
ডা. সাকলায়েন রাসেল
অ্যাসিসটেন্ট প্রফেসর এন্ড অ্যাসোসিয়েট কনসালটেন্ট, ভাসকুলার সার্জারি, ইব্রাহীম কার্ডিয়াক হসপিটাল এন্ড রিসার্চ ইন্সটিটিউট।
০৫ জানুয়ারী, ২০২৩ ১০:২৬ এএম
স্মৃতি: কতবার দেখেছি এই সমুদ্র, আজ একটা ভিন্ন সমুদ্র দেখছি!

বাবা, তুই এই সমুদ্র পাড়ি দিছিস। করছিস কি তুই! কিভাবে এখানে সাঁতার কাটছিস? আমারতো দেখেই ভয় লাগছে! মুচকি হেসে উড়িয়ে দেওয়ার ভান করলাম। মুখে শব্দ নেই আমার। ভাবছি আমিতো মহা ভাগ্যবান কেউ। তাই এখনো প্রতিদিন সাঁতার কাটি বাবা মা নামক মহাসমুদ্রে। তাই দুনিয়ার কোনো সমুদ্র ভয় লাগেনা।
মা সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো। তাঁর প্রতিটা ঢেউয়ে আন্দোলিত হই নতুন করে। আর বাবা? তিনি হলেন-তীর বয়ে ছুটে চলা ঐ ঝিরিঝিরি বাতাসের মতো। শুধু অনুভব করা যায়। ধরা যায় না, ছোয়া যায় না কিংবা ঐ আকাশটার মতো। কত দূরে। তবুও ছেয়ে আছে ছাদের মতো। পুরোটা এই আমি জুড়ে।
আমার এগিয়ে যাওয়ায়...বাবার কোন অবদান নাই... রূপসী গ্রামের সেই ডানপিটে ছেলেটার আজকের এ অবস্থানে আসার পিছনে বাবার কোন ভূমিকা নাই...! স্কুল কলেজ কিংবা মেডিকেল...নিজ বাসা অথবা আত্মীয়ের বাসা...বলার মতো বাবার সাথে কোন স্মৃতি নাই...থাকবে কি করে, জ্ঞান হওয়ার পর থেকে বাবাকে চাকরি করতে দেখি...চাকরির প্রয়োজনে কখনো ঢাকা...কখনো জলঢাকা...কখনো নগরবাড়ি...কখনো সরিষাবাড়ি।
স্কুলে যাই মায়ের হাত ধরে...ঘুমাই মায়ের কোলে..অশ্রু লুকাই মায়ের আঁচলে...যত আবদার মায়ের কাছে। যত চাওয়া সব মায়ের কাছে। আবেগগুলোও ঝরে পড়ে মায়ের শিয়রে।
ঘুম থেকে উঠে বাবাকে খুঁজি। বাবা নেই। রেজাল্ট ভাল হয়েছে। দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরব। বাবা নেই। বন্ধুরা মেরেছে, খুব ব্যথা গায়ে। বিচার দিব কিন্তু বাবা নেই। আমার একটা ফুটবল দরকার, বাবাকে বলব। বাবা নেই। ঈদটা চলে এলো, ঈদগাহ যাব। বাবা পাশে নেই। নামাজ শেষে কোলাকুলি করব, বাবা নেই। স্যারের বাসায় সন্ধ্যা হয়ে গেছে, ফিরতে ভয় লাগছে-বাবাকে খুঁজি; বাবা নাই। সাইকেলটা চালাতে পারছিনা। কেউ একটু সাপোর্ট দিলে এক পা দুপা করে এগিয়ে যেতাম, পাশে বাবা নেই। মা খুব বকেছে, মেরেছে খুব জোরে, ব্যথায় জ্বর চলে এসেছে। মায়ের বিরুদ্ধে বিচার দিব কিন্তু বাবা নেই।
বাবারা আসলে থাকেনা। তারা থাকতে পারেনা। নারীদের মতো তাদের স্বামী নেই। সন্তান নেই। দায়িত্ব নেই! বাবা মানেই রাগ। শাসন। অনেক বকে একটুখানি মুচকি হাসি। বাবা আজ সত্তুরের দ্বারপ্রান্তে। বয়স আমাকেও ক্ষমা করেনি। ক্ষমা করেনা কখনো।
মিটিং চলছে। অনলাইন মিটিং। সেলিব্রেশনের আমেজ। প্রাপ্তির উৎযাপন। চোখে মুখে আনন্দের ঢেউ। চারিদিকে খুশির ঝিলিক। হঠাৎ একটা বাক্য কানে এসে বিঁধল। একেবারে শেলের মতো। ‘বাবাদের স্বামী থাকেনা। সন্তান থাকেনা।’মনে হল খুব চেনা কথা। চেনা সুর। চেনা অনুভূতি। ঠিকইতো। কতবার ভেবেছি এই কথাটা। এতো সুন্দর করে কেউ বলেনি আগে। কত সাজানো কথা। কত সুন্দর কথা। সত্য কথা। অথচ আমার মনটা কেমন প্রতিবাদী হয়ে উঠল। আহত হল। বাম পাজরে চিন চিন একটা ব্যথা। বুকে চাপ চাপ ভাব। বোবা কান্নার অস্থীর আনাগোনা।
