্যাপক ও কয়েকজন লেকচারার থাকা প্রয়োজন। সেটি এ মেডিকেল কলেজে নেই। কিছু বিভাগে অধ্যাপক আছে, কিন্তু সহযোগী অধ্যাপক নেই। অধ্যাপক যারা আছেন, তাদের মধ্যে অনেকে সংযুক্তিতে আছে। এ অবস্থায় সংশ্লিষ্ট শিক্ষককে বেতন নিতে হয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের (ডিজি) অফিস থেকে। এক্ষেত্রে তিনি বিভিন্ন সময় সমস্যায় পড়েন। যেমন: আমি যেখানে চাকরি করি, সেখান থেকে বেতন নিবো, এটিই স্বাভাবিক। কিন্তু একজন শিক্ষক চাকরি করেন মুগদা মেডিকেল কলেজে, বেতন নেন ডিজি হেলথ থেকে। এটি তাঁর জন্য অশোভন।

এ ছাড়া ছয় মাস পর বেতনের জন্য অনুমতি নিয়ে আসতে হয়। একজন বিসিএস ক্যাডার অফিসারকে যদি বলা হয়, অনুমতি ছাড়া আগামী মাসে আপনার বেতন হবে না। এটি তাঁর জন্য বিব্রতকর। 

সমস্যা সমাধানে অর্গানোম অনুসারে চিকিৎসক ও শিক্ষকের চাহিদাপত্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো আছে। আমি চেষ্টা করবো, খুব তাড়াতাড়ি এগুলোকে পাস করে আনার জন্য। অন্যান্য বিষয়গুলোও মন্ত্রণালয়ের মিটিংয়ে আমরা তুলে ধরবো।

এখানে একাডেমিক ভবন নেই। অনেক শিক্ষকদের বসার রুম নেই। এনাটমি ডিপার্টমেন্টে গিয়ে দেখে আসলাম, হাসপাতালের ভেতরে ক্লাস হচ্ছে। ওদের ডেডবডি ডিসেকশন রুম নেই। বিভাগীয় প্রধানের রুমের অবস্থা ভালো নয়।

এসব সমস্যা সমাধানের জন্য এখানে ১৩তলার একটি একাডেমিক ভবন করা হবে। হাসপাতালের শয্যা সংখ্যা ও মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীর অনুপাতে চিকিৎসক ও শিক্ষকের পদ সৃষ্টি করা হচ্ছে। এটির কার্যক্রম চলমান আছে, আমরাও সহযোগিতা করবো। অচিরেই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।

মেডিভয়েস: শিক্ষার্থী, ইন্টার্ন ও ট্রেইনি চিকিৎসকদের আবাসনের ব্যবস্থা নেই, তাদের জন্য আপনার পরিকল্পনা কী?

অধ্যাপক ডা. মোস্তাফিজুর রহমান: আমার শিক্ষার্থীরা খুবই কষ্টে আছে। তারা হাসপাতালের করিডোরের মধ্যে একটি পর্দা দিয়ে কষ্ট করে কোনো রকমে থাকছে। ইন্টার্ন চিকিৎসকদের সার্বক্ষণিক দায়িত্ব পালন করতে হয়। জরুরি দায়িত্ব পালন করতে হয়। ইন্টার্নরা কোনো মতে আছে। সংকট দিন দিন বাড়ছে।

শিক্ষার্থীদের উপভোগের একটি জায়গা হলো হোস্টেল। তারা বড় হোস্টেলে থাকবে, যেখানে ডাইনিং, টিভি ও খেলাধুলা রুমে থাকবে। পড়াশোনা করতে হবে আনন্দের সঙ্গে। অথচ এখানে ছেলে শিক্ষার্থীরা যে জায়গায় আছে, দেখলে আপনি অবাক হয়ে যাবেন যে, এখানে মেডিকেল শিক্ষার্থীরা থাকেন!

