ডা. হামীম ইবনে কাওছার

ডা. হামীম ইবনে কাওছার

এমডি, পিএইচডি, এফএসিপি 
হেমাটোলজি এন্ড অনকোলজি 
ইউনিভার্সিটি অব ক্যানসাস যুক্তরাষ্ট্র।


০৪ মার্চ, ২০২২ ১১:১৩ এএম

কৃত্রিম হৃদপিণ্ড প্রতিস্থাপন নয়, হৃদপিণ্ডের সঙ্গে পাম্প মেশিন স্থাপন

কৃত্রিম হৃদপিণ্ড প্রতিস্থাপন নয়, হৃদপিণ্ডের সঙ্গে পাম্প মেশিন স্থাপন
এই পাম্প মেশিনটির খরচ গড়ে দুই লাখ মার্কিন ডলার (এক কোটি ৮০ লাখ টাকার মতো) কোথাও কম কোথাও আরো বেশি লাগে। ছবি: সংগৃহীত

একটা সুখকর খবরে বাংলাদেশ মেতে আছে। চিকিৎসা বিজ্ঞানের একটি মাইলস্টোনের জন্য। সোশ্যাল মিডিয়া সয়লাব একটি খবরে। তাতে বলা হচ্ছে বাংলাদেশে প্রথম কৃত্রিম হৃদপিণ্ড প্রতিস্থাপন হয়েছে। এই খবরের পাশাপাশি একটি শৈল্পিক যন্ত্রের ছবি দেখানো হচ্ছে। স্বভাবতই মানুষের মনে প্রশ্ন আসতে পারে যে বুকের মধ্যখানে মানুষের নিজস্ব হৃদপিণ্ড বের করে ফেলে এই যন্ত্রটি কি বুকের মধ্যে বসিয়ে দেয়া হয়? মানুষকে কি তাহলে এই যন্ত্রটি বাঁচিয়ে রাখে? আমার মনে হয়েছে এই ভুলভ্রান্তি মানুষের মন থেকে দূর করে প্রকৃত বিষয়টি জানানো দরকার। 

আমি ‘হৃদয় বিশেষজ্ঞ’ কিন্তু ‘হৃদপিণ্ড বিশেষজ্ঞ’ নই। আমি সর্বজান্তাও নই, এ কারণে আমি সাধারণত আমার জানা-শোনার গণ্ডির বাইরে গিয়ে কিছু লিখি না বা মন্তব্য করি না। কিন্তু এই বিষয়ে বাধ্য হয়ে লিখতে হলো, যাতে মানুষ আসলে জানতে পারে কৃত্রিম হৃদপিণ্ড প্রতিস্থাপন বিষয়টা কি?

প্রথমে জানা যাক, কাদের জন্য এই মেশিনটা ব্যবহৃত হয়। আপনারা জানেন, যখন আমাদের হৃদপিণ্ড যথেষ্ট পরিমাণ রক্ত পাম্প বা সঞ্চালন করতে না পারে, তখন আমরা তাকে হার্ট ফেইলিউর বলি (প্রকৃতপক্ষে সিস্টোলিক হার্ট ফেইলিউর অথবা হার্ট ফেইলুর উইথ রিডিউসড ইজেকশন ফ্রাকশন বলি) হৃদপিণ্ডের বাম নিলয় বা লেফট ভেন্টিকিউল এর মধ্যে আসা রক্তের প্রায়  ৬০-৭০% রক্ত পাম্প করে এওর্টাতে পৌঁছে দেয়। যাতে বিশুদ্ধ রক্ত সারা শরীরে প্রবাহিত হতে পারে। এই রক্ত সারা শরীরে অক্সিজেন প্রদান করে। কোনো কারণে যদি লেফট ভেন্ট্রিকিউলের এই পাম্পিং ক্ষমতা কমে যায়, বিশেষ করে ৪০-৪৫% নিচে নেমে আসে, তখন এটিকে সিস্টোলিক হার্ট ফেইলিউর বলে। এর জন্য অনেক চিকিৎসা আছে, অনেক রকম ওষুধ আছে। সর্বশেষ আবিষ্কৃত ওষুধ হলো- সাকুবট্রিল এবং ভালসারটান এর মিশ্রণের একটি ওষুধ। যেটি আমেরিকায় এনট্রেসটো নাম বিক্রি হয়। এই  ওষুধে যখন কাজ না হয়, তখন ইজেকশন ফ্রাকশন আরো কমে যেতে থাকে। বিশেষ করে ২০% এর নিচে নেমে গেলে হঠাৎ মৃত্যু বা ‘সাডেন কার্ডিয়াক ডেথ’ এর সম্ভাবনা বেড়ে যায়। তখন রোগীদের গায়ে পরে থাকার মতো ভেস্ট বা লাইফ ভেস্ট দেয়া হয়। যার মধ্যে মূলত ডিফিব্রিলেটর থাকে। এই রোগীদের হার্ট ট্রান্সপ্লান্ট করতে বলা হয়। সমস্যা হলো-চাইলেই তো আর হার্টের ডোনার পাওয়া যায় না, যে কারণে হার্ট ট্রান্সপ্লান্টও দ্রুত বা সহজে হয় না। তাহলে, এই রোগীদের কিভাবে বাঁচিয়ে রাখা যায়?

