অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ

অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ

ভাইস চ্যান্সেলর 
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়


১৭ মার্চ, ২০২২ ০৪:১৮ পিএম

বঙ্গবন্ধু জন্ম থেকে জন্মান্তরে

বঙ্গবন্ধু জন্ম থেকে জন্মান্তরে
তরুণ প্রজন্ম এই মহান নেতার আদর্শ থেকেই দেশ গড়ার অনুপ্রেরণা লাভ করে। ছবি: সংগৃহীত।

বাঙালির বহু বছরের পরাধীনতার শৃঙ্খল ভাঙার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর বলিষ্ঠ এবং সুদূর প্রসারী নেতৃত্বে বিশ্বের বুকে জন্ম নিয়েছিল বাংলাদেশ নামের নতুন একটি জাতিরাষ্ট্র। সেই মহানায়কের আজ ১০২তম জন্মদিন।

বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতার স্থপতি, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিববুর রহমান ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ তদানীন্তন ভারতবর্ষের বঙ্গ প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার টুঙ্গীপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম শেখ লুৎফর রহমান এবং মাতার নাম সায়েরা খাতুন। চার কন্যা এবং দুই পুত্রের সংসারে শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন তৃতীয় সন্তান। 

সুদূর অতীতকাল থেকেই গোপালগঞ্জ জেলা মাছের জন্য বিখ্যাত ছিলো। বঙ্গবন্ধুর বাড়ির আশে পাশে প্রচুর বিল ছিলো। সেই সব বিলে পাওয়া যেতো প্রচুর মাছ, যার ফলে বঙ্গবন্ধুর খাওয়া দাওয়া ছিলো যথেষ্ট পুষ্টিকর। এ কারণেই বোধ হয় বঙ্গবন্ধুর ছোটবেলায় তেমন কোন স্বাস্থ্যজনিত সমস্যা হয়নি। তবে বঙ্গবন্ধু ১৪ বছর বয়সে বেরিবেরি রোগে আক্রান্ত হন। বেরিবেরি রোগটা মূলত ভিটামিন বি-১ বা থায়ামিন এর অভাবে হয়। বেরিবেরি তখন মহামারি আকার ধারণ করেছিলো, কারণ তখন খাবারে ভিটামিন বি-১ এর অভাব ছিলো। এ রোগটি নিরাময়ে রোগীকে বি-১ সমৃদ্ধ খাবার দিতে হয়। বঙ্গবন্ধু কিছুদিন এ রোগে ভোগার পর  বি-১ সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণের মাধ্যমে সুস্থ হয়ে উঠেন। 

গ্রামের স্কুলে বঙ্গবন্ধুর লেখাপড়ার হাতেখড়ি। স্কুল জীবনেই তিনি রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। ১৯২৭ সালে শেখ মুজিব গিমাডাঙ্গা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়া শোনা শুরু করেন। ১৯২৯ সালে গোপালগঞ্জ পাবলিক স্কুলে ভর্তি হন এবং ১৯৩৪ সাল পর্যন্ত সেখানে তিনি পড়াশোনা করেন। ১৯৩৭ সালে গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি হন। ১৯৪১ সালে অসুস্থ শরীর নিয়েই ম্যাট্রক পরীক্ষা দেন। 

গোপালগঞ্জের মিশন স্কুলে অষ্টম শ্রেণিতে অধ্যয়নকালে তৎকালীন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে যোগদানের কারণে শেখ মুজিবুর রহমান প্রথমবারের মতো গ্রেফতার হয়ে কারাবরণ করেন। এরপর থেকে শুরু হয় বঙ্গবন্ধুর আজীবন সংগ্রামী জীবনের অভিযাত্রা। বঙ্গবন্ধু তাঁর সহকর্মীদের নিয়ে ১৯৪৮ সালে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ এবং পরবর্তীতে ১৯৪৯ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ গঠন করেন। '৪৭- এর দেশবিভাগ ও স্বাধীনতা আন্দোলন, '৫২-এর ভাষা আন্দোলন, '৫৪-এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, '৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, '৬৬-এর ছয় দফা আন্দোলন, '৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান পেরিয়ে '৭০ সালের ঐতিহাসিক নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন। তার অবিসংবাদিত নেতৃত্বে ৯ মাসব্যাপী রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র যুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত হয় স্বাধীনতা। বিশ্ব মানচিত্রে অভ্যুদয় ঘটে স্বাধীন বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের।

বঙ্গবন্ধুর বয়স যখন ৩০ বা ৩৫ তখন তাঁর চোখে গ্লুকোমা ধরা পড়ে। গ্লুকোমা হলে চোখের প্রেশার বেড়ে যায়। বঙ্গবন্ধুর গ্লুকোমা প্রাথমিক ভাবেই ধরা পড়ে। তিনি কালো মোটা চশমা পরতেন। কাকতালীয়ভাবে বর্তমানে আমি যেখানে প্রাকটিস করি অপটিকস ম্যান, বঙ্গবন্ধু এভিনিউ-বঙ্গবন্ধুর সব চশমা ওখান থেকে নিতেন। বঙ্গবন্ধুর গ্লুকোমা চিকিৎসার জন্য প্রথমে কোলকাতা যান, পরে দেশে ফিরে চক্ষু বিশেষজ্ঞ ডা. টি আহমেদের কাছে চিকিৎসা নিয়েছেন। চিকিৎসার জন্য কোলকাতা যাওয়ার এই ঘটনা বঙ্গবন্ধুর মধ্যে দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থাকে উন্নত করার জন্য এক ধরনের প্রভাবক হিসেবে কাজ করে। দেশের মানুষের জন্য কিভাবে চিকিৎসাসেবা আরও উন্নত ও সহজলভ্য করা যায়, এই ভাবনা জীবনের শেষ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর মধ্যে বিদ্যমান ছিলো। স্বাধীনতার পর দেশ পুরোপুরি ধ্বংসস্তুপ। দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক অবস্থা খুব খারাপ, বাজেট কম, তারপরও বঙ্গবন্ধু আরও নতুন নতুন মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন।

মেডিকেল আন্ডারগ্রাজুয়েট ও পোষ্টগ্রাজুয়েট শিক্ষার মাধ্যমে দেশের ডাক্তার সংকট নিরসনের প্রচেষ্টা চালান। এফ আর সি এস শেষ করা বহু ডাক্তার বিদেশ ছিলো, তাদেরকে দেশে ডেকে আনেন। তখন স্বদেশে তারা চিকিৎসা সেবা শুরু করেন। সদ্য স্বাধীন দেশে যা যা করণীয় বঙ্গবন্ধু তাই করলেন। শিক্ষা, সেবা, পুষ্টি, প্রিভেনশন অব ব্লাইন্ডনেস কার্যক্রম পরিচালনার ব্যবস্থা করেন। তিনি ই পি আই প্রোগ্রাম চালু করেন। জনসংখ্যা বৃদ্ধি রোধ করতে ১৯৭৩ সালে পরিবার পরিকল্পনা বিষয়ে বিশেষ দিক নির্দেশনা দেন এবং অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে এই খাতে কিছুটা বাস্তববাদী পরিবর্তন আনতে দেশের স্বাস্থ্য খাতের জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছিলেন তিনি। ১৯৭২-১৯৭৫ সময়কালে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের দ্রুত সুস্থতার জন্য বিশেষ চিকিৎসা নিশ্চিত করতে প্রথম পদক্ষেপ নিয়েছিলেন তিনি। গুরুতর আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা নিশ্চিত করার জন্য হাজার হাজার আহত মুক্তিযোদ্ধাকে পূর্ব জার্মানি, তৎকালিন সোভিয়েত ইউনিয়ন (বর্তমানে রাশিয়া), ভারত, চেকোস্লোভাকিয়া এবং ফ্রান্সে প্রেরণ করেছিলেন। 

যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলাদেশে ওষুধের বিশাল সংকট ছিল। সাধারণ মানুষের চিকিৎসা ও তাদের ওষুধ বিনামূল্যে দেওয়ার ক্ষেত্রে একটি বড় বাধা ছিল। বঙ্গবন্ধু তখন দেশের চাহিদা মেটাতে বিদেশ থেকে ওষুধ আমদানির জন্য বাংলাদেশ ট্রেডিং কর্পোরেশন (টিসিবি)কে নির্দেশনা দিয়েছিলেন। তিনি স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলির চাহিদা অনুযায়ী ওষুধ যথাযথভাবে বিতরণের জন্য আমদানি করা ওষুধ তাৎকালীন মেডিকেল এ্যাসোসিয়েশনের কাধে হস্তান্তর করেছিলেন। ওষুধ উৎপাদনে পরিবর্তন এনেছিলেন। এক দিকে সর্বাধিক ওষুধ তখন কয়েকটি বহুজাতিক কোম্পানির দ্বারা উৎপাদিত হত, যা ব্যয় বহুল ছিল। অন্যদিকে চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করা মানুষের পক্ষে সাশ্রয়ী ছিল না। তখন তিনি ফার্মাসিউটিক্যাল সংস্থাগুলিকে বহুজাতিক সংস্থার সব ধরনের ওষুধ উৎপাদন করার জন্য নির্দেশনা দিয়েছিলেন। ১৯৭৪ সালে তিনি বাংলাদেশ স্বাস্থ্য এবং পুষ্টি ইনস্টিটিউট এবং স্বাস্থ্য ও পুষ্টি কোর্স চালু করেন। প্রত্যেক থানায় থানায় হেলথ কমপ্লেক্স করার ব্যবস্থা নিলেন। এবং ১৩৮ টা হেলথ কমপ্লেক্স প্রতিষ্ঠা করেন। নিপসমের ওখানে আই পি এইচ ইন্সটিউট অব পাবলিক হেলথ, ইন্সটিউট অব নিউট্রিশিয়ান স্থাপন করেন। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ, পুষ্টি, স্বাস্থ্য প্রত্যেক মানুষের দোড়গোড়ায় যেন পৌঁছে দেয়া যায় সেই ব্যবস্থা করেছেন।

দেশের পুষ্টি চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে পুষ্টিনীতি প্রণয়ন করেন বঙ্গবন্ধু। তিনি গবেষণার জন্য বি এম আর সি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে চিকিৎসা ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা দূর করার পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। বাংলাদেশ মেডিকেল ও ডেন্টাল কাউন্সিল বি এম ডি সি প্রতিষ্ঠিা করেন। বঙ্গবন্ধু, নার্স ডাক্তার সেবা মিডওয়াইফার তৈরির জন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন। কলেরা হাসপাতাল, আই সি ডি ডি আর বি ও আইডিসিএইচ হাসপাতাল তৈরি করেন। সারাদেশে তখন মাত্র ৬৭ টি হাসপাতাল ছিলো। তিনি ৩১ শয্যাবিশিষ্ট  ৩৭৫ টি থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স তৈরি করেন।

স্বাধীনতা উত্তরকালে বঙ্গবন্ধুর সরকারই প্রথম এ দেশের পল্লী অঞ্চলের সাধারণ মেহনতি মানুষের স্বাস্থ্য সেবার কথা বিবেচনা করে, চিকিৎসা সেবাকে থানা পর্যায়ে পৌঁছে দেওয়ার উদ্দেশ্যে থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স চালু করেন, চিকিৎসকদের সরকারি চাকুরিতে সম্মান ও মর্যাদার কথা বিবেচনা করে পদমর্যাদা দ্বিতীয় শ্রেণি থেকে প্রথম শ্রেণিতে উন্নীত করেছিলেন। যা দেশের চিকিৎসক সমাজ চিরদিন শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ রাখবে। মেডিকেল উচ্চ শিক্ষার জন্য বঙ্গবন্ধু শাহবাগ হোটেলকে আই পি জি এম আর এ উন্নীত করেন। ১৯৭২ সালে অধ্যাদেশের মাধ্যমে স্নাতকোত্তর ডিগ্রির জন্য বাংলাদেশ কলেজ অফ ফিজিশিয়ান অ্যান্ড সার্জারি (বিসিপিএস) প্রতিষ্ঠা করেন। 

স্বাধীন বাংলাদেশের রূপকার এই মহান নেতার জন্মদিনে গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি। কোনো বিশেষ ঘটনা বা আনন্দের দিনকে শিশু দিবস হিসেবে পালন করা হয়। বাংলাদেশের মানুষের জন্য সবচেয়ে বেশি আনন্দের দিন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিন। বাংলার হাজার বছরের ইতিহাসে বঙ্গবন্ধু একজনই জন্মেছিলেন। যার জন্ম না হলে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম হতো না। এজন্য ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনকে জাতীয় শিশু দিবস হিসেবে পালন করা হয়। বঙ্গবন্ধু শিশুদের অত্যন্ত আদর করতেন, ভালোবাসতেন। শিশুদের সাথে গল্প করতেন, খেলা করতেন। তিনি বিশ্বাস করতেন আজকের শিশুরাই আগামীদিনে দেশ গড়ার নেতৃত্ব দিবে। তরুণ প্রজন্ম এই মহান নেতার আদর্শ থেকেই দেশ গড়ার অনুপ্রেরণা লাভ করে। যারা বাংলাদেশকে বিশ্বাস করে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ধারণ করে, তাদের মাঝেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বেঁচে থাকবেন জন্ম থেকে জন্মান্তরে।

মেডিভয়েসের জনপ্রিয় ভিডিও কন্টেন্টগুলো দেখতে সাবস্ক্রাইব করুন MedivoiceBD ইউটিউব চ্যানেল। আপনার মতামত/লেখা পাঠান [email protected] এ।
  এই বিভাগের সর্বাধিক পঠিত
এক দিনে চিরবিদায় পাঁচ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক
করোনা ও বার্ধক্যজনিত অসুস্থতা

এক দিনে চিরবিদায় পাঁচ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক