
ডা. মো. তরিকুল হাসান
রেসিডেন্ট, নিউরোলজি বিভাগ,
ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল।
০২ নভেম্বর, ২০২২ ১০:০১ এএম
মৃত্যু

রাত ২টা ২৪ মিনিটে মারা গেলেন নেকজান বিবি। তার বড় ছেলে হুরমত আলী বড় বিপদে পড়ে গেলো। লোকজন তিন দিন আগে গঞ্জ থেকে হাজার তিনেক টাকা তুলে জোর করে শহরের বড় হাসপাতালে পাঠিয়েছিল। এত বড় দালান কোঠা আগে কোনো দিন দেখেনি হুরমত! প্রথম দিন এসেই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো সে। ঢুকতেই লাইনে দাঁড়াতে হলো। সেখানে টাকা দিয়ে একটা বড় সরকারি কাগজ কিনতে হলো। সেখানে তার নাম বৃত্তান্ত সব লেখা হলো। সেই কাগজ নিয়ে পাশের একটা লম্বা রুমে যেতে হলো। সেই রুমে একটা লোক ঝিমাচ্ছিল।
সে বিরক্ত কণ্ঠে বলল, কি সমস্যা?
-অ্যা!
-কি অসুবিধা?
-না কুন অসুবিদা নাই। আফনে বালা আছুইন!
পাশ থেকে একটা গুন্ডা চেহারার লোক বলল, ধুর মিয়া! স্যাররে, রোগীর সমস্যা বলেন!
-ইস্টক করছে! মাতায় পেশার উটছিলো, পরে ইস্টক করছে!
উত্তর শুনে সেই বড় কাগজে কি যেন লিখে দেয়া হলো। তারপর সেই কাগজ নিয়ে একটা লোক লোহার বিছানায় করে নেকজান বিবিকে নিয়ে কোথায় কোথায় ঘুরে একটা বড় রুমে নিয়ে এলো। আশেপাশে তিল পরিমাণ জায়গা ফাঁকা নেই। যে যেখানে পেরেছে বিছানা পেতে নিয়েছে। হাটা চলা করা যাচ্ছে না। এমনকি বারান্দায়ও রোগীতে সয়লাব। সেখানে কাগজটা নিয়ে একটা মহিলাদের রুমে যেতে হলো। তারপর সেই কাগজে তারা আরও কি সব লিখলো। আর তাতে আরেকটা সাদা কাগজ লাগানো হলো।
এরপর নেকজান বিবিকে পাশের রুমে নেওয়া হলো। সেখানে অল্পবয়সী কয়েকজন চিকিৎসক হুরমতকে অনেকক্ষণ ধরে অনেক প্রশ্ন করতে লাগলো। কিছুক্ষণের মধ্যে নাকে নল, প্রস্রাবের নল, শিরায় জলের ব্যবস্থা হয়ে গেলো। নানান বখশিশে পকেটের দফা রফা হতে লাগলো। কেন আরও আগে রোগীকে আনা হয়নি, হুরমতকে সেই কৈফিয়ত দিতে হলো।
গত তিন দিনে হুরমতের উপর অনেক ঝড় গেছে। মনের বয়স বেড়ে গেছে বহু। এখানে সেখানে দৌড়ঝাঁপ করে তার বহু শিক্ষা হয়েছে। হাসপাতালে তার দুঃসম্পর্কের এক চাচার খোঁজ পাওয়া গেলো। সে তাকে অনেক বুঝালো, আরে সরকারি হাসপাতালের টেস্ট করতে গেলে কত ঝামেলা! সেই চাচা তার পরিচিত এক প্রাইভেট ক্লিনিকে সব টেস্ট বিশেষ ডিসকাউন্টে করার ব্যবস্থা করে দিলো। সেই রিপোর্ট দেখে কেন জানি ডাক্তারদের পছন্দ হলো না।
অবশেষে নেকজান বিবি রাত ২টা ২৪ মিনিটে মারা গেলেন। ডাক্তার অনেকক্ষণ পরীক্ষা করে হুরমতের ঘাড়ে হাত দিয়ে বললেন, আর কোনো আশা নেই।
এই রাতে হুরমত এখন লাশ নেবে কিভাবে? পকেটে তার এখন দুইশো তেপ্পান্ন টাকা আছে। রহিমা ফুপিয়ে কেঁদে যাচ্ছে। হুরমত মনভরে কাঁদতেও পারছে না। দুইশো তেপ্পান্ন টাকায় বাড়ি যাওয়ার অংক করতে হচ্ছে তাকে। ট্রেনের ভাড়া ৩ জন ৩৫ টাকা করে একশো পাঁচ টাকা। আচ্ছা, নেকজান বিবি তো মারাই গেছে। মরা মানুষেরও ট্রেনের টিকিট কাটতে হয়?
হুরমতের বিপদ বাড়ে। এখানে সেখানে আরও টাকা খরচ হয়ে যায়। লাশ নিতে গেলেও নাকি বখশিশ দিতে হয়! রেল স্টেশনটা এই শেষ রাতেও লোকে লোকারণ্য। লোকজন লাশ দেখে ভিড় করে। একজন বলে উঠে, ট্রেনে নাকি লাশ নেওয়ার নিয়ম নেই। শুনে হতভম্ব হয়ে যায় হুরমত। এখন উপায়? লোকজনের হাতে-পায়ে ধরে সে। একটা বগিতে উঠতে দেওয়া হয় তাদের।
ট্রেন চলতে শুরু করে। ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। মৃদু রোদে মাতাল হাওয়ার তোড়ে ট্রেনটা ভেসে চলে। হুরমত দরজায় দাঁড়ায়। বাতাসের ঝাপটায় এবার তার মনে শোকের ছায়া ফিরে আসে। হ্যা এখন কান্না করা যায়! মাগো! উথাল-পাতাল কান্না শুরু করে সে!
-
০২ নভেম্বর, ২০২২
-
৩১ অক্টোবর, ২০২২
-
১৬ ডিসেম্বর, ২০২১