বিষয়টি আপাতত সমাধানের জন্য হাসপাতালের ছাদে ব্যবস্থা করা হচ্ছে। সেখানে হয়তো ৬০-৭০ জন শিক্ষার্থীর আবাসনের ব্যবস্থা হবে। যদিও এটি আইডিয়াল না। কারণ, ছাদের ওপর স্থাপনা করা হচ্ছে, উপরে হয়তো শেড করা হবে।

মেডিভয়েস: ইন্টার্নশিপের ভাতা বৃদ্ধির দাবি দীর্ঘ দিনের, এ দাবি যৌক্তিক বলে মনে করেন কিনা?

অধ্যাপক ডা. মোস্তাফিজুর রহমান: ইন্টার্নদের ১৫ হাজার টাকা ভাতা প্রদান করা হয়। বর্তমান বাজারে এ টাকা কিছু না। একদম নিম্ন পর্যায়ের মানুষের জন্যও জীবন ব্যয় আরও বেশি প্রয়োজন হয়। যদি ভাতা বলি, তাহলে ৩০ হাজার টাকা হওয়া উচিত। কারণ, অনেকে আছেন পরিবারকে সাপোর্ট দিতে হয়। সুতরাং এটি অবশ্যই বাড়ানো উচিত। ইন্টার্নদের ভাতা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডাব্লিউএইচও) থেকে দেওয়া হয়। সরকারকে আলোচনা করে আনতে হবে।

মেডিভয়েস: মেডিকেল কলেজের বিদ্যমান সিলেবাস মুখস্ত নির্ভর বলে একটি অভিযোগ আছে। এটি আধুনিকায়নের দরকার আছে কিনা?

অধ্যাপক ডা. মোস্তাফিজুর রহমান: শিক্ষার্থীরা প্রথম বর্ষে থিউরিটিক্যালি যা পড়ছে, তৃতীয় ও চতুর্থ বর্ষে গিয়ে তা প্র্যাক্ট্রিক্যালের সঙ্গে মিলেছে না। আমি এখানে এনাটমি ডিপার্টমেন্টে শিক্ষার্থীদের লিভার নিয়ে পড়ার সময় দেখেছি, তারা লিভারটা মৃতদেহে ক্যাডাভেরিক দেখলো। কিন্তু তাকে যদি অপারেশনের সময় জীবিত দেহের লিভারটা দেখানো হতো, তাহলে সে বুঝতো লিভারটা শরীরে বাস্তবে কী রকম থাকে? তখন তাঁর স্মৃতিতে ধারণাটা অনেক বেশি মজবুতভাবে স্থায়ী হতো। আমার তো দরকার বাস্তব ধারণা। আমি যে পড়াশোনা করলাম, সেটা যেনো স্মৃতিতে থেকে যায়। 

অ্যানিমিয়া (রক্তস্বল্পতা) পড়ানোর সময় যদি একজন অ্যানিমিয়া আক্রান্ত রোগীকে দাঁড় করিয়ে শিক্ষার্থীদের দেখানো হয়, তাহলে এটি তাদের মনে থাকবে সহজে। পড়ার সঙ্গে দেখলে বিষয়টি আরও বেশি মনে থাকে। সারা বিশ্বেই মেডিকেল শিক্ষা পদ্ধতি পরিবর্তন হচ্ছে। বিশ্বের বর্তমান ধারণা হলো সমন্বিত শিক্ষা।

মেডিভয়েস: পাঠদানে আপনার স্বাতন্ত্র্য সম্পর্কে বলুন।

অধ্যাপক ডা. মোস্তাফিজুর রহমান: আমি যখন কোনো রোগ নিয়ে পড়াই, তখন প্রথমে এটি কি, কোথায় থাকে, এভাবে শুরু করি। যেমন: অ্যাপেন্ডিসাইটিস নিয়ে যখন পড়াই, তখন এটি কি, কোথায় থাকে, তারপর ক্লিনিক্যাল দিকে আসি। শিক্ষার্থীদেরকে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে প্রাথমিক জ্ঞান দিয়ে তারপর পড়ানো শুরু করি। মৌলিক কিছু ধারণা দিয়ে তারপর বিস্তারিত পড়াই। 

মেডিভয়েস:  দেশের স্বাস্থ্য শিক্ষার মান কি কমে যাচ্ছে? কেন? উত্তরণে করণীয় জানতে চাই। 