উপরের এই প্রশ্নের উত্তর দেয়ার জন্য একটি যন্ত্র আবিষ্কার করা হয়। এর নাম ‘লেফট ভেন্ট্রিকুলার এসিস্ট ডিভাইস’ বা  LVAD  অথবা মেকানিক্যাল সার্কুলেটরি সাপোর্ট বা MCS! এই যন্ত্রটি বসানোকেই বাংলাদেশে কৃত্রিম হৃদপিণ্ড প্রতিস্থাপন হিসেবে প্রচার করে হচ্ছে। আসলে এই খবর এবং ব্যাখ্যা দুটোই ভুল। এখানে কোনো হৃদপিণ্ড প্রতিস্থাপনই হচ্ছে না। এখানে যেটা হচ্ছে, তা হলো-রোগীর লেফট ভেন্ট্রিকলের মধ্যে একটি ছিদ্র করে সেখান থেকে রক্ত বের করে নিয়ে আসা হচ্ছে একটা পাম্পের মধ্যে। যে পাম্পটা হৃদপিণ্ডের নিচের দিকে সংযুক্ত করে দেয়া হয়। এই পাম্প লেফট ভেন্ট্রিকলের রক্ত সরাসরি এওর্টার মধ্যে পৌঁছে দেয়। এই পাম্পকে নিয়ন্ত্রণের জন্য তার, সুইচ এবং ব্যাটারি শরীরের বাইরে থাকে। যা রোগী একটা বেল্ট বা ব্যাগের মাধ্যমে শরীরে পরে থাকেন। 

প্রয়োজনমতো ব্যাটারি বাইরে থেকে পরিবর্তনও করা যায়। হার্টে ব্যবহৃত এই যন্ত্র বিভিন্ন মডেলের আছে। আমেরিকার মোটামুটি বড় হাসপাতালে এটি অহরহ করা হয়। ক্লিভল্যান্ড ক্লিনিক অবশ্যই তাদের মধ্যে অন্যতম বিখ্যাত। বিভিন্ন মডেলের পাম্প আছে, বিভিন্ন নাম আছে, তবে কাজ মোটামুটি একই। যে পাম্পটি সবচেয়ে বেশি হয় সেটি তৈরি করে এবট ফার্মাসিউটিক্যাল, তাদের এই মেশিনের ব্র্যান্ড নাম ‘হাৰ্টমেট’। তাছাড়া আছে ‘হার্টওয়ার’ এই যন্ত্রটি সাধারণত ব্যবহার করা হয়, যখন একজন মানুষের হার্ট ফেইলিউর আছে কিন্তু সহসাই হার্ট ট্রান্সপ্লান্ট করা যাচ্ছে না, তাদেরকে এই অপেক্ষা করার সময়টুক (কয়েক মাস থেকে কয়েক বছর) বাঁচিয়ে রাখার জন্য ‘ব্রিজ টু ট্রান্সপ্লান্ট’ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। আমেরিকায় এই ডিভাইস কেনা এবং স্থাপন (বাংলাদেশে যে ‘প্রতিস্থাপন’ শব্দটি ব্যবহার করা হচ্ছে তা ভুল, এখানে কিছু প্রতিস্থাপন করা হচ্ছে না, এখানে একটি মেশিন ‘স্থাপন’ করা হচ্ছে যা রোগীর হার্টের সাথে সংযুক্ত করে দেয়া হয়) এর খরচ গড়ে দুই লাখ মার্কিন ডলারের (এক কোটি ৮০ লাখ টাকার মতো) কোথাও কম কোথাও আরো বেশি লাগে। 

বাংলাদেশে এই প্রথম এমন একটি কাজ সফলভাবে সম্পন্ন হওয়া দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। অনেক মানুষ এখন দেশেই এই চিকিৎসা নিতে পারবেন। কিন্তু বাংলাদেশের ডাক্তার ও মেডিকেল শিক্ষার্থীদের জানা প্রয়োজন, এটি আসলে কী? তাদের একটা কাল্পনিক মেশিনের ছবি দিয়ে খবর প্রচার করা উচিত হয় নি। এতে করে তারা নিজেরাও যেমন বিষয়টি ভালোভাবে বোঝে নি, সাধারণ মানুষের মধ্যেও একটা ভুল ধারণা ঢুকিয়ে দিয়েছে। আমি সংক্ষেপে এটি লিখলাম যাতে তারা এই ব্যপারটা সম্পর্কে একটি সাধারণ ধারণা পেতে পারে। 

মেডিভয়েসের জনপ্রিয় ভিডিও কন্টেন্টগুলো দেখতে সাবস্ক্রাইব করুন MedivoiceBD ইউটিউব চ্যানেল। আপনার মতামত/লেখা পাঠান [email protected] এ।
স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের ‘নীতিগত সিদ্ধান্ত’

১৭ জানুয়ারি এমবিবিএস ভর্তি পরীক্ষা, বিডিএস ২৮ ফেব্রুয়ারি

  এই বিভাগের সর্বাধিক পঠিত