দেশে লিভার সিরোসিসে ‘শান্ট অপারেশনে’ সাফল্য, অস্ত্রোপচারে সুস্থ রোগী
মো. মনির উদ্দিন: জটিল অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে সুস্থ হয়েছেন এক লিভার সিরোসিস ও পোর্টাল হাইপারটেনশনের রোগী। গত ২৮ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর কল্যাণপুরে ইবনে সিনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এ অস্ত্রোপচার হয়।
বিগত ১৫ বছর ধরে পেটব্যথা ও জ্বরে ভুগছিলেন বেলাল উদ্দিন (২৫) নামে ওই ব্যক্তি। বর্তমানে স্বাভাবিক জীবন-যাপন করছেন নোয়াখালীর সুবর্ণচরের এ বাসিন্দা।
জটিল এ অস্ত্রোপচারকে দেশে লিভার সিরোসিস ও পোর্টাল হাইপারটেনশন রোগীদের চিকিৎসায় অভাবনীয় সাফল্য বলে উল্লেখ করে চিকিৎসকরা বলেন, সফল এ অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে দেশের চিকিৎসা সেবা নতুন যুগে প্রবেশ করলো।
এ চিকিৎসা পদ্ধতির ফলে এসব রোগীরা এখন বারংবার রক্তবমি থেকে রক্ষা পাবে এবং লিভার সিরোসিস এর নিরাময়মূলক চিকিৎসা লিভার প্রতিস্থাপন করার জন্য আরো সময় ও সুযোগ পাবেন বলে জানান তারা।
সহকারী অধ্যাপক ডা. আসাদুজ্জামান নুর নাহিদের নেতৃত্বে পরিচালিত এ অস্ত্রোপচারে সহযোগিতা করেন ডা. এস এম মোর্তজা আহসান, ডা. মো. নুর আলম সিদ্দিক আরিফ ও ডা. মো. ইমরুল কায়েস। অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট হিসেবে ছিলেন অধ্যাপক ডা. মো. শাহ আলম।
প্রায় ছয় ঘণ্টাব্যাপী অস্ত্রোপচারের বর্ণনা দিয়ে চিকিৎসক দলের অন্যতম সদস্য ডা. এস এম মোর্তজা আহসান মেডিভয়েসকে জানান, অপারেশনটা খুবই sophisticated, একটু ভুল হলেই রক্তক্ষরণে রোগীর জীবন নাশের আশঙ্কা ছিল। খুবই সতর্কতার সাথে অপারেশনটা সম্পন্ন করা হয়েছে। সফল অস্ত্রোপচারের পর রোগীর কোনো ধরনের জটিলতা দেখা দেয়নি এবং রোগীকে ছুটি দেওয়ার পূর্বে patency দেখার জন্য duplex ultrasound পরীক্ষা করা হয়, যেখানে দেখা যায় রক্তচলাচল সন্তোষজনক ছিল। এমনকি অপারেশনের দুই মাস পর এন্ডোসকপি করে দেখা যায় যে esophageal varices grade-3 থেকে grade-1 এ নেমে এসেছে। ফলে তার রক্তবমি হওয়ার আশঙ্কা অনেকাংশে কমে গেছে।
যেভাবে অস্ত্রোপচার
জানা গেছে, রোগী গত ১৫ বছর ধরে বারবার পেটের ব্যথা ও জ্বরে ভুগতো। অস্ত্রোপচারের এক মাস আগ থেকে তার জন্ডিস দেখা দেয়, যার তীব্রতা ক্রমেই বাড়ছিল। সেই সঙ্গে শরীরে চুলকানিও ছিল।
পরে রাজধানীর কল্যাণপুর ইবনে সিনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে জানা যায়, দীর্ঘদিন লিভারের ভেতর পাথর থাকার কারণে বারবার ইনেফকশন হচ্ছে। ফলশ্রুতিতে লিভার সিরোসিস ও পোর্টাল হাইপারটেনশন হয় এবং এর ফলে খাদ্যনালীর রক্তনালীগুলো অস্বাভাবিকভাবে স্ফীত হয়ে গেছে, যা থেকে যে কোনো সময় রক্তবমি শুরু হতে পারে এবং এক পর্যায়ে জীবন নাশের কারণ হতে পারে।
চিকিৎসকরা জানান, অস্ত্রোপচারের সময় দেখা যায় যকৃতের ডান পার্শ্ব তুলনামূলকভাবে শুকিয়ে/ছোট (atrophy) হয়ে গেছে এবং বাম পার্শ্বের অংশটা একটু স্ফীত/বড় (compensatory hypertrophy) হয়ে গেছে। সে কারণে লিভারের ডান পার্শ্ব (Rt hepatectomy) কেটে ফেলে সমস্ত পাথর বের করা হয় এবং পিত্তনালীর সাথে খাদ্যনালীর সংযোগ (Roux en Y Hepatico-jejunostomy) করে দেওয়া হয় যাতে আর জন্ডিস না হয়। আর রক্তবমি প্রতিরোধে প্লীহার রক্তনালীর সাথে সংযোগ করে দেওয়া হয়। এটাকে selective vascular shunt/Lienorenal/Warren shunt বলে। এটা বাংলাদেশে প্রথম selective shunt যা লিভার সিরোসিস ও পোর্টাল হাইপারটেনশন রোগীর চিকিৎসায় করা হয়।
জানতে চাইলে অস্ত্রোপচার টিমে নেতৃত্ব দেওয়া সহকারী অধ্যাপক ডা. আসাদুজ্জামান নুর নাহিদ মেডিভয়েসকে বলেন, আগে লিভার সিরোসিস রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হতো কনজারভেটিভলি। এসব রোগীর জটিলতা হিসাবে জন্ডিস দেখা দিত, পেটে পানি আসত। তখন জন্ডিসের চিকিৎসা দেওয়া হতো, ওষুধ দিয়ে পেটের পানি কমানো হতো। গুরুতর রোগীদের বার বার রক্তবমি হত। চিকিৎসার মাধ্যমে রক্তপাত বন্ধ করা হতো। এক পর্যায়ে বিভিন্ন জটিলতায় রোগীরা মারা যেতো। এসব রোগীদের রক্তপাত বন্ধে দেশে কোনো অপারেশন করা হতো না। যাদের টাকা-পয়সা আছে, তারা বাইরে গিয়ে লিভার ট্রান্সপ্ল্যান্ট করতেন।
অন্ধকারে আশার আলো
লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত দরিদ্র রোগীদের অসহায়ত্বে ভোগা ছাড়া কোনো উপায় ছিল না জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এসব রোগীদের জন্য আমাদের এ পদ্ধতি অন্ধকারে আশার আলোর মতো। এ পদ্ধতির ফলে রক্তক্ষরণ হওয়ার আশঙ্কা কমে যায়, যা দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থায় আগে ছিল না। ফলে এসব রোগীরা আগে কনজারভেটিভ চিকিৎসা নিয়ে একটু ভালো বোধ করলে বাড়ি ফিরে যেতো। খারাপ হলে আবার হাসপাতালে ছুটে আসতো। এভাবে হাসপাতাল-বাড়ি ঘুরতে ঘুরতে এক পর্যায়ে মারা যেতো। কিন্তু আমাদের শান্ট চিকিৎসা পদ্ধতির ফলে তারা এখন কিছু দিন ভাল থাকবেন এবং পরবর্তীতে নিরাময়মূলক চিকিৎসা লিভার প্রতিস্থাপন করাতে পারবেন।’
‘যেহেতু লিভার ট্রান্সপ্ল্যান্ট অনেক ব্যয়সাপেক্ষ অপারেশন এবং এটি করতে গিয়ে রোগীর ছয় মাস, এক বছর সময় লেগে যায়’, যোগ করেন ডা. নাহিদ।
অভিনব এ চিকিৎসা পদ্ধতির কথা বিলম্বে প্রকাশের কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘রোগীকে ফলোআপের জন্য এতোটা সময় নেওয়া হয়েছে। আমরা একটা নতুন চিকিৎসা পদ্ধতি অ্যাপ্লাই করলাম, এটা আসলে কতটা কার্যকর, তা বুঝতে কিছুটা সময় লাগে। অস্ত্রোপচারে সফল হলেই হবে না, ফলাফলও সন্তোষজনক হতে হবে। মূলত এখানেই এর সাফল্য নিহিত। আমরা এ সময়ে রোগীর অগ্রগতি পর্যবেক্ষণ করছিলাম।আগে যেখানে রোগী খেতে পারছিলেন না, হাঁটতে পারছিলেন না, তীব্র মাত্রার জন্ডিস ছিল, এখন সব জটিলতাই কমে গেছ। খেতে পারছেন, স্বাস্থ্য অনেক ভালো হয়ে গেছে। অস্ত্রোপচারের আগে-পরে ব্যাপক পরিবর্তন। তিনি এখন স্বাভাবিক জীবনের স্বাদ পাচ্ছেন।’
স্বস্তিতে রোগী
অস্ত্রোপচারের পর স্বস্তির জীবনের কথা জানিয়ে রোগী বেলাল উদ্দিন বলেন, ‘গত ২৬ ফেব্রুয়ারি হাসপাতালে ভর্তি হই। ২৮ ফেব্রুয়ারি অপারেশন হয়। ৯ মার্চ হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র দেওয়া হয়। মাঝখানে আবার ১৪-১৮ মার্চ হাসপাতালে ছিলাম। এর পর দুই মাস পরে দেখা করতে বলেছেন। আগামীকাল মঙ্গলবার (১০ মে) যাবো।’
তিনি আরও বলেন, ‘দেশের বাইরে ৭০ লাখ টাকা লাগতে পারে বলে জানানো হয়েছিল। বাড়ি-ঘর বিক্রি করেও এতো টাকা জোগাড় করা সম্ভব না। আত্মীয়-স্বজনের কাছ থেকে টাকা নিয়ে অস্ত্রোপচার করা হয়। এর আগে অবস্থা খুব খারাপ হয়ে গিয়েছিল। সে তুলনায় এখন মোটামুটি ভালো আছি। খাওয়া-দাওয়া, চলা-ফেরা করতে পারছি। অপারেশনের পরে ব্যথাও অনুভব করছি না।’
এক লাখ টাকায় অস্ত্রোপচার
ডা. আসাদুজ্জামান নুর নাহিদ বলেন, লিভার সিরোসিসের স্থায়ী চিকিৎসা হলো, লিভার ট্রান্সপ্ল্যান্ট। যেহেতু রোগীর লিভারটি নষ্ট হয়ে গেছে। এটাই স্থায়ী ও কার্যকর চিকিৎসা। এই শান্ট হলো, রক্তপাত বন্ধের চিকিৎসা। এর মাধ্যমে জরুরি পরিস্থিতি সামলানো সহজতর হবে। কারণ ৬০/৭০ লাখ টাকা খরচ করে সবাইতো ট্রান্সপ্ল্যান্ট করতে পারবে না। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে শান্ট অপারেশনে লাখের মতো খরচ হবে। তবে হাসপাতাল ভেদে ভিন্ন পরিমাণ দাঁড়াতে পারে।
-
০৪ অগাস্ট, ২০২২