অধ্যাপক ডা. মোস্তাফিজুর রহমান: মান কমছে না। খুব বেশি নিম্নগামী, এটি আমি মনে করি না। কিছু কিছু টেকনিক্যাল সমস্যা আছে। যেমন: অবকাঠামো নেই, কিন্তু মেডিকেল কলেজ হয়ে গেছে। নীলফামারীতে মেডিকেল কলেজ হয়ে গেলো, এখন ওখানে যদি অবকাঠামোসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা না থাকে, তাহলে সেখান থেকে যারা চিকিৎসক হবেন, তাদেরতো মান ভালো হবে না। অথচ ঢাকাতে যে চারটি মেডিকেল কলেজ আছে, এগুলো থেকে পাস করা চিকিৎসকদের সঙ্গে কিন্তু নীলফামারী থেকে পাস করা চিকিৎসক প্রতিযোগিতা করবে। বিসিএস দিবে। চূড়ান্ত হিসাবে মান ঠিকমতো হচ্ছে না।

এ সংকট কাটানোর জন্য মন্ত্রণালয় থেকে চিন্তা করা হচ্ছে। ঢাকা থেকে অনলাইনে বিভিন্ন জেলার মেডিকেল শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার জন্য কিছু করা যায় কিনা। যেমন: এখানে আমরা একজন রোগীকে যে চিকিৎসা দিচ্ছি, সেটি তারা ওখান থেকে দেখলো। মান ধরে রাখতে হলে এ কাজগুলো করতে হবে। 

মেডিকেল সায়েন্স তো ইন্টারন্যাশনাল। তাই আমাদেরকে আদর্শ মান বজায় রাখতে হবে, যাতে আমরা এখান থেকে গ্রাজুয়েশন সম্পন্ন করে ইংল্যান্ড গিয়ে আরেকজন চিকিৎসকের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে পারি। রোগ নির্ণয়ের জন্য আমি যেসব পরীক্ষা-নিরীক্ষা লিখবো, এটি সারা বিশ্বে গ্রহণযোগ্য হতে হবে। আমি যে চিকিৎসা দেবো, সেটি অনলাইনে সার্চ দিয়ে দেখবেন ঠিক আছে কিনা। অর্থাৎ এটি আন্তর্জাতিক হতে হবে। 

মেডিভয়েস:  বাংলাদেশে স্বাস্থ্যখাতে কি কি সমস্যা আছে বলে আপনি মনে করেন? সমাধানের জন্য কি উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন?

অধ্যাপক ডা. মোস্তাফিজুর রহমান: স্বাস্থ্যখাতের সমস্যা থাকবে। সফলতাও অনেক। করোনায় মোকাবেলায় এশিয়ায় আমরা প্রথম এবং বিশ্বে পঞ্চম হয়েছি। বাংলাদেশ সরকার যতগুলো আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছে, তার অনেকগুলো স্বাস্থ্যখাতের সফলতা। দেশ অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছে। চিকিৎসক এবং রোগী সচেতন হলে স্বাস্থ্যখাত এগিয়ে যাবে।

মেডিভয়েস: প্রতি বছর সিট বাড়ছে, নতুন কলেজও হচ্ছে। আর কত সিট ও মেডিকেল হলে দেশের চিকিৎসক চাহিদা পূরণ হবে?

অধ্যাপক ডা. মোস্তাফিজুর রহমান: মানসম্মত চিকিৎসক দরকার। ভালো চিকিৎসা দিতে পারে এমন চিকিৎসক। মান সম্মত চিকিৎসক তৈরি করতে হলে মানসম্মত মেডিকেল কলেজ লাগবে, শিক্ষক লাগবে, সমস্ত সুযোগ সুবিধা লাগবে। আমরা মনে করি, এখনও চিকিৎিসক সংকট আছে। এতো চিকিৎসক বের হচ্ছে, এতে ভয়ের কিছু নেই। এদের কাজে লাগানো সম্ভব। আমরা কিভাবে কাজ লাগাতে পারি, এর জন্য শুধু কার্যকর উদ্যোগ ও ভালো পরিকল্পনার দরকার।

মেডিভয়েস: চিকিৎসকরা কেনো উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে থাকতে চান না, তাদেরকে সেখানে রাখতে সরকারের কী কী করণীয় রয়েছে?

