
ডা. নুসরাত সুলতানা লিমা
সহযোগী অধ্যাপক (ভাইরোলজি),
পিএইচডি গবেষক (মলিকুলার বায়োলজি),
ইনস্টিটিউট ফর ডেভলপিং সায়েন্স এন্ড হেল্থ ইনিশিয়েটিভস।
২৪ ফেব্রুয়ারী, ২০২২ ১০:৪৪ এএম
চিকিৎসক-রোগী সম্পর্ক: সুন্দর ব্যবহারই গড়ে দিতে পারে সম্প্রীতির সৌধ

তখন ঢাকায় কেবল চেম্বারে বসা শুরু করেছি। একজন রোগী আসলেন স্ত্রীরোগ সংক্রান্ত সমস্যা নিয়ে। সাথে এসেছিলেন তার ছোট বোন। আমার ব্যবহার ভদ্রমহিলার এত ভালো লেগেছিল যে, তিনি তাঁর বোনকেও ইশারা করছিলেন আমাকে দেখানোর জন্য।
বোনটির বয়স ২৩ বছর। ৫ বছর ধরে বিবাহিত। থাকেন চাঁদপুরে। স্বামী থাকেন সৌদি আরব। এখানে বড় বোনের বাসায় বেড়াতে এসেছিলেন। বিয়ের পর তার স্বামী দুইবার এসেছিলেন। প্রতিবার দুই মাস করে থেকেছেন। কিন্তু তখনো মেয়েটি গর্ভধারণ করেনি বলে উঠতে বসতে সবার কটুবাক্য শুনতে হচ্ছিল।
এইটুকু জেনে মেয়েটিকে তাঁর স্বামী কবে আসবে জানতে চাইলে বললো তিনি শিঘ্রই আসবেন। জানলাম, মেয়েটির মাসিকের কোনো সমস্যা নেই৷ তাকে স্বামী আসার সঙ্গে সঙ্গে কাল বিলম্ব না করে চাঁদপুরে কোনো গাইনি বিশেষজ্ঞকে দেখাতে বললাম।
কিছুদিন পরে স্বামীসহ সেই মেয়ে চাঁদপুর থেকে শুধুমাত্র আমাকে দেখানোর জন্য ঢাকা এসেছে। আমি প্রয়োজনীয় টেস্ট করতে দিলাম। রিপোর্ট সবই স্বাভাবিক। তারপর খুব ধীরে-সুস্থে দুজনকে কাউন্সেলিং করলাম এবং আমার কথা ঠিকমত বুঝেছে কিনা, সেজন্য ফিডব্যাকও নিলাম। যেহেতু স্বামী দুইমাসের জন্য এসেছেন, তাই গর্ভধারণের জন্য মেয়েটিকে একটি ওষুধও খেতে দিলাম (তখন আমি এফসিপিএস গাইনি পার্ট-ওয়ানের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম)।
সেবারই মেয়েটি কন্সিভ করলো। স্বামী সৌদি আরব যাওয়ার আগে আমার সাথে দেখে করে গেলেন। বললেন, ‘মাঝে মাঝে আমি ফোন দিলে আপনি বিরক্ত হইয়েন না ম্যাডাম।’
অবশেষে মেয়েটির একটি কন্যা সন্তান হলো। এবং এই কন্যা সন্তানকে দেখার দায়িত্বও যেন পড়ল আমার উপর। বাচ্চা একটু অসুস্থ হলেই ঢাকায় আমার চেম্বারে নিয়ে আসতো। বারবার বোঝাতাম, এত কষ্ট করে আসার প্রয়োজন নেই। তাকে বোঝাবে কার সাধ্য!
একবার মেয়েটিকে দেখাতে এসেছেন ঢাকায়। তখন আমি বিসিএস পোস্টিং নিয়ে নোয়াখালীতে। আমার চেম্বারে খবর নিয়ে যখন জানলেন, আমার পোস্টিংয়ের বিষয়ে, তখন ফোন করলে আমি তাকে বললাম ঢাকায় কোনো শিশু বিশেষজ্ঞকে দেখিয়ে নিতে। না, আমাকে ছাড়া কাউকে দেখাবে না।
নোয়াখালীর উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলেন। আমি নোয়াখালীর চেম্বারের ঠিকানা দিলাম। এত কষ্ট, এত পথ পাড়ি দিয়ে, এত ভালোবাসা নিয়ে আমার কাছে আসবেন, আর আমি কিছু করবো না, তা কি হয়? আমিও তাদের (মেয়েটির স্বামী সেবার দেশে এসেছিল) জন্য দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা করলাম। সে বছর মেয়েটি আবার কনসিভ করলো (তখন বড়টির বয়স ২ বছর)। আরো একটি ফুটফুটে কন্যা সন্তান হলো।
এরপর আমি বিভাগ পরিবর্তন করে ঢাকা বিভাগে চলে আসি। পোস্টিং হয় মুন্সীগঞ্জে। ছোট মেয়েটিকে দেখানোর জন্য নোয়াখালীতে গেলে আবার আমাকে না পেয়ে ফোন দিলে যখন শুনেছে আমি ঢাকায় চলে এসেছি, তখন আবার চেম্বারের ঠিকানা নিয়ে বাসে করে চলে আসে সরাসরি আমার চেম্বারে। দুটি শিশু নিয়ে এতটা জার্নি করে এসেছে শুধুমাত্র আমাকে দেখানোর জন্য, ভাবা যায়!
ছোট শিশুটির জন্য এক ফিডার দুধ বানিয়ে নিয়ে গিয়েছিল চাঁদপুর থেকে নোয়াখালী। সেখান থেকে সরাসরি আমার চেম্বারে আসতে আসতেই দুধ নষ্ট হয়ে গেল। শিশুটি ক্ষুধায় চিৎকার করে কাঁদছে। ততদিনে আমারো একটি মেয়ে হয়েছে। আমার স্বামীকে ফোন করে সোহার ফিডারে দুধ বানিয়ে নিয়ে আসতে বললাম।
পাগলামো আচরণের জন্য সেদিন মেয়েটিকে বকেছিলাম। কিন্তু আমার যখনই ক্যারিয়ারে কোনো না পাওয়া নিয়ে কোনো কষ্ট হয়, আক্ষেপ হয়, কিছু রোগীর পাগলামীগুলোই আমাকে জীবনীশক্তি দেয়।
ক্ষুদ্র এ জীবনে মানুষের ঘৃণা, অভিশাপ কুড়িয়েও আমরা বড় হতে চাই। শিখরে চরতে চাই। অনেকেই বোঝেন না, নিখাদ ভালোবাসার পরশ পাথরের ছোঁয়া মহাসমূদ্রের চেয়েও বেশি স্বস্তিদায়ক, বেশি প্রশান্তিময়।