বেড়েছে জীবন নির্বাহ ব্যয়, বাড়েনি ইটার্ন চিকিৎসকদের ভাতা

সাখাওয়াত হোসাইন: দেশে অব্যাহতভাবে বাড়ছে নিত্যপণ্যসহ সকল কিছুর দাম। ফলে জীবন নির্বাহের খরচ বেড়েছে কয়েকগুণ। কিন্তু গত কয়েক বছরেও বাড়েনি ইন্টার্ন চিকিৎসকদের ভাতা। ফলে কষ্টে কাটছে আশৈশব স্বাস্থ্যসেবার স্বপ্ন লালন করা এই নবীনদের জীবন। এ ধরনের নানা অনিশ্চয়তার কারণে নিজেদের প্রস্তুত করার পরও অনেকে অভিমানে শুরু করার আগেই ছেড়ে দিচ্ছেন চিকিৎসা পেশা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে ইন্টার্ন চিকিৎসকদের ভাতা বাড়ানো এখন সময়ের অনিবার্য দাবি। যদিও কবে বাড়বে শিক্ষানবিশ এসব চিকিৎসকদের ভাতা, এ নিয়ে কোনো আশার বাণী শোনাতে পারেননি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, মন্ত্রণালয় ও চিকিৎসক নেতৃবৃন্দ।
জানা গেছে, সরকারি মেডিকেলগুলো ইন্টার্ন চিকিৎসকদের প্রতি মাসে ১৫ হাজার টাকা করে ভাতা দেওয়া হয়। আর বেসরকারি মেডিকেলে ইন্টার্নশিপের জন্য হাসপাতাল থেকে কোনো ভাতা দেওয়া হয় না। ভর্তির সময় ইন্টার্ন ফি বাবদ কেটে রাখা ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা থেকে তাদের প্রতি মাসে ১৫ হাজার করে টাকা দেওয়া হয়।
ভাতা পর্যাপ্ত নয়
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের ইন্টার্ন চিকিৎসক পরিষদের (ইচিপ) সভাপতি ডা. কে এম তানভীর মেডিভয়েসকে বলেন, ‘আমাদেরকে যে ভাতা দেওয়া হয়, তা পরিপূর্ণ নয়। যে পরিমাণ দায়িত্ব পালন করতে হয়, তাতে এ ভাতা কোনোভাবে যৌক্তিক নয়। আমরা হাসপাতালে সারাক্ষণ দায়িত্ব পালন করি। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, সার্বিক দিক বিবেচনায় এখনই ভাতা বাড়ানো জরুরি। অনেকেই ইন্টার্নশিপের সময় বিয়ে করেন। তাদের পরিবারকে আর্থিক জোগান দেওয়া লাগে। বর্তমান বিবেচনায় ইন্টার্ন চিকিৎসকদের ভাতা কমপক্ষে ২০-২৫ হাজার টাকা করা উচিত।’
তিনি আরও বলেন, ‘হাসপাতালে রোগী ভর্তি থেকে শুরু করে সুস্থ হওয়া পর্যন্ত সকল পর্যায়ে একজন ইন্টার্ন চিকিৎসকের ভূমিকা রয়েছে। কারণ রোগী গ্রহণ, প্রতিদিন তাঁর ফলোআপ দেওয়াসহ নানান ধরনের কাজ থাকে প্রতিটি বিভাগে। যদিও ইন্টার্ন চিকিৎসকরা একজন তত্ত্বাধায়কের অধীনে সকল কাজ করে থাকে।’
চট্টগ্রাম মেডিকেলের ইচিপ সভাপতি আরও বলেন, ‘সত্যি কথা বলতে, একজন রিকশাওয়ালার শারীরিক পরিশ্রম অনেক। কিন্তু মানসিক কোনো পরিশ্রম করা লাগে না। আর একজন কর্মকর্তাকে মানসিক পরিশ্রম করতে হয়। আর একজন চিকিৎসককে শারীরিক ও মানসিক উভয় পরিশ্রমই করতে হয়। উদাহরণ হিসেবে বলবো, গত ২২ মে সারারাত আমার দায়িত্ব ছিল পেডিয়াট্রিক বিভাগে। রাতে ঘুম দূরে থাক, রোগীর চাপে একটু চেয়ারে বসে কাজ করারও সুযোগ হয়নি। এখানে আমাকে ওয়ার্ডে দৌঁড়াতে হয়েছে, শারীরিক ও মানসিক উভয় পরিশ্রমই করা লাগছে। সব মিলিয়ে ইন্টার্ন চিকিৎসকদের উপর চাপটা একটু বেশি পড়ে।’
তিনি আরও বলেন, ‘চট্টগ্রামে যে হোস্টেলে ইন্টার্ন চিকিৎসকরা থাকেন, সেটা একেবারেই বসবাসের উপযুক্ত নয়, তারপরও আমাদেরকে কষ্ট করে থাকতে হচ্ছে। যেহেতু আমরা অন্য জেলা থেকে এখানে পড়াশোনা করতে আসছি। আর একজন ইন্টার্ন চিকিৎসক নিজে চলার জন্য কমপক্ষে ১০-১২ হাজার টাকা খরচ হয়। সেখান থেকে এত কম ভাতায় পরিবারকে সহযোগিতা করা বা অন্যান্য বিষয়গুলোতে মনোযোগ দেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। বিভিন্ন জিনিসপত্রের দাম অনেক বেশি। সরকারের উচিত আমাদেরকে আরও বেশি মূল্যায়ন করা।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা যারা মেডিকেলে পড়তে আসি, তাদের মধ্যে ৯০ শতাংশকে জিজ্ঞেস করলে বলবে আমরা মানুষের সেবা করার অদম্য ইচ্ছা নিয়ে এই পেশায় আসছি। আমাদের যতই পরিশ্রম হোক, একটা রোগী যখন হাসপাতাল থেকে হাসতে হাসতে হাসপাতাল থেকে বের হয়, এটা একটা আলাদা অনুভূতি। এ অনুভূতির কাছে আসলে টাকা পয়সা কোনো বিষয় নয়। যেহেতু আমাদের সংসার-পরিবার সব কিছু চালাতে হয়, তাই আমাদের পারিশ্রমিকটা আরও বাড়ানো উচিত। অন্যান্য পেশার তুলনায় ইন্টার্নদের ভাতা অনেক কম।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রাজধানীর বারডেম হাসপাতালের একজন ইন্টার্ন চিকিৎসক বলেন, ‘বাংলাদেশে যতগুলো গ্রাজুয়েশন কোর্স আছে সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদি হলো এমবিবিএস কোর্স। সবাই চার বছরের কোর্স করে, আর আমাদেরটা পাঁচ বছরের। আর সেই সাথে এক বছরের ইন্টার্নসহ মোট ছয় বছর লাগে। একই সাথে আমার একটা বন্ধু অন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়ে, তার এক বছর আগে গ্রাজুয়েশন হয়ে যাচ্ছে। তার হয়তো চাকরি বা বিসিএস হয়ে যাচ্ছে। সেই জায়গায় থেকে আমরা যখন পাস করে বের হই, বিশেষ করে মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের যারা আছে, তাদের উপর একটা চাপ পড়ে। পরিবারকে আর্থিকভাবে সহযোগিতা করা লাগে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের মেডিকেল সেক্টরটা একটা প্রেশারাইজড সিস্টেম। যা যেকোনো পরিস্থিতির সাথে মেনে নেওয়ার জন্য প্রস্তুতি নেওয়া হয়। আমরাও সব পরিস্থিতি মেনে নেওয়ার চেষ্টা করি।’
খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ইচিপ সভাপতি সৈকত ঘোষ বলেন, ‘ইন্টার্নদের ভাতাটা পরিশ্রমের তুলনায় নগণ্য। তারা হলো হাসপাতালের প্রাণ। বেশির সময় তারাই হাসপাতালে থাকেন। এখন দ্রব্যমূল্যের যে ঊর্ধ্বগতি ও দেশের সার্বিক পরিস্থিতির সাথে ভাতাটা ঠিক নয়। মনে করেন, আরও কয়েক বছর আগে খুলনা মেডিকেল কলেজ থেকে পাশেই নিউমার্কেট যেতাম পাঁচ টাকা ভাড়া দিয়ে। এখন সে ভাড়া হয়ে গেছে ১০ টাকা। কিন্তু আমাদের তো ভাতা বাড়েনি। আমাদের সবার জন্য চলাটা খুবই কষ্টকর।’
