রোগী থেকে ফি নয়: চিকিৎসকদের বেতনভুক্ত কর্মচারী বানানোর সিদ্ধান্ত বুমেরাং হবে

মো. মনির উদ্দিন: সংস্কার প্রতিবেদনে করা সুপারিশের মাধ্যমে স্বাস্থ্য খাতকে অস্থিতিশীল করার পাঁয়তারা চলছে বলে মনে করেন বিশিষ্টজনরা। একে চিকিৎসক বিদ্বেষী আখ্যা দিয়ে তারা বলেন, নির্ধারিত কর্মঘণ্টার পর চিকিৎসকরা কিভাবে সময় ব্যয় করবেন তা বিদ্যমান আইনে বলা আছে, যা অন্যান্য সকল পেশার মানুষের জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য। তাদের জন্য আলাদা কোনো নির্দেশনা প্রদান নাগরিক অধিকারে হস্তপেক্ষেরই শামিল।
স্বাস্থ্য খাতের সংস্কার বিষয়ক প্রতিবেদনের সুপারিশে প্রাইভেট প্রাকটিস ব্যাহত হতে পারে আশঙ্কা করে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এতে স্বাস্থ্যসেবা বঞ্চিত হবে সাধারণ মানুষ। বাড়বে মুনাফাখোর ক্লিনিক ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম। তাই প্রকৃত সংস্কার নিশ্চিতে স্বাস্থ্য খাতের বিদ্যমান বড় বড় সমস্যাগুলো দ্রুততম সময়ে সমাধানেরও পরামর্শ দেন তারা।
পাশাপাশি সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের আগে সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষের সঙ্গে আলোচনায় বসারও আহ্বান জানান পেশাজীবী নেতৃবৃন্দ।
সুপারিশের পেছনে অসৎ উদ্দেশ্য!
জানতে চাইলে স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) সভাপতি অধ্যাপক ডা. ইকবাল আর্সলান মেডিভয়েসকে বলেন, স্বাস্থ্য খাতের সংস্কার বিষয়ক প্রতিবেদনের সুপারিশগুলো বুঝতে হলে একটু পেছনে যেতে হবে। দেশে প্রশাসনসহ কিছু ক্ষেত্রে সংস্কারের জন্য খুব সম্ভবত বিশ্বব্যাংক বা এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক থেকে এলজিইডি মন্ত্রণালয় কিছু টাকা নিয়েছে৷ এই টাকা তো খরচ করতে হবে। এটা করতে গিয়ে কোনো গবেষণা ছাড়াই বিএমডিসি, স্বাস্থ্যে সংস্কারের জন্য কিছু প্রস্তাবনা দেওয়া হয়েছে। তারা উদ্ভট কিছু প্রস্তাবনা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর পর্যন্ত দিয়েছেন। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা যাচাই-বাছাই না করেই এগুলো বাস্তবায়নের জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বরাত দিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে।
তিনি বলেন, তাদের দেওয়া এসব তথ্য ভুল ও বিভ্রান্তিতে ভরা। তাদের সুপারিশ বাস্তবধর্মী কোনো কিছু না, বরং এগুলো হলো প্রাপ্ত টাকা হালাল করার ডকুমেন্ট। বিএমডিসি একটি রেগুলেটেড বডি। সারা পৃথিবীর মেডিকেল কাউন্সিলের মতো এর কিছু কাজ আছে, এটা কোনো প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠান না। অথচ তাদের ব্যাপারেও সুপারিশ এসেছে।
জানতে চাইলে চিকিৎসকদের সংগঠন ফাউন্ডেশন ফর ডক্টরস সেফটি রাইটস অ্যান্ড রেসপন্সিবিলিটিস’র (এফডিএসআর) মহাসচিব ডা. শেখ আব্দুল্লাহ আল মামুন মেডিভয়েসকে বলেন, এটা আমাদের কাছে তামাশার মতো মনে হচ্ছে। অবশ্যই সংস্কারের প্রয়োজন আছে এবং স্বাস্থ্য খাতের অনিয়মগুলোর জবাবদিহিতারও দরকার আছে, যা আমরা সমর্থন করি। তবে স্বাস্থ্য বিষয়ক সংস্কারের বিষয়টি গভীরভাবে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, এর পেছনে কোনো অসৎ উদ্দেশ্য আছে।
১৫-২০ শতাংশ ভাতা কতটা যৌক্তিক
বাংলাদেশ ডক্টরস’ ফাউন্ডেশনের (বিডিএফ) আহ্বায়ক ডা. মো. শাহেদ রফি পাভেল মেডিভয়েসকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটি দৃষ্টিভঙ্গি ছিল, সরকারি হাসপাতালগুলোতে ইনস্টিটিউশনাল প্র্যাকটিস চালু করবেন। এরই মধ্যে তিনি একটি প্রতিষ্ঠানে (বিএসএমএমইউ) এটি চালু করেছেন। নির্ধারিত সময়ের পর যেখানে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা একটি ফি নিয়ে রোগী দেখেন।
অধ্যাপক ডা. শেখ আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, সুপারিশে বলা আছে, চিকিৎসক রোগী থেকে টাকা নিতে পারবে না—এমন ধারণা তারা কোথায় পেলেন? তারা ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের উদ্ধৃতি দিয়েছেন। এক জায়গায় লেখা আছে, প্রাইভেট প্র্যাকটিস করলে রোগী থেকে পয়সা নিতে পারবে না, আবার এক জায়গায় ইনস্টিটিউশনাল প্রাকটিসের কথাও লেখা আছে। এটা করলে বেতনের ১৫-২০ শতাংশ দেবে। এটা কোথা থেকে পেলো। প্রাতিষ্ঠানিক প্রাকটিসের বেলায় চিকিৎসকের সঙ্গে চুক্তি হয় এবং তাদের বেতন হয় অনেক বেশি। বাংলাদেশে একজন চিকিৎসক কত বেতন পান? একজন অধ্যাপকের বেতনই বা কত? এর ১৫-২০ শতাংশ কত টাকা হবে? এটা দিয়ে তো কখনোই ইনস্টিটিউশনাল প্রাকটিস সম্ভব না। এটা একেবারেই অযৌক্তিক।
চিকিৎসক বিদ্বেষী সুপারিশ
স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) সভাপতি অধ্যাপক ডা. ইকবাল আর্সলান বলেন, সরকার চাইলে সমস্ত চিকিৎসকদের নন-প্যাক্টিসিং করে তাদের সুবিধা দিয়ে সেবা কার্যক্রম চালাতে পারতো। কিন্তু সরকারি ব্যবস্থাপনায় মাত্র ৩৫ শতাংশ সেবা নিশ্চিত করা যায়, বাকি ৬৫ শতাংশ হলো বেসরকারি খাতের। এতো ব্যাপক চিকিৎসা যারা দিচ্ছে, তাদেরকে ক্লিনিকে বেতনভুক্ত কর্মচারী বানানোর চেষ্টা অর্বাচীন চিন্তা ছাড়া কিছুই নয়।
এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক ডা. শেখ আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, সুপারিশে বলা হয়েছে, প্রাইভেট হাসপাতালগুলো বেতনভুক্ত কর্মচারী হবেন এবং তারা কোনো ক্লিনিকের মালিক হতে পারবেন না। এসব সুপারিশ সম্পূর্ণরূপে চিকিৎসক বিদ্বেষী, অপমানজনক, অসমাঞ্জস্যপূর্ণ ও বৈষম্যমূলক। অনেক ক্লিনিকের মালিক চিকিৎসক। দেখা যাচ্ছে, এক পরিবারের কয়েক চিকিৎসক আছেন। তারা অন্যদেরকে নিয়ে প্রাইভেট হাসপাতাল বা ক্লিনিক দেন। সুতরাং এ ধরনের সুপারিশের তো কোনো প্রয়োজনীয়তা নেই।
জানতে চাইলে বিশিষ্ট রক্তরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. গুলজার হোসেন উজ্জ্বল মেডিভয়েসকে বলেন, চিকিৎসকরা নির্ধারিত সময়ের পর কিভাবে প্রাইভেট প্র্যাক্টিস করবেন, সেটা আসলে মন্ত্রণালয় বেধে দিতে পারে না। সরকারি চাকরির বাইরে একজন চিকিৎসক কিভাবে সময় ব্যয় করবেন, তা বিদ্যমান আইনেই বলা আছে। এটা শুধু চিকিৎসকদের জন্য নয়, বরং যারা অন্য ক্যাডারে আছেন তাদের জন্যও একই নিয়ম। অনেকে প্রশাসনে কাজ করার পাশাপাশি কোনো এনজিওতে কনসালটেন্সি করছেন। অনেকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নিচ্ছেন কিংবা আরও অনেকে অন্যান্য কাজে যুক্ত আছেন। সবার জন্য তা সমানভাবে প্রযোজ্য। এক্ষেত্রে চিকিৎসকদের জন্য আলাদা করে কোনো নির্দেশনা প্রদানের অর্থ দাঁড়াবে তাঁদেরকে দড়ি দিয়ে বেঁধে দেওয়া।
সুপারিশের বিভিন্ন দিক তুলে ধরে তিনি আরও বলেন, ‘এতে বলা হয়েছে, চিকিৎসকদের জন্য একটা ফি নির্ধারণ করা হবে। অথচ এটা আমরা পাবো না, আমরা হবো পূর্বনির্ধারিত বেতনভুক্ত কর্মচারী—এটা আসলে সংশ্লিষ্টরা বলার ইখতেয়ার রাখেন না। যেখানে চিকিৎসকরা প্রাকটিস করবেন, এটা তারাই ঠিক করবেন। এটা মন্ত্রণালয় থেকে নির্ধারণ করে দেওয়ার বিষয় না। উনারা এটা কেন চাচ্ছেন, তাও আমরা বুঝতে পারছি না।’
প্রাইভেট প্রাক্টিস করতে গেলে একজন চিকিৎসককে যথেষ্ট পরিশ্রম করতে হয় উল্লেখ করে এ রক্তরোগ বিশেষজ্ঞ বলেন, সরকারি হাসপাতালে কাজ করে যে সময়টুকু পরিবারে দেওয়ার কথা, সেটা আমি প্রাইভেট প্রাক্টিসে দিচ্ছি। এর বিনিময়ে কি টাকা আশা করতে পারি না? এটা তো অন্যায় কিছু না। হ্যাঁ, বিষয়টি যদি এমন হয় যে, সরকারি কর্মকর্তারা কোনো রকমের প্রাইভেট প্রাকটিস করতে পারবেন না। এ ধরনের কোনো আইন হলে কিছুই বলার থাকবে না।
‘মেনে নেবেন না চিকিৎসকরা’
স্বাস্থ্য খাতের সংস্কারের নামে দুর্বল চিন্তাপ্রসূত এসব সুপারিশ সরকার বাস্তবায়ন করবে না উল্লেখ করে অধ্যাপক ডা. ইকবাল আর্সলান বলেন, ‘আমার বিশ্বাস, সরকার অবশ্যই সার্বিক অবস্থার আলোকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে।’
সুপারিশের সংশোধন দাবি করে ডা. শাহেদ রাফি পাভেল বলেন, চিকিৎসা পেশার বাইরের কেউ অযাচিতভাবে নীতিমালা তৈরি করে দেবে, সেটা স্বাস্থ্য খাতের নীতিমালা হিসেবে বিবেচিত হবে, তা কখনোই ঠিক না। সুতরাং এ পর্যন্ত যতদূর হয়েছে, তা প্রত্যাহার করা উচিত। নির্দেশনা যেখান থেকেই আসুক, এর সংশোধন দরকার।
এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক ডা. শেখ আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘কোভিডের সময়টা পার করে এসেছি। এখন চিকিৎসকদের সঙ্গে পূর্বের মতো বৈরি আচরণও দৃশ্যমান হচ্ছে। চিকিৎসকরা সৎভাবে বিকেলে প্র্যাকটিস করে ভালো পরিমাণ অর্থ আয় করতে পারেন। এটা সুপারিশকারীদের হিংসা পরায়ণ করে তুলেছে। সুপারিশ তো দূরের কথা, এ ধরনের চিন্তা তারা করলেন কিভাবে? এ ভাবনা তাদের হীনমন্যতারই পরিচায়ক। এটা আসলে চিকিৎসা পেশা ও স্বাস্থ্য সেবা কারও জন্যই ভালো হবে না। এ ধরনের সুপারিশ অনুমোদন পেলেও চিকিৎসকরা মেনে নেবেন না। এফডিএসআর’র পক্ষ থেকে আমরা এর তীব্র নিন্দা জানাই।’
স্বাস্থ্য খাত ধ্বংস করার ষড়যন্ত্র
অবাস্তবায়নযোগ্য, উদ্ভট সুপারিশ আসলে কারও কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না মন্তব্য করে অধ্যাপক ডা. ইকবাল আর্সলান বলেন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, গ্রোয়িং ইন্ড্রাস্ট্রিকে ধ্বংস করার জন্য একটি ষড়যন্ত্র চলছে। বাংলাদেশকে পরনির্ভরশীল জাতি এবং রাষ্ট্র বানানোর জন্য তারা ক্রীড়নক হিসেবে কাজ করছেন।
ডা. শাহেদ রাফি পাভেল বলেন, ‘আমরা বরাবরই চেয়ে আসছি, বাংলাদেশের একটি রেফারাল সিস্টেম দাঁড় করানো হোক। জুনিয়র ফিজিশিয়ান্সের কাছে রোগীরা প্রথম যাবেন। তারপর সেখান থেকে যথাযথ প্রক্রিয়ায় রোগী রেফার্ড হবেন কনসালটেন্টের কাছে। বিদ্যমান এসব সমস্যার সমাধান না করে, চিকিৎসকদের কোনো সংগঠনের সঙ্গে আলোচনা না করে হুট করে এমন হটকারী সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এটা কোনো কল্যাণ বয়ে আনবেই না, বরং আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ভেঙে দেওয়ার জন্য সহায়ক ভূমিকা রাখবে।
প্রাইভেট প্রাকটিসে বিধি-নিষেধ আরোপ করা হলে নানা ধরনের সমস্যা হতে পারে জানিয়ে ডা. গুলজার হোসেন উজ্জ্বল বলেন, চিকিৎসকরা যদি বিষয়টি মেনে না নেন, তাহলে তারা প্রাইভেট প্রাকটিস বন্ধ করে দেবেন। তখন তাদেরকে কাজে বাধ্য করাও যাবে না। কারণ এটি তাদের নাগরিক অধিকার। প্রাইভেট প্রাকটিস বাধাগ্রস্ত হলে স্বাস্থ্যসেবা যথাযথভাবে নিশ্চিত করা সম্ভব হবে না। দেশের সেই সক্ষমতা এখনো হয়নি। এক সপ্তাহ প্রাইভেট প্রাকটিস বন্ধ থাকলেও স্বাস্থ্য খাত অস্থিতিশীল হয়ে যাবে। এ পরিস্থিতি তৈরির পাঁয়তারা কেন চলছে, তা নিয়ে চিন্তা করা দরকার।
বিদ্যমান সমস্যা আগে সমাধানের দাবি
বিডিএফ’র আহ্বায়ক ডা. শাহেদ রাফি পাভেল বলেন, বাংলাদেশে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সঙ্গে সম্পৃক্ত আরও বেশি কিছু জটিল সমস্যা বিদ্যমান আছে। দেশে প্রচুর আরএমপি, নন-আরএমপি প্র্যাকটিস করে, যাদের কোনো লাইসেন্স নেই। রোগীর হাতে প্রেসক্রিপশন দেখলেই ফার্মাাসিউটিক্যালস কোম্পানির ওষুধ বিপণন কর্মকর্তারা এসবের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে। প্রেসক্রিপশন ঘিরে তাদের কাড়াকাড়িতে হাসপাতালে আসা রোগীর অসহায় স্বজনেরা বিব্রতকর অবস্থায় পড়েন। এ ব্যাপারে চিকিৎসকরা বরাবর সোচ্চার ছিলেন। কিন্তু কোনো সমাধান হয়নি।
তিনি আরও বলেন, অনেক বিদেশি চিকিৎসক লাইসেন্স ছাড়াই বাংলাদেশে আসেন, রোগী দেখে চলে যান। পরে তাদের দেখানো পথে বিভিন্ন সোর্সের মাধ্যমে প্রচুর রোগী ভারতে চলে যান।
‘বলা হচ্ছে, চিকিৎসকরা প্র্যাকটিস করতে পারবেন, তবে ক্লিনিক্যালের অধীনের প্র্যাকটিস করতে হবে। প্রাইভেটলি, পারসোনালি করতে পারবেন না। পৃথিবীর কোনো দেশে এ ধরনের নীতিমালা আছে কিনা, আমার জানা নেই। সংস্কারের নামে এ ধরনের সিদ্ধান্ত বিদ্যমান সমস্যা প্রসারের সুযোগ সৃষ্টি করবে’, যোগ করেন ডা. পাভেল।
এ প্রসঙ্গে ডা. গুলজার হোসেন বলেন, প্রাইভেট প্রাকটিসের বিষয়টি যেভাবে চলছে, তা যথাযথ। এটাকে বাধাগ্রস্ত করা ঠিক হবে না। তার চেয়ে বরং দেশে সেবার মানোন্নয়ন ঘটাতেই চাইলে সরকারি হাসপাতালে আমাদের উপস্থিতি ও কাজের মান নিয়ন্ত্রণে পদক্ষেপ জোরদার করা যেতে পারে। সেই সঙ্গে বেসরকারি হাসপাতালে যেসব পরীক্ষা-নিরীক্ষা হচ্ছে, সেগুলো যথাযথভাবে হচ্ছে কিনা, নতুন প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়ম মেনে পরিচালিত হচ্ছে কিনা—এসবে নজরদারি বাড়ানো দরকার।
‘একদিকে চিকিৎসকদের প্রাইভেট প্র্যাকটিসে নিয়ন্ত্রণ আরোপের চেষ্টা, অন্য দিকে দেদারসে মানহীন ল্যাব ও হাসপাতালকে লাইসেন্স দেওয়া হচ্ছে। যেখানে পর্যাপ্ত চিকিৎসক, রোগী, ভালো অ্যানেসথেশিওলজিস্ট, টেকনোলজিস্ট, প্যাথলজিস্ট নেই। অথচ এসবে নজর নেই, বরং চিকিৎসকরা কত ভিজিট নিচ্ছে, এটা নিয়ে তৎপরতা। এতে বোঝা যায়, স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সার্বিক উন্নয়ন নয়, বরং চিকিৎসকদের থামিয়ে দেওয়াই উদ্দেশ্য। বিষয়টি এমন হলে তা আখেরে কারও জন্যই তা ভালো হবে না’, যোগ করেন ডা. গুলজার হোসেন উজ্জ্বল।
মুনাফাখোদের দৌরাত্ম বাড়ার শঙ্কা
অধ্যাপক ডা. শেখ আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, ৯০ দশকের কমিশন বাণিজ্য ছিল না। এ খাতে যখন ব্যবসায়ীরা আসলো, তখন পুরো ব্যবস্থাপনাকে করপোরেট করে দিলো। তখন চিকিৎসকদের অনৈতিক সুবিধা-কমিশন দেওয়া শুরু হয়। এসব মূলত চিকিৎসা পেশার বাইরের লোকদের দ্বারাই সূচিত হয়েছে। পুরো খাতটাই ব্যবসায়ীদের হাতে চলে গেলে কোনো চিকিৎসক মালিক থাকবে না। অথচ একজন চিকিৎসক ক্লিনিক মালিক হলে রোগীদের বেশি সুবিধা পাওয়ার সুযোগ তৈরি হয়। কারণ রোগী সেবা দিতে গিয়ে তিনি দেখবেন, তাঁর আলাদা কিছু টাকা উপার্জন হচ্ছে। এতে অনেক বিষয়ে রোগীকে ছাড় দেওয়ার সুযোগ থাকে।
রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালের মেডিকেল অফিসার পদে কর্মরত ডা. আনিস বিন আব্দুর রাজ্জাক বলেন, এ সুপারিশ বাস্তবায়ন হলে বেসরকারি ক্লিনিক মালিকরা বিশাল সুযোগ পেয়ে যাবেন। তাদের কাছে চিকিৎসকরা জিম্মি হয়ে যাবেন। কারণ বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে বেতনভুক্ত না হয়ে প্রাকটিস করার সুযোগ পাবেন না। তখন তারা অনেক চিকিৎসককে কম বেতনে চাকরি করতে বাধ্য করার সুযোগ পাবেন। অতিরিক্ত দায়িত্ব পালনের জন্য বাধ্য করতে পারেন। এটা বেসরকারি চিকিৎসকদের জন্য খুব কঠিন হয়ে যাবে, কারণ তাদেরকে বেসরকারি কোনো প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেই হবে। তারা বেতন-ভাতা নিয়েও অবমূল্যায়নের শিকার হবেন। অর্থাৎ চিকিৎসক-রোগী উভয় পক্ষই জিম্মি হয়ে যাবেন। সংকোচিত হবে স্বাস্থ্য সেবা। মুনাফাখোরদের ধান্ধাবাজির বিরাট সুযোগ হবে, যা মূলত বিশৃঙ্খলার তৈরি করবে।
তিনি আরও বলেন, ‘প্রাইভেট প্রাকটিস করতে গিয়ে একজন চিকিৎসক উল্লেখযোগ্য সংখ্যক রোগীকে বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা প্রদান করে থাকেন। কিন্তু একজন চিকিৎসক যখন ক্লিনিক বা হাসপাতালের পূর্ব নির্ধারিত বেতনভুক্ত কর্মচারী হবেন, তখন তো তাঁর পক্ষে রোগীকে ছাড় দেওয়া বা বিনামূল্যে চিকিৎসা দেওয়ার সুযোগ থাকবে না। তখন রোগীদেরকে টিকিট কেটে আসতে হবে। এতে দরিদ্র রোগীরা সেবা বঞ্চিত হবেন।
এছাড়া গ্রামগঞ্জে অনেক চিকিৎসক ফার্মেসীতে বা নিজস্ব চেম্বারে অল্প ফি তে রোগীদের সেবা দিয়ে থাকেন৷ নতুন আইনে তা করার সুযোগ থাকবেনা৷ রোগীরা বাধ্য হবেন মুনাফাখোর ক্লিনিকে যেতে৷ যেখানে বিভিন্ন বাহানায় তাদের থেকে মোটা অংক হাতিয়ে নিবে ক্লিনিক কর্তৃপক্ষ৷ গরীর রোগীরা নিগৃহের শিকার হবেন৷
আলোচনায় বসার আহ্বান
স্বাস্থ্য বিষয়ক সংস্কারের সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের আগে এ নিয়ে চিকিৎসা সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনার আহ্বান জানিয়েছেন পেশাজীবী নেতারা। তারা বলেন, যাদের শ্রম ও ঘামে এগুলো বাস্তবায়ন হবে, তাদের সঙ্গে আলোচনা ছাড়া এগুলো বাস্তবায়ন হলে তা হবে হিতে বিপরীত।
এ প্রসঙ্গে ডা. মো. শাহেদ রফি পাভেল বলেন, একটি বিষয় নিয়ে আলোচনা হলেই, হুট করে এটি বাস্তবায়নে যাওয়ার কোনো যুক্তি নেই। এ নিয়ে বিশদ আলোচনা ও সকল পক্ষের মতামত নেওয়ার ব্যাপার আছে। স্বাস্থ্য সেবায় যিনি শ্রম দেবেন, তার মতামত নিতে হবে। আমাদের যারা বিশেষজ্ঞ আছেন, যারা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করছেন, সংগঠন পরিচালনা করছেন; তাদের মতামতের ভিত্তিতে যেটা সবার জন্য সুবিধাজনক তা নীতিমালায় আনতে হবে। এটা চাপিয়ে দেওয়া যাবে না।
অধ্যাপক ডা. শেখ আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, স্বাস্থ্যসেবার মানোন্নয়ন ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতের জন্য সংস্কারের প্রয়োজন আছে। এজন্য স্বাস্থ্যসেবা সংশ্লিষ্টদের এর সঙ্গে সম্পৃক্ত করে সংস্কারের বিষয়ে আলোচনা করা দরকার। এর মাধ্যমে দ্রুত নীতিমালা প্রণয়ন করা উচিত।
যা আছে স্বাস্থ্য বিষয়ক সংস্কার প্রতিবেদনে
চিকিৎসক হবেন স্বাস্থ্য সেবা প্রতিষ্ঠানের বেতনভুক্ত কর্মচারী। তারা কোনোভাবেই রোগীদের কাছ থেকে সরাসরি টাকা নিতে পারবেন না। গত বছরের ২৬ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিব ড. আহমেদ কায়কাউসের নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত ‘স্বাস্থ্য খাতের সংস্কারবিষয়ক’ মতবিনিময় সভায় এসব সুপারিশ করা হয়েছে।
পরে গত ১ ফেব্রুয়ারি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কাছে পাঠানো এক চিঠিতে স্বাস্থ্য খাতের সংস্কারবিষয়ক প্রতিবেদনে উল্লিখিত এসব সুপারিশ বাস্তবায়নের নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সেবা বিভাগের উপসচিব ড. বিলকিস বেগম স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে আরও বলা হয়, ‘স্বাস্থ্য খাতে সংস্কার বিষয়ক প্রতিবেদনে বর্ণিত নিম্নোক্ত সুপারিশসমূহ যথাযথভাবে বাস্তবায়নের প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ এবং গৃহীত কার্যক্রমের বাস্তবায়ন অগ্রগতি প্রতিবেদন স্বাস্থ্য সেবা বিভাগকে অবহিতকরণের জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো।’
