২২ কোটি টাকার জিন থেরাপি: সন্তোষজনক উন্নতির দিকে শিশু রাইয়ান

সম্প্রতি ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস ও হাসপাতালে রাইয়ান নামে এক শিশুকে ২২ কোটি টাকা দামে ওষুধ দিয়ে জিন থেরাপি প্রয়োগ করা হয়েছে। এর মাধ্যমে দেশের চিকিৎসাবিজ্ঞানের নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। একদল চিকিৎসকের অক্লান্ত পরিশ্রম ও সাধনায় এটি সম্ভব হয়েছে।
জিন থেরাপি প্রয়োগ নিয়ে মানুষের মধ্যে এখনও নানা কল্পনা-জল্পনা রয়েছে। দেশে এই চিকিৎসার সমস্যা ও সম্ভাবনাসহ এর আদ্যোপান্ত জানতে কথা হয় জিন থেরাপি প্রয়োগকারী চিকিৎসক দলের সদস্য ও প্রতিষ্টানটির পেডিয়াট্রিক নিউরোলজি বিভাগের নবজাতক, শিশু ও কিশোর রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. চৌধুরী মুহাম্মদ ফুয়াদ গালিবের সঙ্গে। আলোচনায় উঠে এসেছে জিন থেরাপির নানা দিক। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সাখাওয়াত হোসাইন।
মেডিভয়েস: জিন থেরাপি প্রয়োগ করা শিশুটিকে কিভাবে পেলেন?
ডা. গালিব: শিশুটির নাম রাইয়ান। বাড়ি মানিকগঞ্জ জেলায়। তাঁর বয়স ২৩ মাস। শিশুটি একটি বিরল ও জটিল রোগে ভুগছিল, যাকে আমার বলি স্পাইনো মাসকুলার এট্রোপি (এসএমএ)। এর তিনটি ধরন রয়েছে। শিশুটি অন্যান্য শিশুদের মতো স্বাভাবিক জন্ম হয়েছে। জন্মের পর বাকি শিশুদের মতোই কান্নাকাটি করেছে। মায়ের বুকের দুধও খেয়েছে। সব কিছুই ঠিক-ঠাক আছে। কিন্তু কিছু দিন পর দেখা গেল, যে বয়সে তার গাড় শক্ত হওয়ার কথা। সাধারণত তিন থেকে চার মাস বয়স থেকে শিশুদের ঘাড় শুক্ত হয়। কিন্তু এই শিশুর ঘাড় শক্ত হচ্ছিল না। ঠিক মতো বসতে পারছে না, ধরে রাখলে পড়ে যায়। ১০ মাস বয়সে শিশুটি গামাগুড়ি দেওয়ার কথা, কিন্তু তা করছে না। তখনই সন্দেহ জাগলো, ভালোভাবে কথা বলতে পারছে না। তার বেড়ে ওঠা অন্য ১০টি শিশুর মতো হচ্ছে না।
ঠিক তখনই রাইয়ানের বাবা-মা চিকিৎসকের কাছে যান। তখন চিকিৎসক সন্দেহ করেন তাঁর এই রোগটি হতে পারে। এর পর তাকে নিউরোসায়েন্স হাসপাতালে পাঠানো হয়, এখানে সে অধ্যাপক ডা. নারায়ণ সাহার অধীনে চিকিৎসাধীন ছিল।
অধ্যাপক ডা. শেখ আজিমুল হক ও ডা. জোবায়দা পারভীনের নিরলস পরিশ্রমে শিশুর রোগটি শনাক্ত হয়। এই শিশুরোগ ধরা পড়তে এক বছরের মতো সময় লেগেছে। আর জেনিটিকের পরীক্ষা-নিরীক্ষা এখনও বাংলাদেশে সহজলভ্য নয়। ফলে স্যাম্পেল নিয়ে পার্শ্ববর্তী দেশের ল্যাবে পরীক্ষা করা হয়েছে। আর সেখানেই এই রোগটি শনাক্ত করা হয়।
মেডিভয়েস: জিন থেরাপি প্রয়োগ করে এই রোগ থেকে ভালো হওয়ার সম্ভাবনা কতটুকু?
ডা. গালিব: চিকিৎসা নিলে এই রোগ থেকে শতভাগ সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ জিন থেরাপি এমন একটা পদ্ধতি, যার মাধ্যমে ক্রটিপূর্ণ জিনগুলোকে প্রতিস্থাপন করে দেওয়া হয়। আর চিকিৎসা না করলে ভালো হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। এই রোগে মৃত্যু অনিবার্য। বিরল রোগে আক্রান্ত শিশুরা খুব বেশি দূর এগোতে পারে না।
এই রোগে আক্রান্ত শিশুর অনেক অভিভাবক বুঝতেই পারেন না যে, তার শিশু এই রোগে আক্রান্ত। বুঝে ওঠার আগেই অনেক শিশু হারিয়ে যায়। নিউরোসায়েন্স হাসপাতালে সন্দেহজনক এই রোগে আক্রান্ত প্রায় ৫০ জন শিশুকে পাওয়া গেছে। তাদের মধ্যে ৩০ জনকে চিকিৎসায় আমরা অনেক দূর এগিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছি।
মেডিভয়েস: এ রোগ থেকে বাঁচার উপায় বা পূর্ব সতর্কতা নিয়ে জানতে চাই?
ডা. গালিব: রোগটি থেকে বাঁচার জন্য পূর্ব কোনো সতর্কতা নেই। শিশু যে ঘরেই জন্মগ্রহণ করুক, বুঝতে হবে, জিনটা বাবা-মা থেকেই এসেছে। প্রচ্ছন্ন দুটি জিন এসে প্রকট আকারে প্রকাশিত হয়েছে। এই দম্পতির জন্য সতর্কবার্তা হলো, তাদের ঘরে আর কোনো বাচ্চা জন্ম নিলে তারও এ রোগের ঝুঁকিতে থেকে যায়।
মেডিভয়েস: শিশুটিকে আর কতদিন আপনাদের তত্ত্বাবধানে রাখবেন?
ডা. গালিব: রাইয়ান এখন খুবই ভালো আছে। হাসিখুশি এবং খুব লাজুক। তার অবস্থা উন্নতির দিকে। আমরা তাকে নিয়ে খুবই আশাবাদী। সাধারণত কয়েক মাসের মধ্যে উন্নতি দেখা যায়। কয়েক মাসের মধ্যে তার মাথা শক্ত হবে এবং সুন্দর করে হাটতে পারবে।
মেডিভয়েস: বিরল রোগের চিকিৎসক দলের সদস্য হতে পেরে আপনাদের কাছে এখন কেমন লাগছে?
ডা. গালিব: আমাদের কাছে খুবই ভালো লাগছে। বাংলাদেশের মেডিকেল সায়েন্সের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো কোনো শিশুকে জিন থেরাপি প্রয়োগ করা হয়েছে। যাকে প্রয়োগ করা হয়েছে সে সুস্থ হয়ে উঠছে। এটা আসলে অন্য রকম একটা ভালো লাগা, যা বলে বোঝানো যাবে না। একটি শিশুর হাসি এবং তাকে হাসি মুখে যখন দেখবো, এর চেয়ে বড় পাওয়া আর নেই।
মেডিভয়েস: বর্তমানে শিশুটির অগ্রগতি বা সম্ভাবনা কতটুকু?
ডা. গালিব: রাইয়ান এখন খুবই ভালো আছে। বাংলাদেশে এই প্রথমবারের মতো জিন থেরাপি প্রয়োগ করা হয়েছে। এই চিকিৎসার বয়সও বেশি নয়। ২০১৫ সালে এই চিকিৎসা আমেরিকায় শুরু হয়েছে। তারপর থেকে প্রায় দুই হাজার ৩০০ শিশুর উপর এই চিকিৎসা প্রয়োগ করা হয়েছে। এই ওষুধটি তৈরি করেছে নোভার্টিজ কোম্পানি। আর এই কোম্পানির একটি অঙ্গীকার হলো, প্রতি মাসে দুটি শিশুকে লটারির মাধ্যমে বিনামূল্যে এই ওষুধ প্রয়োগ করবে। আমাদের ভাগ্য ভালো আমরা লটারির মাধ্যমে এই ব্যয়বহুল ওষুধটি পেয়েছি।
মেডিভয়েস: এই ওষুধটি এত ব্যয়বহুল হওয়ার কারণ কি?
ডা. গালিব: ওষুধটির দাম ধরা হয়েছে ২২ কোটি টাকা। কিন্তু এর উৎপাদন খরচ হয়েছে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার। ওষুধটি তৈরিতে কোম্পানির অনেক বড় প্রজেক্ট হাতে নিতে হয়েছে। ১০ থেকে ১৫ বছর রিচার্জ করতে হয়েছে। এখানে অনেক বড় বড় বিজ্ঞানী ও অনেক সায়েন্টিফিক প্রতিষ্ঠানকে অংশগ্রহণ ছিল। এই ওষুধটি অনেক দেশেই নিবন্ধিত না। বাংলাদেশেও ওষুধটির নিবন্ধন নেই। বিশেষ ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশে আনা হয়েছে। এই ওষুধের স্বাভাবিক ট্যাক্স-ই আসবে এক কোটি টাকা।
মেডিভয়েস: জিন থেরাপি চিকিৎসায় খরচ কমানোর উপায় এবং নিয়মিত করার কোনো পদক্ষেপ আছে কিনা?
ডা. গালিব: দেশে প্রথমবারের মতো দেওয়া হয়েছে। পরবর্তীতে আবারও আমরা লটারির মাধ্যমে আবেদন করবো। আমাদের পার্শ্ববর্তী কয়েকটি দেশ অনেক আগ থেকেই এই লটারিগুলোতে অংশগ্রহণ করছে। আমাদের শিশুদের মধ্যে এই রোগটা শনাক্ত করতে পারলে আমাদেরও লটারির মাধ্যমে বিনামূল্যে চিকিৎসা পাওয়ার সুযোগ বেড়ে যাবে।
এই ওষুধগুলো হলো রিসার্চ মনিউকুল। পাঁচ বছর বা দশ বছর পর একটা সময় আসবে। আশা করি, পর্যায়ক্রমে এর খরচ কমে যাবে। সময়ের ব্যবধানে যেকোনো ওষুধেরই মূল্য কমে যায়। আজকে আমরা যে ওষুধটি এক হাজার টাকা দিয়ে কিনছি, সেটা ১০ বছর আগে হয়তো বিশ হাজার টাকা দিয়ে কেনা লাগতো। এই ওষুধের ব্যবহার বাড়লে উৎপাদন বাড়বে, ট্যাক্স কমে যাবে। তখন এই ওষুধের দাম কমে যাবে। ধরেন, আজকে ২২ কোটি টাকা দামের মূল্যবান ওষুধ, হয়তো ১০ বছর পর এক কোটি টাকায় নেমে আসবে। আর তখন এক কোটি টাকা দিয়ে ওষুধ দেওয়ার মতো অনেক মানুষ থাকবে।
-
০৫ নভেম্বর, ২০২২
-
২৫ অক্টোবর, ২০২২