তিনি আরও বলেন, ‘ভাতা বাড়ানোর বিষয়ে অনেক দিন আগে থেকে আমরা চিন্তা করে আসছি। অলিখিতভাবে বিভিন্ন জায়গায় বাড়ানোর জন্য বলেছি। এ ভাতাতে আমরা সন্তুষ্ট নয়।’
বেসরকারিতে ইন্টার্ন ভাতা নেই
বেসরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কর্মরত একাধিক ইন্টার্ন চিকিৎসক মেডিভয়েসকে জানান, বেসরকারিতে ভর্তির সময় শিক্ষার্থীর কাছ থেকে ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা ইন্টার্ন ফি নেওয়া হয়। ইন্টার্নশিপের সময় এখান থেকে প্রতি মাসে তাদের ১৫ হাজার করে টাকা দেওয়া হয়। আর যারা ইন্টার্ন ফি দেন না, তাদেরকে নাম মাত্র ৬ হাজার টাকা ভাতা দেওয়া হয় আবার অনেক সময় কোনো ভাতা দেওয়া হয় না।
তারা আরও জানান, কোনো কোনো বেসরকারি মেডিকেল কলেজে অনুমতি ছাড়া বা ১৫ দিনের অতিরিক্ত ছুটি কাটালে দৈনিক হিসাবে কাটা হয় ভাতা।
এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক ভিসি অধ্যাপক ডা. কামরুল হাসান খান মেডিভয়েসকে বলেন, ‘বেসরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলোতে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ভর্তির সময় ইন্টার্ন ফি আদায় করা উচিত নয়। কারণ তারা তো ইন্টার্নির সময় একটা সার্ভিস দেন। যেহেতু বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে রোগীদের কাছ তাদের একটা উপার্জন আছে। হাসপাতালের যে আয় রয়েছে, সেই আয় থেকে ইন্টার্নিদের ভাতা দেওয়া উচিত।’
ইন্টার্নদের জন্য আলাদা হোস্টেল জরুরি
প্রতিটি সরকারি-বেসরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কর্মরত ইন্টার্ন চিকিৎসকদের জন্য আলাদা হোস্টেলের ব্যবস্থা থাকা উচিত বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। যদিও কয়েকটি মেডিকেল কলেজ ছাড়া অধিকাংশ মেডিকেলে ইন্টার্নদের জন্য আলাদা হোস্টেলের ব্যবস্থা নেই। ফলে ইন্টার্নশিপের সময় তাদেরকে থাকতে হয় এমবিবিএস শিক্ষার্থীদের সাথে। এতে নিরবচ্ছিন্ন প্রশিক্ষণে ঘাটতি দেখা দেয়। আবার অনেক বেসরকারি মেডিকেল কলেজে এমবিবিএস শেষ করার পর তাদেরকে হোস্টেল থেকে বের করে দেওয়া হয়। ফলে ইন্টার্নশিপের সময় তাদের থাকতে হয় বাসায় বা মেসে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রাজধানীর ইব্রাহিম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কর্মরত ইন্টার্ন চিকিৎসক বলেন, ‘আমাদের মেডিকেলে ইন্টার্ন চিকিৎসকদের জন্য কোনো ধরনের হোস্টেল সুবিধা নেই। তবে এমবিবিএসের শিক্ষার্থীদের জন্য হোস্টেল সুবিধা আছে। ইন্টার্নশিপের যার যার মতো মেসে বা বাসায় থাকতে হয়।’
অধ্যাপক ডা. কামরুল হাসান খান বলেন, ‘ইন্টার্ন চিকিৎসকরা হলো রেসিডেন্সিয়াল। রোস্টারে আট ঘণ্টা দায়িত্ব থাকলেও পূর্ণ সময় তাদের কাজ করতে হয়। প্রত্যেক ইন্টার্ন চিকিৎসকদের জন্য আলাদা হোস্টেলের ব্যবস্থা থাকতে হবে। আবার যেখানে আলাদা হোস্টেলের ব্যবস্থা আছে, কিন্তু পর্যাপ্ত সুবিধা নেই, সেখানে সকল সুযোগ-সুবিধাসহ প্রত্যেক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ইন্টার্নি হোস্টেল থাকতে হবে। সেই সাথে ভালো ব্যবস্থাপনা থাকতে হবে। তারা যে পরিশ্রম করে বিশ্রামের একটা প্রয়োজন আছে, ঘুমের প্রয়োজন আছে। খাবার ও লেখাপড়ার প্রয়োজন আছে। সব ধরনের সুযোগ-সুবিধাসহ প্রত্যেকটি মেডিকেল কলেজে ইন্টার্নি হোস্টেল থাকা উচিত।
ভাতা বাড়ানো জরুরি
জানতে চাইলে অধ্যাপক ডা. কামরুল ইসলাম খান বলেন, ‘অনেক আগে আমরা এটা নিয়ে দাবি তুলেছি, তাদের ভাতা অবশ্যই বাড়ানো উচিত। বিভিন্ন অনুষ্ঠানেও আমি ইন্টার্নদের বিষয় নিয়ে কথা বলেছি। কারণ ইন্টার্ন চিকিৎসকরা অনেক পরিশ্রম করে। তাদের কারণে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা সেবা হয় এবং ভালো চলে। তারা অনেক পরিশ্রম করে, সেই হিসাবে তাদের ভাতা বাড়ানো উচিত। অন্যান্য কর্মকর্তাদের কাছাকাছি তাদের ভাতা রাখা উচিত।’
চিকিৎসদের সংগঠন স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) সভাপতি অধ্যাপক ডা. ইকবাল আর্সলান বলেন, ‘দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থাসহ সব কিছু বিবেচনায় অবশ্যই তাদের ভাতা বাড়ানো দরকার এবং কারণ তারা সার্বক্ষণিকভাবে হাসপাতালে সেবা দিচ্ছেন। তারা হাসপাতালের প্রাণ ও মূল চালিকা শক্তি। আমরা মনে করি তাদের বাড়ানো উচিত।’
আশার বাণী নেই মন্ত্রণালয়ে
ইন্টার্ন চিকিৎসকদের ভাতা বাড়ানোর উদ্যোগের বিষয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তার কাছে জানতে চাওয়া হয়। তবে তাদের কেউই আশার বাণী শোনাতে পারেননি। জানতে চাইলে স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন অধিশাখা) মনোজ কুমার রায় বলেন, ‘এটা নিয়ে আমরা কাজ করি না। এটি হলো স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের কাজ।’
দায়িত্বপ্রাপ্ত স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন অনুবিভাগ) মো. শাহ্ আলম সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘এটি আমার কাজ নয়, এ বিষয়ে আমি বলতে পারছি না।’
স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (চিকিৎসা শিক্ষা অনুবিভাগ) নীতিশ চন্দ্র সরকার বলেন, ‘আমি এখানে নতুন এসেছি। জানি না কোনো ইনিশিয়েটিভ নেওয়া হয়েছে কিনা, এ বিষয়ে জানতে হবে। আর এখানে অনেকগুলো বিষয় জড়িত। অর্থ মন্ত্রণালয়ের বাজেটের ব্যাপারও রয়েছে।’
সার্বিক বিষয় জানতে দায়িত্বপ্রাপ্ত স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের একাধিক কর্মকর্তা এবং স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের সচিব মো. সাইফুল হাসান বাদলকে একাধিকবার চেষ্টা করেও ফোনে পাওয়া যায়নি।