এতে বলা হয়, দেশীয় বাস্তবতায় যেহেতু বিপুল সংখ্যক জনসংখ্যাকে সেবা প্রদান এবং চিকিৎসকগণের ব্যক্তিগত দক্ষতা বৃদ্ধি কল্পে ‘প্রাইভেট প্র্যাক্টিস’র প্রয়োজনীয়তা রয়েছে, সেহেতু চিকিৎসকগণকে ‘প্রাইভেট প্র্যাক্টিস’ করতে হলে কোনো না কোনো প্রতিষ্ঠান/হাসপাতাল/ক্লিনিকের সাথে মাসিক নির্দিষ্ট বেতনের চাকরিজীবী হিসেবে চুক্তিবদ্ধ হবার শর্ত প্রদান করা যেতে পারে।
এককভাবে বা দুই বা ততোধিক ব্যক্তি একটি কোম্পানি/হাসপাতাল/ক্লিনিক হিসেবে সরকারি কর্তৃপক্ষ এবং পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমতি নিয়ে ব্যবসা করতে পারবে এবং সেখানে কেন্দ্রীয়ভাবে ক্যাশ রেজিস্ট্রেশন অনুযায়ী অর্থ সংগ্রহ করা হবে এবং সে অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানটি কর প্রদান করবে।
সুপারিশে বলা হয়েছে, কোনোভাবেই চিকিৎসা সেবা প্রদানকারী কোনো চিকিৎসক সরাসরি সেবা গ্রহিতার নিকট হতে অর্থ গ্রহণ করতে পারবেন না এবং হাসপাতাল বা ক্লিনিক বা প্রতিষ্ঠানের মোট রোগীর সংখ্যার ওপর চিকিৎসকের মাসিক আয় সম্পর্কযুক্ত হবে না। চিকিৎসক হবেন পূর্বনির্ধারিত বেতনভুক্ত কর্মচারী; কোনোভাবেই চিকিৎসা সেবায় একই প্রতিষ্ঠানে নিজে ব্যবসায়ী এবং চিকিৎসক হতে পারবেন না। চিকিৎসকের সব আয় ব্যক্তির ‘ট্যাক্স ফাইলে’ প্রদর্শিত হতে হবে।
এতে আরও বলা হয়েছে, সরকারি চিকিৎসকদের ‘প্রাইভেট প্র্যাক্টিসের’ ব্যবস্থা একই হাসপাতাল/প্রতিষ্ঠানে সরকার নির্ধারিত মূল্যে ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে উল্লেখ করা যেতে পারে, ভারতে সরকারি চিকিৎসকগণ ‘প্রাইভেট প্র্যাক্টিস’ করতে পারেন না। সে জন্য তারা সরকার নির্ধারিত হারে (১৫ থেকে ২০ শতাংশ) ভাতা পেয়ে থাকেন।
চিকিৎসাসেবায় নিয়োজিত সবাই সবসময় সেবা প্রদানের প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকলেও বিশেষ অবস্থার উদাহরণ ব্যতিত নির্ধারিত পেশায় ব্যয়িত সাধারণ সময় দৈনিক ১২ ঘণ্টার বেশি হওয়া উচিত নয় বলেও প্রতিবেদনে বলা হয়।
সুপারিশে বলা হয়, মেডিকেল পেশায় নিয়োজিত পেশাজীবীগণের নৈতিকতা রক্ষার্থে, দেশে সমমান সম্মত ওষুধ উৎপাদন ব্যবস্থা গড়ে তোলার স্বার্থে, অবিলম্বে ওষুধ শিল্প ও মেডিকেল ইকুইপমেন্ট সরবরাহকারীগণের সুস্পষ্ট বিপণন পদ্ধতি প্রণয়নের প্রয়োজন। এক্ষেত্রে সরাসরি চিকিৎসকের কাছে গিয়ে প্রচারের ব্যবস্থা বন্ধ করা প্রয়োজন এবং কোম্পানিগুলোকে বার্ষিক উৎপাদন, বিপণন এবং অন্যান্য ব্যয়সমূহ জনসম্মুখে প্রকাশে বাধ্য করার বিধান রাখা যেতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রে এ ধরনের আইন রয়েছে।