মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষা: নিজের প্রস্তুতির ওপর সন্তষ্ট থাকতে হবে

আগামী ১ এপ্রিল অনুষ্ঠিত হবে এমবিবিএস ভর্তি পরীক্ষা। কেন্দ্রে এক ঘণ্টার মেধার যুদ্ধে সাফল্যের মাধ্যমে নির্ধারিত হবে তাদের স্বপ্ন ছোঁয়ার গল্প। তুমুল প্রতিযোগিতার এ সংক্ষিপ্ত সময়টির যথাযথ ব্যবহার ও শেষ সময়ে পরীক্ষার প্রস্তুতির নানা কৌশল নিয়ে মেডিভয়েসের সঙ্গে কথা বলেছেন ২০২০-২১ সেশনের ভর্তি পরীক্ষায় দ্বিতীয় তানভীন আহমেদ। ভর্তিচ্ছুদের করণীয় ও বর্জনীয় নিয়ে কথা বলার পাশাপাশি দিয়েছেন বিভিন্ন মূল্যবান পরামর্শ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন: সাখাওয়াত হোসাইন।
মেডিভয়েস: শেষ পর্যায়ে মেডিকেল ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের জন্য করণীয় সম্পর্কে বলুন?
তানভীন আহমেদ: মেডিকেলে ভর্তিচ্ছু যারা রয়েছো, তোমাদের জন্য শুভ কামনা। এই পর্যায়ে তোমাদের জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন, মানসিক স্বাস্থ্যের দিকে খেয়াল রাখা। ভর্তি পরীক্ষায় প্রস্তুতির জন্য যে সময়টুকু পেয়েছো, তোমাদের সর্বোচ্চটুকু পড়াশোনায় দিয়েছো। এখন তোমাদের সামনে যে সময়টুকু রয়েছে, এই সময়ে তোমাদের প্রয়োজন পূর্বের পড়াগুলো গুছিয়ে নেওয়া, যে পড়াগুলো লিখে আসতে চাও বা ভালো করতে চাও। সেক্ষেত্রে তোমার মানসিক স্বাস্থ্যের দিকে পুরোপুরি খেয়াল রাখতে হবে।
তুমি যদি এখন ভাবো, অনেক পড়া রয়ে গেছে। রাতে ঘুমানোর সময় কমিয়ে দিই, খাবারের সময় কমিয়ে দিই। এগুলো কখনও করা যাবে না। তোমাকে অবশ্যই মানসিক স্বাস্থ্য ঠিক রাখার জন্য পরিমাণ মতো ঘুম ও খাওয়া-দাওয়ার রুটিন ঠিক রাখতে হবে। মানসিক স্বাস্থ্যের পাশাপাশি যে বিষয়গুলো খেয়াল রাখতে হবে, সেটা হলো পড়াশোনার দিক। ধরো, তোমার সাথে যেসব, বন্ধু-বান্ধব পরীক্ষা দিবে, তারা কিন্তু কখনও সর্বোচ্চ প্রস্তুতি নিয়ে পরীক্ষার হলে আসবে না। তোমার যে পরিমাণ প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে, সেটাতে তোমাকে সন্তুষ্ট থাকতে হবে ও সৃষ্টিকর্তার কাছে সাহায্য চাইতে হবে। তোমার এতটুকু প্রস্তুতির মধ্যে যেন, তিনি বরকত দেন।
আর তুমি যদি মনে করো, আমার প্রস্তুতি এখনও শেষ হয়নি বা রিভিশন দেওয়া শেষ হয়নি। তখন তোমাকে ভাবতে হবে, কেউ তো আসলে শেষ করতে পারছে না। সুতরাং সবার সাথে আমার প্রস্তুতি ঠিকই থাকছে। এখন তোমাকে অবশ্যই মানসিক দিক থেকে সন্তুষ্ট থাকতে হবে। শেষ সময়ে তুমি কোচিংয়ে অনেক পরীক্ষা দিয়েছো। আর কোচিংয়ে যে পরীক্ষাগুলো দিয়েছো, এতে তোমার যে ছোট ছোট ভুলগুলো হয়েছে, সেগুলো অবশ্যই দেখে নিবে।
আর প্রত্যেকটা অনুচ্ছেদের যে অংশগুলো থেকে বেশি প্রশ্ন আসে, সেগুলো অবশ্যই ভালো করে দেখতে হবে। পাশাপাশি ওই অনুচ্ছেদে কোনো লাইন থাকে, যা তোমার মনে রাখতে কষ্ট হচ্ছে; পরীক্ষার আগে অবশ্যই সেগুলো দেখে যেতে হবে। এই বিষয়গুলো খেয়াল রাখতে হবে। আমরা বিগত সময়গুলোতে দেখেছি, সরাসরি কিছু প্রশ্ন চলে আসে। সেগুলো হলো, অনুশীলনী থেকে, ওই প্রশ্নগুলো একবার করে হলেও দেখে যেতে হবে। এগুলো পড়লে তোমাদের জন্য ভালো হবে।
মেডিভয়েস: এই সময়ে আপনার প্রস্তুতি কেমন ছিল, জানতে চাই?
তানভীন আহমেদ: আমি পরীক্ষার এক মাস আগে পরিকল্পনা করে রেখেছিলাম। শেষ মাসে আমি কতবার পড়াগুলো রিভিশন দিব। সেক্ষেত্রে আমি চেষ্টা করেছি, প্রত্যেকটা রিভিশন যেন শেষ হয়। যদিও শেষ পর্যন্ত সবগুলো রিভিশন শেষ করতে পারিনি। তবে চেষ্টা করেছি, যতটুকু হয়, ততটুকুতে যেন আমি সন্তষ্ট থাকি।
আর শেষ মাসের শেষ কয়েকদিনে একবার করে রিভিশন দিয়ে যেতে হবে এবং রিভিশন দেওয়ার পর আমার হাতে যেন একদিন সময় বাকি থাকে। আমার আর কোনো পড়া বাকি থাকবে না। তখন আমি কি করবো? যে পড়াগুলো আমার জন্য কঠিন ছিল বা মনে রাখতে পারছি না, সেগুলো যেন আমি দেখে যেতে পারি। ওইগুলো দেখেই যেন আমি শেষ প্রস্তুতিটা নিয়ে যেতে পারি এবং পরীক্ষার কেন্দ্রে ভালো করতে পারি। যেটা বেশি করেছি, সেটা হলো প্রতিদিন পরীক্ষা দিয়েছি।
এখন সবচেয়ে বেশি যেটা হয়, আমরা যখন প্রস্তুতি নিচ্ছি। তখন নিজের মতো করে প্রস্তুতি নেই। আর পরীক্ষার হলে আমরা মানসিকভাবে যেটা অনুভব করি, সেটা যদি এখন থেকে বুঝে উঠতে না পারি, তাহলে পরীক্ষার কেন্দ্রে সমস্যা হয়ে যাবে। এখন থেকে প্রতিদিন আমরা যে সময়টাতে পরীক্ষা দিব, সে সময়ের হিসাব করে প্রতিদিন কিছু না কিছু পরীক্ষা দিয়ে যেতে হবে। আর পরীক্ষাটা সযত্নে দিতে হবে। সেগুলো খুবই সাবধানে দিতে হবে, যাতে পরবর্তী যে পরীক্ষা আসছে, সেটায় ভালো করা যায়।
মেডিভয়েস: প্রস্তুতির বাইরে প্রশ্ন চলে আসলে করণীয় কি হবে?
তানভীন আহমেদ: তোমাকে যেটা নিশ্চিত করতে হবে, তোমার পরীক্ষায় যে প্রশ্নগুলো আসছে, সেগুলোর মধ্যে একশ’র মধ্যে ১০০টি কখনও পারবে না। সুতরাং তোমাকে সর্বপ্রথম সহজ প্রশ্নগুলোর উত্তর দিয়ে দিতে হবে। সহজগুলো উত্তর করতে করতে একটা সময় দেখবে তুমি কিছু কঠিন প্রশ্নের উত্তরও পারছো। আর যে প্রশ্নগুলো তুমি কখনই দেখনি, সেগুলোর উত্তর করবে না। কারণ নেগেটিভ মার্কিংয়ের জন্য তোমার পজিশন পিছিয়ে যেতে পারে। পজিশন পিছিয়ে গেলে ভালো মেডিকেলে তুমি চান্স নাও পেতে পারো এবং তোমার চান্স চলেও যেতে পারে। আর যে প্রশ্নগুলোর মধ্যে তুমি দুইটা অপশনে অনিশ্চিয়তার মধ্যে আছো, সেগুলো একেবারে নিশ্চিত হয়ে উত্তর দিতে পারো।
মেডিভয়েস: পরীক্ষার আগের রাত এবং সকালে কেন্দ্রে পৌঁছা পর্যন্ত একজন শিক্ষার্থীর করণীয় সম্পর্কে বলুন।
তানভীন আহমেদ: এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন আগের রাতে চেষ্টা করবে তোমার রোলগুলো একবার পূরণ করে যেতে, যেকোনো ওএমআর শিটে। যেহেতু আমরা যখন ওএমআর শিটে রোলগুলো পূরণ করি, সেখানে মাঝে মাঝে ভুল হয়ে যেতে পারে। এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, পরীক্ষায় ভালো করার জন্য। ওএমআর শিটে ভুল করলে পুরো পরীক্ষাটাই বাতিল হয়ে যাবে। চেষ্টা করবে, পরীক্ষার আগের রাতে একটা পরীক্ষা দেওয়ার।
অবশ্যই পরীক্ষার হলে যে প্রস্তুতিগুলো নিয়ে যেতে হবে, সেগুলো পরীক্ষার আগের দিন রাতেই ঠিক করে রাখবে। যেমন- তোমার কলম, এডমিট কার্ড ও আনুসাঙ্গিক যে জিনিসপত্রগুলো তোমার প্রয়োজন রয়েছে। আর চেষ্টা করবে পরীক্ষার হলে কিছুটা আগে যাওয়ার জন্য, এমন না যে, অনেকক্ষণ আগে চলে যাবে। কেন্দ্রে গিয়ে দেখলাম, সবাই কি করে! বিষয়টা যেন এমন না হয়। এক্ষেত্রে তোমার চিন্তার পরিসরটা বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে।
মেডিভয়েস: প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার আগের রাতে বা কিছুদিন আগে সামাজিক বিভিন্ন মাধ্যমে ভুয়া প্রশ্ন ফাঁসের গুজব ছড়িয়ে পড়ে। এ ব্যাপারে একজন মনোযোগী শিক্ষার্থীর করণীয় কি?
তানভীন আহমেদ: সর্বপ্রথম কথা হলো, পরীক্ষার আগে যদি তুমি শোনো, পরীক্ষায় এই প্রশ্নটা আসছে। তোমার এখানে কান দেওয়ার কোনো প্রয়োজন নাই। এত দিন যে প্রস্তুতি নিয়েছো, সেটাতেই তোমার হয়ে যাবে। সুতরাং পরীক্ষার আগে কোনোভাবেই অসদুপায় অবলম্বন করা যাবে না। তুমি যখন শুনবা এই প্রশ্নগুলো আসছে, সেগুলোকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করবে।
মেডিভয়েস: যেকোনো প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় একটু স্নায়ু চাপ থাকে, এ থেকে রক্ষা পেতে কি করা যেতে পারে?
তানভীন আহমেদ: প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় অবশ্যই স্নায়ু চাপ থাকবে। চেষ্টা করবে যতটুকু সম্ভব চিন্তা কম করা যায়। তুমি যদি ভাবো, এক লাখের উপরে শিক্ষার্থী পরীক্ষা দিচ্ছে, স্বাভাবিকভাবে চিন্তা বেড়ে যাবে। উচ্চাকাঙ্ক্ষা নিয়ে পরীক্ষার হলে যাওয়ার দরকার নেই। তোমার মাথায় রাখতে হবে, আমি একটা পরীক্ষা দিতে যাচ্ছি। সেটা আমার কোচিংয়ের মতোই হবে। আমার এই পরীক্ষাটা হলো শেষ পরীক্ষা এবং এই পরীক্ষাটা সবচেয়ে ভালো দিবো। সুতরাং সেইভাবে তুমি প্রস্তুতি নিয়ে যাবে। তুমি শুধু নিজের প্রস্তুতি নিয়ে চিন্তা করবে, এমন যেন না হয় আমার পাশের বন্ধুটি কিভাবে প্রস্তুতি নিয়েছে, সে কেমন পরীক্ষা দিচ্ছে, এগুলো কখনও ভাবার দরকার নেই। সুতরাং সবসময় নিজের উপর ফোকাস থাকবে।
মেডিভয়েস: পরীক্ষার কেন্দ্রে টাইম ম্যানেজমেন্টটা কেমন হওয়া জরুরি।
তানভীন আহমেদ: পরীক্ষার কেন্দ্রে প্রশ্ন পাওয়ার পর সেটা তুমি কয়েকবার দেখবে। প্রথম যে রিভিশনটা যাবে, সেক্ষেত্রে সেই প্রশ্নগুলোরই উত্তর করবে। যেগুলো সবচেয়ে সহজে তুমি উত্তর দিতে পারো এবং যেগুলো কখনও ভাবা লাগছে না। প্রথমবার যখন সহজ প্রশ্নের উত্তর দিয়ে ফেলবে। দ্বিতীয় রাউন্ডে আসবে, কিছুটা কঠিন প্রশ্ন, যেগুলোর মধ্যে আছে ম্যাথ, পরে কিছুটা হলেও চিন্তা করা লাগছে, সেগুলোর উত্তর করবে। তৃতীয় ধাপে তার চেয়েও কিছুটা জটিল প্রশ্নের উত্তর করার চেষ্টা করবে। তবে এমন কোনো প্রশ্নের উত্তর করবে না যেগুলো কখনই দেখনি।
মেডিভয়েস: যাদের প্রস্তুতি কম, তাদের জন্য কী করণীয়?
তানভীন আহমেদ: সবার পক্ষে সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। তুমি দেখবে, তোমার প্রস্তুতিতে কিছুটা ঘাটতি রয়ে গেছে। তোমার অন্যান্য বন্ধুদেরও কিছুটা ঘাটতি থাকবে। এগুলো নিয়ে কখনও চিন্তা করবে না। ধরো, তোমার প্রস্তুতি অনেকটাই কম। সেক্ষেত্রে তুমি দেখবে, কোথা থেকে সব চেয়ে বেশি প্রশ্ন এসেছে। অর্থাৎ বিগত বছরগুলোর যেসব অনুচ্ছেদ থেকে বেশি প্রশ্ন এসেছে, সেগুলো তুমি পরীক্ষার আগে দেখে যাওয়ার চেষ্টা করবে এবং পাশাপাশি তোমার পড়া যে প্রশ্ন বেশি পরিমাণে এসেছে, সেগুলো পড়ে যাওয়ার চেষ্টা করবে। ইংরেজি বা সাধারণ জ্ঞানের ক্ষেত্রে, পূর্বের বিসিএস বা মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষা বা ডেন্টাল ভর্তি পরীক্ষায় যে প্রশ্নগুলো এসেছে, সেগুলো পড়ে যাবে।
তানভীন আহমেদের বেড়ে ওঠা
বাবার চাকরিসূত্রে যশোরে জন্মগ্রহণ করেন তানভীন আহমেদ। বেড়ে ওঠেন ঢাকা, যশোর ও টাঙ্গাইলে। যদিও তাঁর গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহ জেলায়। তাঁর বাবা বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর একজন অবসরপ্রাপ্ত সার্জেন্ট। টাঙ্গাইলের বিএএফ শাহীন স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এসএসসি ও এইচএসসি পাস করেন তানভীন। পরিবারের তিন ভাই-বোনের মধ্যে সবার বড় তিনি। ২০২০-২১ সেশনে এমবিবিএস ভর্তি পরীক্ষায় দ্বিতীয় স্থান অর্জন করে তানভীন আহমেদ বর্তমানে ঢাকা মেডিকেল কলেজে অধ্যয়নরত আছেন। ছোটবেলা থেকে তানভীন আহমেদ মেধাবী মুখ হিসেবে সবার কাছে পরিচিত ছিল।
এমইউ