অধ্যাপক ডা. মোস্তাফিজুর রহমান: নতুন চিকিৎসকদের উপজেলায় সেবা দেওয়ার খুবই ইচ্ছে থাকে। উপজেলায় যেসব চিকিৎসক কাজ করেন, তারা কিন্তু প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা। উপজেলায় প্রশাসন ক্যাডারের দুইজন অফিসার থাকেন। একজন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্ত (টিএনও), একজন ভূমি কর্মকর্তা (এসিল্যান্ড)। প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা হিসেবে যদি এ দু’জনের সঙ্গে তুলনা করেন, দেখবেন তারা (চিকিৎসক) একই সুযোগ সুবিধা পাচ্ছেন না। একটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ১০-১২ জন চিকিৎসক থাকেন। অনেক উপজেলায় চিকিৎসকদের থাকার জায়গাও নেই। যদিও জায়গা থাকে, তা বসবাসের উপযোগী না।

নবীন চিকিৎসকরা উপজেলায় স্বাস্থ্যসেবা দিতে গিয়ে বিভিন্নভাবে অনুৎসাহিত হন। যেমন: একজন চিকিৎসক নতুন যোগদান করেছেন। ঠুনকো কোনো বিষয়ে স্থানীয় লোকজন এসে এমনভাবে কথা-বার্তা বলেন, যা খুব কষ্ট লাগে। অনেক সময় আক্রমণ করলে, ব্যক্তিগত নিরাপত্তাও পাওয়া যায় না। ইমার্জেন্সিতে একজন রোগী নিয়ে আসলো, হয়তো এটি ম্যানেজবল না, কিন্তু রোগীর স্বজনরা চাপ প্রয়োগ করলো এখানে ট্রিটমেন্ট দেন। এ পরিস্থিতিতে রোগীর অবস্থা খারাপ হয়ে গেলো। সে দায়-দায়িত্ব চিকিৎসকের উপরে যাবে। এসব দেখে চিকিৎসকরা নিরুৎসাহিত হন।

প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্রে সব চিকিৎসা করা সম্ভব নয়। কার্ডিওলজি রোগীকে ওখানে বাঁচানো যাবে না। এমআই রোগী মরে গেলো, এ দায় চিকিৎসকের ওপর চাপিয়ে দিলে হবে না। রোগী মারা গেলে হাসপাতাল ভাঙচুর, ক্রিমিনাল অ্যাক্টে মামলা, এসব তো হতে পারে না। এ জায়গাগুলোতে পরিবর্তন করতে হবে। নতুবা আমি রোগী দেখভাল না করে রেফার্ড করে দিবো। এ রোগীটার চিকিৎসা সম্ভব হতো, কিন্তু সমস্যা হলে দায় নিবে কে? এজন্য একজন চিকিৎসক যখন রোগী রেফার্ড করে দিবে, তখন রাস্তায় এসে মারা যাবে।

সুতরাং আমার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। পুলিশ আমার চিকিৎসককে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাবে, এটা তো হতে পারে না। উপজেলায় কেনো চিকিৎসক থাকছে না, মূল কারণ হলো এ সমস্যাগুলো।

মেডিভয়েস: চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে অবহেলায় রোগী মারা যাওয়ার অভিযোগ উঠে কেনো?

অধ্যাপক ডা. মোস্তাফিজুর রহমান: অবহেলা কে চিহ্নিত করবে? এটাতো প্রশাসন চিহ্নিত করতে সক্ষম না। অবহেল চিহ্নিত করতে পারে একমাত্র বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে ল্যাপারোস্কোপি অপারেশন করার দশ দিন পর কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়ে ওখানে একটা রোগী মারা গেছেন। অথচ এ ঘটনায় চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে ক্রিমিনাল এ্যাক্টে হত্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে। 

কোনো ঘটনা ঘটলে খবরের শিরোনাম হয়ে যায়। এ রকম হলে কোনো চিকিৎসক গুরুতর রোগীর চিকিৎসা দিতে আগ্রহী হবে না। যেমন- আমি বলবো, এ রোগীকে আপনি হায়ার সেন্টারে নিয়ে যান। এটি বলা আমার অধিকার আছে। কিন্তু চাইলে চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব।

মেডিভয়েস: দেশের স্বাস্থ্য শিক্ষাকে আপনি কোন জায়গায় দেখতে চান, এ জন্য করণীয় ও প্রতিবন্ধতা কী কী?

অধ্যাপক ডা. মোস্তাফিজুর রহমান: স্বাস্থ্য শিক্ষায় অনেক পরিবর্তন হচ্ছে। আমি চাই আরও যুগোপযোগী জায়গায় নিয়ে যেতে। মেডিকেল শিক্ষা আন্তর্জাতিক মানের করতে হবে। আমার দেশের মেডিকেল শিক্ষা যাতে আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য হয়। আমাদের চিকিৎসকরা সারা বিশ্বের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে পারে।  আমি স্বপ্ন দেখি, আমাদের দেশে রোগী আসবে অন্য দেশ থেকে চিকিৎসা নিতে। দেশের মানুষ চিকিৎসার জন্য যাতে বাহিরে যেতে না হয়। পরবর্তী চিকিৎসক প্রজন্মকে ওইভাবে তৈরি করতে চাই। 

মেডিভয়েস: অধ্যাপনা করা এবং একই সঙ্গে অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন, সমন্বয়ের কৌশল জানাবেন। 

 অধ্যাপক ডা. মোস্তাফিজুর রহমান: ক্লাস নেওয়া একই সঙ্গে প্রশাসন দেখা একটু কষ্টকর। তবে এটিকে কোনো সমস্যা মনে করি না। সমাজকে দেওয়ার অনেক কিছু বাকি রয়ে গেছে। সময়ের যথাযথ ব্যবহারই আমার সফলতা। একজন শিক্ষার্থীকে পড়াতে, একজন রোগীকে চিকিৎসা সেবা দিতে আমার অনেক ভাল লাগে। আমরা চিকিৎসকরা সেবা দিতে প্রস্তুত। শুধু মানুষের মানসিকতা পরিবর্তন করতে হবে। চিকিৎসকরাও মানুষ, তাদের সুখ, দুঃখ ও বেদনা আছে। তাদের সংসার আছে। জনগণের প্রতি অনুরোধ জানাবো যে, আপনারা অযথা দোষ চাপিয়ে দিবেন না। দুই-একজন চিকিৎসকের সমস্যা থাকতে পারে। এটি ব্যতিক্রম। এটি কোনো উদাহরণ হতে পারে না।

মেডিভয়েস: নবীন চিকিৎসকদের প্রতি আপনার পরামর্শ কি?

অধ্যাপক ডা. মোস্তাফিজুর রহমান: নবীন চিকিৎসকরা বেশিরভাগই চিকিৎসা দিতে ঝাপিয়ে পড়েন। করোনাকালীন মাঠে নবীন চিকিৎসকরাই বেশি ছিলেন। যুদ্ধক্ষেত্রে তারা বেশি কাজ করেছেন। আমরা নেতৃত্ব দিয়েছি। নবীনরা পরিস্থিতি মোকাবেলা করছেন। তারা আরও মানবিক হবে এবং যুগোপযোগী চিকিৎসা পদ্ধতি সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করবেন। 

মেডিভয়েস: ইনস্টিটিউশনাল প্র্যাক্টিস নিয়ে আপনার ভাবনা কি?

অধ্যাপক ডা. মোস্তাফিজুর রহমান: সরকার প্রাতিষ্ঠানিক প্র্যাকটিসের ঘোষণা দিয়েছে। এটির সঙ্গে আমি সম্পূর্ণ সহমত। তবে শঙ্কার জায়গা হলো-যেখানে নির্ধারিত অফিস সময়ে চিকিৎসকরা নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন, সেখানে বাকি সময় সেবা দিতে নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে। হাসপাতালে চিকিৎসকরা বিভিন্ন ধরনের নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন। কারণ, হাসপাতালে চিকিৎসকদের তেমন কোনো নিরাপত্তার ব্যবস্থা নেই। কোনো একটা সমস্যা হলে রোগীর স্বজনরা চিকিৎসকদের ওপর হামলা চালায়। এটি আমাদের দেশে নিত্য-নৈমিত্তিক ঘটনা। সকালের তুলনায় বিকেলে হাসপাতালে লোকবল খুব কম থাকে। তখন একজন চিকিৎসক সেবা দিতে গিয়ে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনার সম্মুখীন হলে, তাকে নিরাপত্তা দিবে কে?