চোখের সামনে বাবাকে দেখলাম। আমি বিচারকের আসনে। বাবা কাঠগড়ায়। আসামির কাঠগড়ায়। মলীন একটা মুখ। মুখটা কালো হয়ে গেছে। ঠিক কালো না, পুড়ে গেছে। রোদের মধ্যে ফিল্ড ওয়ার্ক করতে যেয়ে। চেহারা ভেঙে গেছে। শিরাগুলো ফুলে আছে। ওজনও নাই আগের মতো। খেতেও পারেনা দ্রুত। কক্সবাজারে খাচ্ছিলাম। হরেক রকমের খাবার। বাবার আপত্তি, সব খাবার আর চিবুতে পারেন না তিনি। দাঁতে ব্যথা হয়। বললাম হাঁটো না আর? বাবার পজিটিভ উত্তর। হাঁটি। দৌড়? না দৌড়াতে পারিনা। কবে শেষ দৌড় দিয়েছে মনে নেই।
অনেক কথা হলো। ঢাকার কথা, গ্রামের কথা। কথায় কথায় বলেই ফেললাম, এবার বাড়ি গেলে কিছু গাছ লাগাইও। শুনে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। ‘গাছ লাগাতে ভালই লাগে আমার, কিন্তু এখন গাছ লাগালে মনে হয় কী লাভ! কবে বড় হবে। কবে ফল হবে। সে ফলতো খাওয়া হবেনা।’ধমক দিয়ে বললাম, কি যে বল। কারো জীবনেরই তো গ্যারান্টি নাই। আমিও চলে যেতে পারি তোমার আগে। বাবা হাসলেন। প্রসঙ্গ পাল্টালেন।
সামনেই সমুদ্র। মাকে পাশে নিয়ে সমুদ্রের দিকে হাঁটছি। বাবাকে দেখা যাচ্ছেনা। অনেক পিছে। বালিতে হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে তাঁর। কষ্ট হছে রোদে তাকাতেও। বারবার থামছি। একসাথে সমুদ্র দেখব বলে। কতবার দেখেছি এই সমুদ্র, কিন্তু আজ যেন একটা ভিন্ন সমুদ্র দেখছি। বাবা একদিকে, মা অন্যদিকে। পায়ে এসে সমুদ্রের ঢেউ আছড়ে পড়ল। গায়ে শিহরণ। শিহরিত হল মনটাও।
সমুদ্রের দিকে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে মা আমার হাত শক্ত করে ধরল। চোখে মুখে বিষ্ময় ফেটে পড়ছে! ‘বাবা, তুই এই সমুদ্র পাড়ি দিছিস। করছিস কি তুই! কিভাবে এখানে সাঁতার কাটছিস। আমারতো দেখেই ভয় লাগছে!’
মুচকি হেসে উড়িয়ে দেওয়ার ভান করলাম। মুখে শব্দ নেই আমার। ভাবছি। আমিতো মহা ভাগ্যবান কেউ। তাই এখনো প্রতিদিন সাঁতার কাটি বাবা-মা নামক মহাসমুদ্রে। দুনিয়ার কোন সমুদ্র তাই ভয় লাগেনা।
মা সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো। তাঁর প্রতিটা ঢেউয়ে আন্দোলিত হই নতুন করে। আর বাবা? তিনি হলেন-তীর বয়ে ছুটে চলা ঐ ঝিরিঝিরি বাতাসের মতো। শুধু অনুভব করা যায়। ধরা যায় না, ছোয়া যায় না কিংবা ঐ আকাশটার মতো। কত দূরে। তবুও ছেয়ে আছে ছাদের মতো। পুরোটা এই আমি জুড়ে।
বাবাও আমার তেমনি একটা ছাদ। মস্ত বড় ছাদ। রোদ বৃষ্টি ঝড়ে কতভাবে আগলে রেখেছেন আমাকে। কত যতনে। যেদিন থাকবেন না এই পৃথিবীতে, সেদিনই এই ছাদটা সরে যাবে। অসীম শূন্যতায় ভাসব আমি; ভয়ংকর এক শূন্যতা। যাদের কোলে মাথা রেখে এই পৃথিবী দেখা, বেড়ে উঠা। কি অবাক এই নিয়ম! তাঁদেরকে ছেড়ে সন্তানরা কিভাবে বাঁচে? এতো প্রিয় সন্তানকে ফেলে রেখে তারাই বা কিভাবে চলে যায়! ওপারে কি বাবা মায়ের সাথে দেখা হয়?
হায় জীবন! বাবা একা বসে আছেন আনমনে। মনে হলো-এক দৌড়ে তার পাশে যাই। জড়িয়ে ধরি। চিৎকার করে বলি, ‘আমার এই জীবনের সবটুকু জুড়ে মা। তারচেয়েও বেশিটুকু তুমি বাবা। মাকে সবটুকু ভালোবাসি। তোমার প্রতি ভালোবাসাটা তার এক বিন্দুও কম না। বয়স হয়েছে। মেঘের আড়ালে অনেক সময় চাপা পড়ে গেছে। অনুভূতিগুলো তাই ওভাবে প্রকাশ করা হয় না। লজ্জা সংকোচেরা জিতে যায় শুধু। জীবন একটা মায়া। বড্ড মায়া। মায়ার এ সাগরটায় মা ও বাবা থাকে সমানভাবে।
এইচ
