২৬ অক্টোবর, ২০২২ ১২:৩৭ পিএম

বিশ্বে ২য়, দেশে ৩য় মৃত্যুর কারণ স্ট্রোক

বিশ্বে ২য়, দেশে ৩য় মৃত্যুর কারণ স্ট্রোক
দেশে প্রতি হাজারে ১২ জন মানুষ স্ট্রোকে আক্রান্ত এবং স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে বিশ্বে প্রতি মিনিটে দশ জন প্রাণ হারাচ্ছেন।

মেডিভয়েস রিপোর্ট: বিশ্বে দ্বিতীয় ও বাংলাদেশে তৃতীয় মৃত্যুর কারণ স্ট্রোক। উচ্চরক্তচাপ স্ট্রোকের প্রধান কারণ। তাই উচ্চরক্তচাপে আক্রান্তদের নিয়মিত ওষুধ খেতে হবে। কারও স্ট্রোক হলে সময় ক্ষেপণ না করে দ্রুততম সময়ে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হলে জীবন রক্ষা করা সম্ভব।

বিশ্ব স্ট্রোক দিবস উপলক্ষে আজ বুধবার (২৬ অক্টোবর) ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের নিউরোলজি বিভাগের আয়োজনে বৈজ্ঞানিক ওয়ার্কশপ ও সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানানো হয়।

বাংলাদেশ সোসাইটি অব নিউরোসার্জন্সের সহযোগিতায় অনুষ্ঠিত এ আয়োজনে আরও জানানো হয়, দেশে বেশি মানুষ মারা যায় সড়ক দুর্ঘটনায়। এরপর দ্বিতীয় ও তৃতীয় মৃত্যুর কারণ হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোক।

দেশে স্ট্রোকে মৃত্যুর হার চার গুণ বেড়েছে উল্লেখ করে বক্তারা বলেন, উচ্চরক্তচাপ স্ট্রোকের সবচেয়ে বড় ঝুঁকির কারণ। তাই উচ্চরক্তচাপে আক্রান্তদের নিয়মিত ওষুধ খেতে হবে। এতে ব্যত্যয় ঘটলে স্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়ার সমূহ আশঙ্কা রয়েছে।

এতে আরও জানানো হয়, দেশে প্রতি হাজারে ১২ জন মানুষ স্ট্রোকে আক্রান্ত এবং অসংক্রামক এ ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে বিশ্বে প্রতি মিনিটে দশ জন প্রাণ হারাচ্ছেন।

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে ঢামেক হাসপাতালে ব্যাপক সংখ্যক রোগীর মেঝেতে অবস্থান করে চিকিৎসা নেওয়ার ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করেন বাংলাদেশ সোসাইটি অব নিওরোসার্জন্সের সভাপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) নিউরোসার্জারি বিভাগের অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ হোসেন।

তিনি বলেন, ‘নিওরোসার্জারির রোগীদের ব্যবস্থাপনা ও চিকিৎসা সেবায় আমরা কতটুকু এগুতে পেরেছি? সরকারের কাছে আমরা নিওরোসার্জারির চিকিৎসার গুরুত্ব কতটা বোঝাতে সক্ষম হয়েছি? আমার মনে হয়, পারিনি। আর সে কারণেই এই সময়ে এসেও আমাদের শয্যার দাবি করতে হচ্ছে। স্ট্রোকের রোগীদের চিকিৎসা সাড়ে চার ঘণ্টার মধ্যে করতে হয়। তা না হলে রোগীর মস্তিষ্ক স্থায়ীভাবে অকেজো হয়ে যায়। কখনো নিওরোসার্জারি, কখনো বা দ্রুত বাইপাস সার্জারিও করতে হয়।’

দেশে নিওরোসার্জারি চিকিৎসার অভাবনীয় উন্নতির কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, এতো দিন মানুষ হার্টের বাইপাস সার্জারির খবর শুনেছেন। খুশির খবর হলো, বর্তমানে বাংলাদেশের তরুণ নিওরোসার্জনরাও ব্রেইনের বাইপাস করছেন।’

স্ট্রোকের চিকিৎসায় দেশে এখনো ভালো মানের হাসপাতাল গড়ে ওঠেনি মন্তব্য করে তিনি বলেন, ঢাকা মেডিকেল, বিএসএমএমইউ ও ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিওরোসায়েন্স হাসপাতালের পাশাপাশি কিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে স্ট্রোকের চিকিৎসা চালু আছে। তবে সেখানেও সীমিত আকারেই চলছে।

বাংলাদেশ সোসাইটি অব নিওরোসার্জন্সের সভাপতি বলেন, এখনো প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে স্টোকের চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হয়নি। এ কারণে বিকলাঙ্গ মানুষের সংখ্যা বেড়েছে। এসব মানুষের চিকিৎসার পাশাপাশি কীভাবে এ সমস্যা মোকাবিলা করা যায়, তা ভাবতে হবে। 

সাধারণত ষাটোর্ধ্ব মানুষের স্ট্রোক বেশি হয় জানিয়ে তিনি বলেন, তবে মধ্যবয়সীদের পাশাপাশি শিশুদেরও এ রোগ হতে পারে। 

অধ্যাপক মোহাম্মদ হোসেন বলেন, প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই উচ্চরক্তচাপ ও ডায়াবেটিসহ যেসব কারণে স্ট্রোক হয়, তা থেকে সচেতনভাবে নিজেকে রক্ষা করতে হবে। এজন্য সুশৃঙ্খল ও স্বাস্থ্যকর জীবন-যাপনে অভ্যস্ত হতে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে।

তিনি বলেন, অধ্যাপক আতা এলাহী খানের নেতৃত্বে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিওরোসার্জারির যাত্রা শুরু হয়। ১৯৯৭ সালে এখানে নিওরোসার্জারি বিভাগে এমএস কোর্স চালু হয়। আজ নিওরোসার্জারির মাদার ইনস্টিটিউট হিসেবে কাজ করছে এ হাসপাতাল।

বাংলাদেশ সোসাইটি অব নিউরোসার্জন্সের সাধারণ সম্পাদক, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিউরোসার্জারি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, মস্তিষ্ক একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ, এটি আক্রান্ত হলে দেহের সব ব্যবস্থাপনা ভেঙে পড়ে। তাই মস্তিষ্কের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে।

ঢাকা মেডিকেলে স্ট্রোকের চিকিৎসার সক্ষমতার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘আমরা ঢাকা মেডিকেল কলেজে অত্যাধুনিক ক্যাথল্যাব পেয়েছি। ক্যাথল্যাবে কাটা-ছেড়া ছাড়া স্ট্রোকের চিকিৎসা করা হয়। অনেক রক্তক্ষরণজনিত স্ট্রোকের বিশ্ব মানের চিকিৎসা এখানে হয়।’ 

তবে নিউরোসার্জারি বিভাগের পরিবেশ এখনো পুরোপুরি তৈরি হয়নি জানিয়ে তিনি বলেন, ‘পরিবেশ নিয়ে আমাদের পরিচালক কাজ করছেন। এটা দ্রুত পরিবর্তন হবে। আগামী বছর আশা করি, এ পরিবেশ এখনকার মতো থাকবে না। অনেকটা করপোরেট হাসপাতালের মতো হয়ে যাবে।’ 

স্ট্রোকের চিকিৎসায় অনেক দামি যন্ত্রপাতি দরকার হয় জানিয়ে তিনি বলেন, ‘ব্রেইন এনিউরিজমের চিকিৎসা করতে কয়েন লাগে, যা অনেক দামি। এ রকম দামি দামি জিনিসগুলো আমাদের জন্য ক্রয় করা হয়েছে। এর মাধ্যমে অনেক রোগী উপকৃত হচ্ছেন। এখানে স্ট্রোকের চিকিৎসার অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি আছে। ব্যয়সাপেক্ষ এসব চিকিৎসায় সরকার অনেক সহায়তা দিচ্ছে। আমরা আশা করি, ভবিষ্যতে এর পরিমাণ আরও বাড়বে। গত বছর আমরা এক কোটি পেয়েছি, এ বছর আরও ২/৩ কোটি বাড়বে বলে আমরা আশাবাদী। এখানে নামমাত্র মূল্যে প্রান্তিক অঞ্চলের জনগণ স্ট্রোকের চিকিৎসা পাবে।’