প্রাতিষ্ঠানিক প্র্যাকটিস যুগোপযোগী। সরকারের এ উদ্যোগকে সফল করতে স্বাস্থ্য সেবা প্রতিষ্ঠানে নিরাপত্তা জোরদার করতে হবে। এ জন্য মন্ত্রণালয় থেকে পুলিশ প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনা করে হাসপাতালে পুলিশ বুথের ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে যে কোনো অনাকাঙিক্ষত ঘটনা ঘটলে, তাৎক্ষণিক পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যায়। হাসপাতালে চিকিৎসকদের যদি হেনস্তা, হামলা ও আক্রমণের শিকার হওয়া থেকে নিরাপদ রাখা যায়, তাহলে অনেক চিকিৎসকরা প্রাতিষ্ঠানিক প্র্যাক্টিসের বিষয়ে রাজি হবেন। এ জন্য আনসারদের বুথের মতো পুলিশের একটি বুথ খুবই জরুরি।

মেডিভয়েস: আপনার শিক্ষা ও কর্মজীবন নিয়ে বলুন।

অধ্যাপক ডা. মোস্তাফিজুর রহমান: আমার বাড়ি গোপালগঞ্জ জেলার কাশিয়ানি উপজেলায়। প্রাথমিক শিক্ষা সেখান থেকে শেষ করি। ফরিদপুর জিলা স্কুল থেকে এসএসসি ও সরকারি রাজেন্দ্র কলেজ থেকে এইচএসসি সম্পন্ন করি। এমবিবিএস পাস করি ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ থেকে। পড়াশোনা শেষে বিসিএস হেলথ ক্যাডারে কাশিয়ানি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যোগদান করি। এরপর ওসমানি মেডিকেল কলেজ, সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও বিএসএমএমইউতে ট্রেইনিং করি। ট্রেনিং শেষে আবার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ফিরে যাই। আমি বাংলাদেশ কলেজ অব ফিজিশিয়ান্স অ্যান্ড সার্জন্স থেকে এফসিপিএস এবং ইংল্যান্ড থেকে এমআরসিএস করেছি। ২০০৯ সালে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ যোগদান করি। ১৪ বছর সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজে ছিলাম। আমার স্বর্ণযুগ ওখানে কেটেছে। সোহরাওয়ার্দী মেডিকেলের প্রতিটি কর্নার আমার মুখস্থ। সর্বশেষ গত ৩ জানুয়ারি মুগদা মেডিকেল কলেজে অধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োগ পাই।

মেডিভয়েস: আপনার জীবনের একটি স্মরণীয় ঘটনা বলুন।

অধ্যাপক ডা. মোস্তাফিজুর রহমান: আমি সহকারী অধ্যাপক হয়েছি পিএসসি পরীক্ষা দিয়ে। পিএসসিতে অনেকে পরীক্ষা দিয়েছিল। আমাদের সিনিয়রও অনেক ছিল। পরীক্ষার ফলাফলের দিন আমি এক জায়গায় যাচ্ছিলাম। বাস থেকে নামার জন্য এক পা নিচে দিয়েছি, ঠিক তখনি ফোন বেজে উঠল। ফোন রিসিভ করলে পিএসসি থেকে আমাকে জানানো হলো, আমি দ্বিতীয় হয়েছি। আমি ভাবলাম, আমি বাস থেকে পড়ে গেলাম কিনা। এ ছাড়া আরও অনেক স্মরণীয় ঘটনা আছে। 

এমইউ

মেডিভয়েসের জনপ্রিয় ভিডিও কন্টেন্টগুলো দেখতে সাবস্ক্রাইব করুন MedivoiceBD ইউটিউব চ্যানেল। আপনার মতামত/লেখা পাঠান [email protected] এ।
  এই বিভাগের সর্বাধিক পঠিত