ডা. ইসমেত জাহান আলো

ডা. ইসমেত জাহান আলো

বিসিএস (স্বাস্থ্য)
এমডি (প্যাডিয়াট্রিক্স)


১৪ মার্চ, ২০২২ ১২:১৬ পিএম

নাপা খেয়ে দুই শিশুর মৃত্যু: রহস্য ও কিছু কথা

নাপা খেয়ে দুই শিশুর মৃত্যু: রহস্য ও কিছু কথা
প্রতীকী ছবি

বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড উৎপাদিত নাপার আসল নাম প্যারাসিটামল, আরও আসল নাম হলো এসিটামিনোফেন। জ্বর, ব্যথায় এটা খুব কমন ওষুধ।

মায়েদের খুব প্রিয় একটি ওষুধ এটি। ‘মন খারাপ’, ‘ভাল্লাগে না’ থেকে শুরু করে যেকোনো শারীরিক অসুস্থতায় তারা এটি খেতে বলেন। 

ফার্মেসিতে গেলেও অনায়াসেই মেলে ওষুধটি।

স্বাভাবিক মাত্রায় প্যারাসিটামল খাওয়ার পর তার অধিকাংশ পরিমাণ লিভারে গিয়ে অক্ষতিকর উপাদানে রূপান্তরিত হয়।

আর মাত্র ৫ শতাংশ cytochrome p-450 enzyme এর মাধ্যমে highly reactive metabolite অর্থাৎ ক্ষতিকর NAPQ-I তে রূপান্তরিত হয়।

তবে সুখের বিষয় হলো, এই ক্ষতিকর উপাদান আবার যখন লিভারের glutathione এর সাথে যুক্ত হয়, তখন গ্লুটাথিয়ন এই টক্সিক উপাদানকে detoxify করে অর্থা টক্সিক উপাদান দূর করে দিয়ে তাকে Cystine and mercaptopurin acid নামে রূপান্তর করে প্রস্রাবের মাধ্যমে শরীর থেকে বের করে দেয়।

এখন যদি কোনো বাচ্চা তার ওজনের 200mg/kg body weight প্যারাসিটামল অথবা কিশোর কিংবা বড় কেউ 7.5-10 গ্রাম প্যারাসিটামল খেয়ে নেয়, তাহলে এই অতিরিক্ত পরিমাণের প্যারাসিটামল স্বাভাবিকভাবেই অতিরিক্ত পরিমাণে NAPQ-I তৈরি করবে। আর তখন এই অতিরিক্ত NAPQ-I কে লিভার থেকে বের করতে বেশি পরিমাণে গ্লুটাথিয়ন প্রয়োজন হবে।

কিন্তু তখন লিভার প্রয়োজনের তুলনায় এই অতিরিক্ত পরিমাণে গ্লুটাথিয়ন সাপ্লাই দিতে পারবে না। ফলশ্রুতিতে NAPQ-I টক্সিক হিসেবেই লিভারে থেকে যাবে আর লিভারের কোষগুলো ধ্বংস করতে থাকবে। এতে লিভার ইঞ্জুরি হওয়া শুরু করবে। 

বিভিন্ন গবেষণার মাধ্যমে দেখা গেছে, ০-৬ বছরের বয়সী শিশুদের acute toxicity তে মৃত্যু কিংবা লিভারের কোষগুলো ধ্বংস হওয়ার পরিমাণ অনেক কম। এর কারণ হিসাবে গবেষকরা বলেছেন, 

♦ছোট শিশুদের লিভার সাইজ বড়, যে কারণে তাদের মেটাবলিজম বেশি হয়। 
♦শিশুদের NAPQ-I কে Detoxifying করার pathway বড়দের চেয়ে কিঞ্চিৎ আলাদা। 

developmental difference in drug metabolusm in children গবেষণায় দেখা গেছে,

♦ছোট শিশুদের acute poisoning এ লিভার কোষ ধ্বংস হওয়ার আশঙ্কা কম। 
♦শিশুদের লিভার কোষ ধ্বংস হয় দীর্ঘমেয়াদি (chronic) পয়জনিংয়ে। 

অর্থাৎ একিউট প্যারাসিটামল পয়জনিং হতে হলে

♦বাচ্চাদের ক্ষেতে ডোজ হলো ২০০মি. গ্রা./শরীরের ওজন (বাচ্চাদের এক চামচে ১২০ মি. গ্রা., নবজাতক দের ড্রপে ১ মি. লিটারে ৮০ মি. গ্রা. প্যারাসিটামল থাকে)। 
♦কিশোর থেকে বড়দের ৭.৫-১০ গ্রাম ওষুধ সেবন করতে হবে।

ট্যাবলেটে ২৫০,৫০০,৬২৫ মি. গ্রা. থাকে, এখন অবশ্য ১ গ্রামের ট্যাবলেটও পাওয়া যায়।

♦শিশুদের ক্ষেত্রে 75mg/kg এর কম হলে হেপাটোটক্সিসিটির আশঙ্কা খুব কম।

♦টক্সিক ডোজে ওষুধ সেবনের এক ঘণ্টার মধ্যে চিকিৎসকের কাছে আসলে activated charcoal দিয়ে gastric lavage দেওয়া যেতে পারে, তবে এটি মূলত প্যারাসিটামলের absorption কমাবে। 

লিভারের কোষগুলো ধ্বংস রোধ করবে কিনা এ নিয়ে মতভিন্নতা আছে। 

গবেষণায় বলে প্যারাসিটামল সেবনের ১৫ মিনিটের মধ্যে তা মোটামুটি absorption হয়ে যায়, আর ১৫মিনিটের মধ্যে তো আর হাসপাতালে আনা সম্ভব হয় না। কাজেই জোর করে বমি করানোর প্রয়োজন নেই। 

টক্সিক মাত্রায় প্যারাসিটামল খাওয়ার ৮ ঘণ্টার মধ্যে নিয়ে আসলে সেই NAPQ-I কে রোধ করতে এন্টিডট দিতে হবে, যার নাম হচ্ছে N Acetylcystine বাজারে viscotin/Tylac (600mg) নামে পাওয়া যায়। 

ডোজ হচ্ছে: 140mg/kg followed by maintanance dose 70mg/kg. প্রতি চার ঘণ্টা পর পর ১৭ ডোজ বা যতখন পর্যন্ত লিভারের এনজাইমগুলো স্বাভাবিক মাত্রায় নেমে না আসছে (AST>ALT>INR).

প্যারাসিটামল পয়জনিংয়ে সর্বোচ্চ চিকিৎসা লিভার ট্রান্সপ্লান্ট (সবার না যাদের ইন্ডিকেশন আছে)

প্যারাসিটামল সেবনের পর

প্রথম ২৪ ঘণ্টায় শুধুমাত্র বমি, বমি বমি ভাব, ক্ষুধামন্দা দেখা দিতে পারে। 

রক্তে Acetaminophen এর লেভেল বাড়তে পারে, তবে বাকি লিভার এনজাইমগুলো স্বাভাবিক থাকবে।

২৪-৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ডান দিকের উপরের পেটে তীব্র ব্যথা হতে পারে।

লিভার এনজাইমগুলো বাড়বে (AST>ALT>INR).

৩-৫ দিনের মধ্যে লিভারের কোষগুলো আরো ধ্বংস হবে, লিভার ফেইলিউর পর্যন্ত হতে পারে।

সঠিক চিকিৎসা পেলে ৪ দিন থেকে ২ সপ্তাহের মধ্যে রোগীর সেরে ওঠা সম্ভব।

কাজেই যত্রতত্র ফার্মেসি থেকে নিয়ে শিশুদের প্যারাসিটামল দিবেন না।

আর আসল ঘটনা উন্মোচিত হওয়ার আগ পর্যন্ত আতঙ্কিত হবেন না। কারণ একদিনে নাপা খেয়ে মৃত্যুর ব্যাপারটা আনইউজুয়াল। 

মেডিভয়েসের জনপ্রিয় ভিডিও কন্টেন্টগুলো দেখতে সাবস্ক্রাইব করুন MedivoiceBD ইউটিউব চ্যানেল। আপনার মতামত/লেখা পাঠান [email protected] এ।
  এই বিভাগের সর্বাধিক পঠিত