অনুষ্ঠানে শুভেচ্ছা বক্তব্যে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ডা. ফজলে এলাহি মিলাদ বলেন, ‘এখানে ভর্তি হওয়ার পর রোগীরা যেন শয্যা পান, এটা খুব জরুরি। যেসব রোগী মৃত্যুঝুঁকিতে আছেন, তারাই এখানে ভর্তি হন। তাদের একটি শয্যা দিতে না পারার মতো ব্যর্থতা আর হতে পারে না। তাই শয্যা বাড়ানোর জন্য হাসপাতালের পরিচালক মহোদয়ের কাছে জোর দাবি জানাচ্ছি।’

এ ব্যাপারে হাসপাতালের পরিচালক তাঁর প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখবেন বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করেন অধ্যাপক ফজলে এলাহি মিলাদ।

ঢামেকের সার্জারি বিভাগ স্ট্রোক নিয়ে দীর্ঘ দিন ধরে কাজ করে আসছে জানিয়ে তিনি বলেন, এই ভবনের দুইতলায় স্টোকের অপারেশন থিয়েটার অ্যান্ড কমপ্লেক্স নির্মাণের ব্যাপারে আলোচনা হয়েছে। সেই কাজটি যেন দ্রুততার সঙ্গে যেন শুরু হয়। এটি হলে ঢামেকের স্ট্রোক ম্যানেজমেন্ট নতুন মাত্রায় উন্নীত হবে।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক হিসেবে প্রতিটি কাজ একান্ত নিজের মনে করে করেন বলে জানান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডা. মো. নাজমুল হক।

তিনি বলেন, ‘ঢামেকে যত দিন আছি, তত দিন সকল কাজ এভাবেই করবো। এখানে কর্মরত সবাইকে আমার পরম আপন মনে হয়। হাসপাতালের যে কোনো খারাপ পরিস্থিতি আমাকে কষ্ট দেয়। আমি অনুভব করি, বিষয়টি আমার ব্যর্থতা এবং এ নিয়ে আমার আরও কাজ করার সুযোগ ছিল।’

হাসপাতালের সামগ্রিক উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছেন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘নিওরোসার্জারিসহ অন্যান্য সকল বিভাগের উন্নয়নে আমি চেষ্টা করে যাচ্ছি। আপনারা সহযোগিতা করলে আরও সুন্দরভাবে ভালো ভালো কাজ করতে পারবো।’

তিনি বলেন, যারা ডাক্তারি পড়তে আসেন, তারা সবাই জনসেবার বিষয়ে অত্যন্ত নিবেদিতপ্রাণ। ডাক্তারি পড়াশোনা মানবিক কাজ। তারা বিষয়টি বুঝে, জনগণের সেবা দেওয়ার জন্যই আসেন। সুতরাং তাদের সঙ্গে কাজ করতে পারা বড় সন্তুষ্টির বিষয়। তাদেরকে সম্মান করি এবং তাদের জন্য সেভাবেই কাজ করতে চাই।

এ সময় সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, নিউরোসার্জিতে ৫০টি আসন বৃদ্ধি করা হবে। এজন্য কাজ চলমান আছে। সেই সঙ্গে ঢামেকে নতুন হতে যাওয়া স্ট্রোক সেন্টারে জনবলের অভাব হবে না জানিয়ে তিনি বলেন, তৃতীয় শ্রেণির জনবলের সংকট হতে পারে।

অনুষ্ঠানে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্ট্রোক চিকিৎসার চিত্র তুলে ধরেন নিওরোসার্জারির বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. অসিত চন্দ্র সরকার।

অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের প্রধান সমন্বয়ক অধ্যাপক ডা. সামন্ত লাল সেন, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অ্যানেসথেশিওলজি অ্যানালজেসিয়া অ্যান্ড প্যালিয়াটিভ বিভাগের অধ্যাপক ডা. মো. মোজাফফর হোসাইন।

পরিচালনায় ছিলেন নিউরোসার্জারি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. কানিজ ফাতেমা ইশরাত জাহান, একই বিভাগের দুই রেজিস্ট্রার ডা. সাইফুল হক ও ডা. ইসমে আজম জিকো। 

মেডিভয়েসের জনপ্রিয় ভিডিও কন্টেন্টগুলো দেখতে সাবস্ক্রাইব করুন MedivoiceBD ইউটিউব চ্যানেল। আপনার মতামত/লেখা পাঠান [email protected] এ।
  এই বিভাগের সর্বাধিক পঠিত
এক দিনে চিরবিদায় পাঁচ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক
করোনা ও বার্ধক্যজনিত অসুস্থতা

এক দিনে চিরবিদায় পাঁচ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক