ডা. তাইফুর রহমান

ডা. তাইফুর রহমান

কনসালটেন্ট কার্ডিওলজি

জেনারেল হাসপাতাল, কুমিল্লা।


২০ এপ্রিল, ২০২২ ০২:৪১ পিএম

‘স্যার আমরা মনে করছিলাম মরা মানুষ শোয়াইয়া রাইখা বিল তুলতাছেন’

‘স্যার আমরা মনে করছিলাম মরা মানুষ শোয়াইয়া রাইখা বিল তুলতাছেন’
ডা. তাইফুর রহমান।

ডাক্তার হিসেবে দায়িত্ব কতটুকু? অধিকার কতটুকু? নিজের করে ভাবার সুযোগ কতটুকু? ভাবনার অতল গহীনে হারিয়ে যাই ক্ষণে ক্ষণে।

পরীক্ষাগুলো কোথায় করাবেন? এখানে করাবো না স্যার । দাম বেশি নেয়। এখানের পরীক্ষার মান ভালো। টাকা একটু বেশি গেলেও সঠিক রিপোর্টটা খুব জরুরি। ভুল রিপোর্টে ভুল চিকিৎসা হবে। এতে আপনার মৃত্যুও হতে পারে। অবিশ্বাসের দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকে আমার দিকে।  আমি তবুও দায়িত্ব নিয়ে বলি তাহলে এই এই সেন্টারে করান। রোগী চলে যায় আমার সম্পর্কে একটা খারাপ ধারণা নিয়ে, আমি কমিশন খোর ডাক্তার!!

জেনারেল হাসপাতালের চিফ টেকনিশিয়ান সেলিম সাহেব আমার কাছে উনার ভাতিজিকে নিয়ে এসে বললেন, স্যার ওরতো বাত জ্বর হয়ে গেছে, এএসও ৮০০। শুধু এএসও টাইটার দিয়েতো বাত জ্বর ডায়াগনোসিস হয় না। তবুও জনমনে এটা কমন বিশ্বাস এএসও বেশি মানেই বাত জ্বর। আমি বললাম আমাদের এখানে আবার পরীক্ষাটা করান। স্যার আমি নিজের হাতে করেছি!! দেখুন সেলিম সাহেব, মেয়েটার ১৩ বছর বয়স । আমি ইনজেকশন দেই আর ট্যাবলেট দেই আরও নয় বৎসর দিতে হবে। সুতরাং নিশ্চিত হয়ে দেয়া উচিত না? রিপোর্ট নিয়ে হা করে দাঁড়িয়ে আছেন সেলিম সাহেব , স্যার রিপোর্টে তো আসলো মাত্র ১৫০! কেন এমন হলো। আমি বললাম, আপনি করেছেন কলরোমিটার দিয়ে আর এখানে করেছে এলাইজা মেথডে।

লাইফ সাপোর্টে থাকা মিজান মিয়ার লোকজন আর একমুহূর্তও হাসপাতালে রাখবেন না। এক্ষুণি খুলে দেন, বাড়িতে নিয়ে যাবো। মুখ গলিয়ে লম্বা নল ঢুকানো এবং ফেন্টা দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা মানুষটাকে দেখলে আপাতদৃষ্টিতে মৃতই মনে হবে। তাদের আর দোষ কি? আমি জিজ্ঞেস করলাম, কেন নিয়ে যাবেন? আমাদের টাকা নাই। খাগড়াছড়ি থাকি। গরীব মানুষ। এই মূহুর্ত পর্যন্ত হিসাব করে বললাম এই টাকাটা পরিশোধ করেন বাকিটা আমি দিবো। কাল ছুটি দিবো ইনশাআল্লাহ। তার সব সাপোর্ট কমিয়ে আনা হয়েছে। ভাইটালস ভালো। বেঁচে থাকার সম্ভাবনা বেশি। এমন একটা রোগীকে হঠাৎ লাইফ সাপোর্ট উইথড্র করে মেরে ফেলাটা মারাত্মক অপরাধ। আলহামদুলিল্লাহ। পরদিন রোগী সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে বাড়ি গেল। তার লোকজন বলে,স্যার আমরা মনে করছিলাম মরা মানুষ শোয়াইয়া রাইখা বিল তুলতাছেন।

খোকন সাহা তার মৃত্যুপথযাত্রী বউকে টেনে হিঁচড়ে এনে শোয়ালো এক্সামিনেশন টেবিলে। অন্য রোগীর অর্ধেক প্রেসার মাপা বাদ দিয়ে এখানে এটেন্ড করলাম। পালস, বিপি নন রেকর্ডেবল। রুগী গ্যাস্পিং। বললাম সোজা উপরে নিয়ে ভর্তি করে দেন।  স্যার, মেডিকেল কলেজে নিয়ে যাই? অতদূর যেতে যেতে রোগী বাঁচবে না। এখানের বিল পরে দেখা যাবে। সে ভিজিট দিতে পকেটে হাত ঢুকালো। বললাম এখন ভিজিট নেয়ারও সময় নেই। আপনি আগে রোগী বাঁচান। রমজান মাসে আমি ইফতারের পর রোগী দেখি না। এটা ছিলো সেদিনের শেষ রোগী। তারাবির নামাজের মাঝামাঝি সময়ে হাসপাতাল থেকে ফোন আসলো একটা রোগী মারা গেছে। ঝামেলা হচ্ছে। আপনি একটু আসেন। আমি গেলাম। খোকন সাহা হাউমাউ করে কাঁদছে। এলাকার নেতা পারভেজ ও তার লোকজন হইচই করছে, সাংবাদিক সাহেব ভিডিও করছে। পুলিশ স্যম্পল নিচ্ছে। খোকন সাহা আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে, বাবু আপনার কোন দোষ নাই। কিন্তু ডিউটি ডাক্তার সীমান্ত কর্মকার কি যেন ইনজেকশন দিলো আর সাথে সাথে মরে গেলো আমার স্ত্রী । সাড়ে এগারোটার দিকে সবাই বললো আপনি চলে যান, রাত হয়েছে। পরদিন ফেসবুকে আহাজারি আর খিস্তি খেউড়ের ঢল, ভুল চিকিৎসায় রোগীর মৃত্যু।  দুই বছর পরও আমি আর ডা. সীমান্ত কর্মকার জুতাবিহীন নগ্ন পায়ে কাঠগড়ায় দাঁড়াই। খোকন সাহার আইনজীবী আমার চোখের দিকে আঙুল তাক করে বলে, ব্যবসার উদ্দেশ্য নিয়েই মেডিকেল কলেজে যেতে দেয়নি রোগীকে আর তারপর অবহেলা, ভুল চিকিৎসা। তবুও ক্ষীণ কন্ঠে বলি, মাননীয় আদালত, আমার প্রেসক্রিপশনের দিকে দেখুন। ওখানে লেখা আছে পালস, বিপি নন রেকর্ডেবল। এই রোগীর বেঁচে থাকার সম্ভাবনা কতটুকু? এই হাসপাতালের মালিক তো আমি নই! আমার ভিজিটটা পর্যন্ত রাখিনি। তারপরও বলবেন ব্যবসার ধান্ধা?

এখন আর দায়িত্ব নেই না। জোর দেইনা ভর্তি হওয়ার জন্য। মাত্র ক'দিন আগের কথা। রোগীর পালস,বিপি নাই। হার্ট এ্যটাকের রোগী। বললাম, রোগীর অবস্থা খারাপ। সিসিইউ তে ভর্তি করাতে হবে। রোগীর লোকজন হাসি দিয়ে বলেন, খারাপ দেখলেন কই? রোগীতো কথা বলছে। ঔষধ লিখে দেন, বাড়ি নিয়ে যাবো। কথা বাড়ালাম না। ঔষধ লিখে বিদায় দিলাম। বাইরে রোগী বসে আছে হুইল চেয়ারে। রোগীর লোকজন ফোনে কথা বলছেন কার কার সাথে। প্রায় পনেরো মিনিট পর, বাহিরে হইচই। রোগী ঘাড় ফেলে দিয়েছে। আমার দেয়া একটা ঔষধও সেবন করা হয়নি তার। লিফটের সামনেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন আমাকে পূর্ণ ভিজিট দেয়া রোগী। আফসোস!!

মেডিভয়েসের জনপ্রিয় ভিডিও কন্টেন্টগুলো দেখতে সাবস্ক্রাইব করুন MedivoiceBD ইউটিউব চ্যানেল। আপনার মতামত/লেখা পাঠান [email protected] এ।
  এই বিভাগের সর্বাধিক পঠিত
এক দিনে চিরবিদায় পাঁচ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক
করোনা ও বার্ধক্যজনিত অসুস্থতা

এক দিনে চিরবিদায় পাঁচ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক