অধ্যাপক ডা. বেগম শরিফুন নাহার
প্রধান, নিওনেটোলজি বিভাগ,
স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ মিটফোর্ড হাসপাতাল।
০৫ এপ্রিল, ২০২২ ০২:০৩ পিএম
বুকের দুধে মা ও শিশুর জটিল রোগের আশঙ্কা কমে
মায়ের বুকের দুধ শিশুর জন্য অত্যন্ত জরুরি খাবার। মায়ের দুধে পর্যাপ্ত পরিমাণ পুষ্টি থাকে। একটি শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশে মায়ের দুধের গুরুত্ব অপরিসীম। বুকের দুধ পান করা শিশুর ভবিষ্যতে বড় ধরনের অসুখ কম হয়। সুস্থ শিশু পরিবার, দেশ, জাতি ও সারা বিশ্বের জন্য কল্যাণকর।
মায়ের দুধের উপকারিতা
জন্মের একঘণ্টার মধ্যে কোনো শিশু যদি মায়ের বুকের দুধপান শুরু করে, তাহলে এ শিশু দীর্ঘদিন দুধ পায়। মায়ের দুধে প্রচুর পরিমাণ পুষ্টি থাকে। এতে শিশুর শারীরিক বৃদ্ধি ও মানসিক বিকাশ ভালো হয়। বোতলের দুধ খাওয়া শিশুর চেয়ে মায়ের বুকের দুধ পান করা শিশুর ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া ও কান পাকাসহ বিভিন্ন রোগ খুব কম হয়। যে পরিবারে অ্যাজমা আছে, সে পরিবারের শিশু যদি মায়ের বুকের দুধ খায়, তাহলে অ্যাজমা হলেও দেরিতে হয় এবং ভবিষ্যতে অ্যাজমা অনেক কমে যায়। যেসব শিশু বোতলের দুধ খায়, তারা অল্প বয়সে খুব মোটা হয়ে যায়। জীবনের প্রথম দুই বছর কোনো শিশু অতিরিক্ত ওজন ধারণ করলে ভবিষ্যতে বড় বড় রোগ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। যেমন: হার্টের সমস্যা, ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ। কিন্তু মায়ের দুধ পান করা শিশুর এ রোগগুলো কম হয়। মায়ের দুধের মধ্যে এমন কিছু উপাদান আছে, যেগুলো কৃত্রিম দুধে এখনও দেওয়া সম্ভব হয়নি।
মায়ের জটিল রোগ কম হয়
সন্তান প্রস্রবের পর অনেক মা মনে করেন, তার অনেক রক্ত বেরিয়ে গেছে, তিনি অনেক ক্লান্ত, ভারী কাজ করতে পারবেন না। এসব সমস্যা সমাধানে জন্য ভূমিষ্ট হওয়ার পর নাড়ি কাটার আগেই শিশুকে মায়ের দুধে দিয়ে দেওয়া উত্তম। এসময় শিশুকে মায়ের পেটের ওপর দিয়ে দিলে, শিশু বেয়ে বেয়ে গিয়ে দুধ খাওয়ার চেষ্টা করবে। এতে জরায়ুটা খুব তাড়াতাড়ি বের হয়ে চলে আসে। ফলে, মায়ের প্রস্রব পরবর্তী জটিলতা কম দেখা দেয়। যেমন: অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের আশঙ্কা কমে যায়, মায়ের রক্তশূন্যতা খুব একটা হয় না এবং মা খুব দ্রুত শক্তি পায়, কষ্ট কমে যায়। যে সমস্ত মা শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ান, তাদের মধ্যে বিভন্ন ধরনের অসুখ যেমন: ক্যান্সার, জরায়ু ক্যান্সার, স্তন ক্যান্সার এগুলো হওয়ার আশঙ্কা কমে যায়। যে সমস্ত মা শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ান, তিনি দেরিতে গর্ভধারণ করেন, প্রাকৃতিকভাবে জন্মনিয়ন্ত্রণ হয়ে যায়। পরবর্তী দুই বছরে পুনরায় গর্ভধারণের সম্ভাবনা মাত্র দুই ভাগ। এটি মায়ের জন্য বাড়তি সুবিধা। মা পরিকল্পনা করে পরিবারকে যেভাবে সীমিত রাখতে চায়, সে উদ্দেশ্যটা সফল হয়ে যায়।
দুধের জন্য মায়ের খাবার ও সচেতনতা
অনেক সময় মা মনে করেন যে, শিশু দুধ পাচ্ছে না। তার অভিযোগের সত্যতা যাচাইয়ের জন্য কিছু বিষয় পরীক্ষা করে দেখা হয়। যেমন: যে ওজন নিয়ে শিশুটি জন্মগ্রহণ করেছে, এক বা দুই মাস পর যে হারে একটি শিশুর বৃদ্ধি পাওয়ার কথা, ওজন মেপে চিকিৎসকরা নিশ্চিত হন, ওজন বৃদ্ধি ঠিক আছে কিনা। দুধ খাওয়ার পরপর শিশু ঘুমিয়ে যায়, নাকি চিৎকার করে? প্রস্রাবের পরিমাণ নির্ণয় করা হয়। দিনে যদি ৬বারের বেশি হয় তাহলে ঠিক আছে বলে ধরা হয়। যেটি চিকিৎসকদের চাওয়া।
যদি এসব ঠিক থাকার পরও শিশু দুধ না পায়, তখন জানতে চাওয়া হয় মা কি খায়? কারণ, মায়ের পুষ্টির একটা ভূমিকাতো আছেই। পুষ্টিকর খাবার না খেলে মা দুর্বল হয়ে যাবে এবং দুধের পরিমাণটা কমে যাবে। এজন্য মাকে একবেলা বেশি খেতে হবে। অন্যরা তিনবেলা খেলে, মা খাবে চার বেলা। অর্থাৎ তিনি এক মিল বেশি খাবেন।
দুধ যেহেতু পানীয় খাবার, তাই তরল জাতীয় খাবারে দুধ উৎপাদন বাড়ে। এজন্য তরল খাবার বেশি খেতে হবে। যেসব খাবারে জলীয় অংশ বেশি থাকে, যেমন: ফল, দুধ, ডাল, স্যুপ, শরবত, সবজি হিসেবে লাউ এ ছাড়া পানি বেশি খেতে হবে। এতে দুধ অনেক বেশি তৈরি হবে।
রাতে মা শিশুকে দুধ দিচ্ছেন কিনা? নাকি ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়ছেন? এ বিষয়টি দেখতে হবে। একবার দুধ খাওয়ানো থেকে আরেকবার দুধ খাওয়ানোর ব্যবধান যদি বেশি হয়, তাহলে দুধের পরিমাণ কমে আসে। এজন্য শিশুর চাহিদা অনুযায়ী শিশুকে ঘনঘন দুধ দিতে হবে। দিনে দিতে হবে, রাতেও দিতে হবে।
বৈজ্ঞানিকভাবে দেখা গেছে যে, মা যদি শিশুকে রাতে ঘনঘন দুধ দেয়, তাহলে মায়ের দুধের অভাব হয় না। পরের দিন খুব ভালো পরিমাণে দুধ তৈরি হয়। পরিবারের লোকজন অনেক সময় মায়ের আরামের কথা চিন্তা করে শিশুকে মায়ের কাছে দেয় না, নানীর কোলে ও দাদীর কাছে থাকে। এ অবস্থার কারণে মায়ের দুধ কমে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে।
সঠিক পদ্ধতি
অধিকাংশ শিশু বুকের দুধ না পাওয়ার মূল কারণ মায়ের খাদ্যাভাস না। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো-মা যখন শিশুকে দুধ খাওয়ান, তখন কিভাবে শিশুকে কোলে নিয়েছেন। শিশুর অবস্থান ও সংযোগ, এ জায়গায় অধিকাংশ মায়ের ত্রুটি থাকে। অনেক শিশু দুধ খাওয়ার সময় সংযোগে ঘাটতি থাকে। ফলে শুধু নিপলটা হয়তো চুষতে থাকে কিন্তু দুধ পায় না। দুধ থাকে নিপলের পিছনে কালো বড় যে জায়গাটা রয়েছে এর নিচে । যতক্ষণ শিশু বড় হা না করছে, ততক্ষণ শিশুর মুখটা ওখানে পৌছাঁচ্ছে না, চাপও পড়ছে না। সুতরাং দুধ আসে না, দুধ থাকলেও শিশু পাচ্ছে না
নিয়ম হলো-দুধ পানের সময় শিশুর মাথা এবং শরীর এক লাইনে থাকবে। এমন থাকা যাবে না যে, মাথা উচু পা ঝুলে আছে। একই সরল রেখায় থাকতে হবে। শিশু মায়ের কাছাকাছি থাকবে, শিশুর চেহারা মায়ের দিকে ঘুরানো থাকবে। শিশু যাতে শক্তি পায় এজন্য মা বাম হাত দিয়ে শিশুর পেছনের অংশ চাপ দিয়ে ধরবে।
সংযোগটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। যেমন: শিশুর মুখ স্তনে ঠিকভাবে লাগছে কিনা? শিশুর মুখ বড় করে হা করা রয়েছে কিনা? এবং তার নিচের ঠোঁট উল্টানো কিনা? বাহিরের দিকে একটু বেরিয়ে আছে কিনা? স্তনের বেশিরভাগ অংশ মুখে ঢুকছে কিনা? থুতনিটা স্তনের সঙ্গে লেগে আছে কিনা? নাকি সেখানে ফাঁকা আছে? এরকম সংযোগের শর্ত পূরণ করে যদি মায়ের স্তনের সঙ্গে শিশুর মুখের সংযোগটা হয়, তাহলে শিশু প্রচুর দুধ পেতে পারে।
সংযোগে ত্রুটি বা মা খাদ্যভাসে পরিবর্তন আনেননি। নিজে ইচ্ছে করে খান না। অনেকের সিজারে যখন শিশু হয় তারা মনে করে বেশি পানি খেলে সেলাই শুকাবে না। শুকনো খাবার খায়, যেমন: চিড়া। ফলে দুধের পরিমাণ কমে আসে। মাকে সঠিকভাবে খেতে হবে। না হলে শিশু পুষ্টি পাবে না। অনেক শিশুর মৃগীরোগ থাকে। সে দুধ চুষতে গেলে ঘেমে যায়, ক্লান্তি বোধ হয় তখন সে ছেড়ে দেয়। এজন্য চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।
স্তনে ব্যথার কারণ
অনেক সময় মা কোনো কাজ করতে গেলে টান দিয়ে শিশুকে ছাড়িয়ে নেয়। এতে নিপলের গোড়ার দিকে ছিঁড়ে যেতে পারে। ফলে ওই স্থানে ব্যথা পায়। শিশু অনেকক্ষণ নিপল চুষার পরও যখন দুধ আসে না তখন সে হতাশ হয়ে নিপল চিপাতে থাকে এবং কামড় দে। ফলে মা স্তনে ব্যথা পায়। দুধের প্রথম অংশ জলীয় থাকে। অর্থাৎ পানিরভাগটা বেশি থাকে। দুধ চুষতে চুষতে এক পর্যায়ে পেছন থেকে যে দুধটা আসে সেটি অনেক ঘন এবং পুষ্টিকর। একটি শিশু যদি মায়ের স্তন সম্পূর্ণ খালি করে না খায়, মা যদি তাড়াহুড়ো করে, শিশুও যদি তাড়াহুড়ো করে তাহলে শুধু জলীয় অংশ পায়। শিশু যখন প্রস্রাব করে তখন এটি বেরিয়ে যায়। ফলে শিশুর শরীরে তেমন পুষ্টি হয় না।
বারবার পায়খানা অসুস্থতা নয়
অনেক মা বলেন, বুকের দুধ খাওয়ানোর পরও শিশু এতো পায়খানা করে, ধুয়ে মুছে সারতে পারি না। এমনও হয় একদিক দিয়ে খাচ্ছে, আরেকদিক দিয়ে মল বের হচ্ছে। এর কারণ, শিশুর পাকস্থলিতে মায়ের বুকের দুধ যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে খাদ্যনালীর ওপর একটু চাপ ও সংকোচন হয়। চাপের কারণে পায়খানা হয়।
তাছাড়া মায়ের বুকের দুধ খুবই মিষ্টি। এ মিষ্টি ভাবটা ল্যাক্টোজ উপাদানের জন্য হয়। অনেক শিশুর এটি সহ্য হয় না। ফলে বারবার পায়খানা হয়। এতে পায়খানার রাস্তার চারপাশটা লাল হয়ে ঘা হয়ে যায়। এখানে ল্যাক্টিক এসিড তৈরি হয়। চামড়া খসখসে হয়ে যায়। তবে এ অসুখ শিশুর ওজন বৃদ্ধির ক্ষেত্রে কোনো প্রভাব পড়ে না। বারবার পায়খান হচ্ছে, মা ভাবছে ডায়রিয়া। চিকিৎসকের কাছে যাচ্ছেন কিন্তু পরীক্ষা করলে কোনো জীবাণু আসে না। এটি শিশু স্বাস্থ্যের কোনো ক্ষতি করে না। ছয় মাস পর শিশুর বাড়তি খাবার যোগ হলে এটি ঠিক হয়ে যায়।
এএইচ