মাস্টার রুলের কর্মচারীর চেয়েও ভাতা কম ইন্টার্ন চিকিৎসকের

সাখাওয়াত হোসাইন: দেশের মানুষের স্বাস্থ্যসেবায় উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন ইন্টার্ন চিকিৎসকরা। হাসপাতালে ভর্তির পর থেকেই প্রতিটি রোগীকে কেন্দ্র তাদের তৎপরতা অনস্বীকার্য। সকল স্বাস্থ্য সংকটেই নিরবচ্ছিন্নভাবে সেবা দিয়ে যান এসব নেপথ্য নায়ক।
এমনকি চলমান বৈশ্বিক মহামারী করোনাতে রোগীর তুলনায় চিকিৎসক কম থাকায়, শিক্ষানবিশ এসব চিকিৎসককে রাখতে হয় ব্যাপক ভূমিকা। এটা সর্বজনবিদিত যে, দেশের সম্মানজনক পেশাগুলোর অন্যতম চিকিৎসা। অথচ মর্যাদার এ পেশায় তাদের সূচনা হয় অনুল্লেখযোগ্য পারিশ্রমিকে, যা প্রতিটি মেডিকেল শিক্ষার্থীকে পেশার প্রতি করে তোলে সীমাহীন নিরুৎসাহী। জানা গেছে, হাসপাতালে মাস্টার রুলে নিয়োগ পাওয়া কর্মচারীদের চেয়ে কম সম্মানি বা বেতন পান তারা।
দেশের কয়েকটি হাসপাতালে কর্মরত চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ইন্টার্ন চিকিৎসকদেরকে বেতন দেওয়া হয় মাত্র ১৫ হাজার টাকা। সম্মানি বৃদ্ধির বিষয়ে দাবির পরিপ্রেক্ষিতে তাদের আশ্বাস দেওয়া হলেও দীর্ঘদিন ধরে বাস্তায়িত না হওয়ায় ক্ষোভ বিরাজ করছে তাদের মনে।
বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তির সময় কেটে রাখা এক লাখ ৮০ হাজার টাকা থেকে প্রতি মাসে ১৫ হাজার করে সম্মানি দেওয়া হয়। ইন্টার্ন ফি নামে নির্ধারিত ওই টাকা জমা না হলে তাদের ১৫ হাজার টাকাও দেওয়া হয় না। যথাক্রমে ছয় হাজার, আট হাজার বা দশ হাজার টাকা সম্মানি দেওয়া হয়, যা শিক্ষার্থীসহ মেডিকেল সংশ্লিষ্টদের কাছে ইন্টার্নি ভাতা হিসেবে বিবেচ্য নয়।
জানা গেছে, একজন রোগীর প্রাথমিক চিকিৎসা দেন ইন্টার্ন চিকিৎসক। রোগীকে সবসময় দেখাশোনাও করেন তারা। রোগীর কাছে থেকে সবচেয়ে বেশি সময় দেন তারা। এছাড়া রোগীর সমস্যাগুলো সিনিয়র চিকিৎসক বা স্যারদের কাছে তারাই প্রথমে তুলে ধরেন। এরপর রোগী তার মতো করে সমস্যার কথা জানান।
ইন্টার্ন চিকিৎসকরা বলছেন, চিকিৎসক হওয়ার পর পরিবারের উপর একটা দায়বদ্ধতা তৈরি হয়। চাইলেও তখন বাড়ি থেকে আর টাকা আনা যায় না। চলতে হয় নিজের খরচেই এবং পরিবার তাদের কাছ টাকা-পয়সা আশা করে। স্বল্প সম্মানি পাওয়ায় কর্মজীবনের শুরুতে পারিবারকে আর্থিক সমর্থন দেওয়া অসম্ভব হয়ে উঠছে এ চিকিৎসকদের।
যশোর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ইন্টার্ন চিকিৎসক পরিষদের (ইচিপ) সভাপতি ডা. সাইফুদ্দিন আহমেদ খান শিহাব মেডিভয়েসকে বলেন, ‘আমার ওয়ার্ডের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী এবং মাস্টার রুলের কর্মচারীর বেতন শুরু হয় ১৬ হাজার ৫০০ টাকা দিয়ে। আর এখানে চিকিৎসক হিসেবে বেতন শুরু হয়েছে ১৫ হাজার টাকা দিয়ে। এ বেতন খুবই অপ্রতুল। এ ছাড়া আমাদেরকে সপ্তাহে ৬০ ঘণ্টা দায়িত্ব পালন করতে হয়। বিশ্বের কোনো জায়গায় পরিচ্ছন্নতাকর্মীও যদি ৬০ ঘণ্টা দায়িত্ব পালন করেন, তাকে ১৫ হাজার টাকার বেশি দেওয়া হয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘করোনার সময় ব্যাংকে প্রণোদনা এবং ৫০ শতাংশ লোক ছুটি কাটাবে আর ৫০ শতাংশ দিয়ে ব্যাংক চালানো হয়। আর এ পদ্ধতি সব জায়গায় চলে। শুধুমাত্র আমাদের বেলায় খুব ঠেকা। করোনার সময়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সেবা দিয়েছেন ইন্টার্নরা, তাদের কোনো ধরনের প্রণোদনা বা ভাতা দেওয়া হয়নি।’
ভাতা বৃদ্ধির বিষয়ে নিজেদের তৎপরতার কথা তুলে ধরে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিক্ষানবিশ চিকিৎসক দিহান খান বলেন, ‘আমাদের জন্য যে বেতন-ভাতা ধরা হয়েছে, তা আমাদের জন্য পরিপূর্ণ নয়। ঢাকা মেডিকেল থেকে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রীর কাছে একবার বলা হয়েছে। আমাদের যে বেতন আছে, তা যথেষ্ট নয়, অপ্রতুল। অনেকবার বিভিন্ন প্রোগ্রামেও বলেছি। আমাদের বেতনটা কাঠামো পরিবর্তন করা হোক। আমাদেরকে দিয়ে সপ্তাহে প্রায় ৮০ ঘণ্টা দায়িত্ব পালন করানো হয়।’
ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ইন্টার্ন চিকিৎসক ডা. অনুপম সাহা বলেন, ‘সরকারি হাসপাতালগুলো অধিকাংশ সময় ইন্টার্ন দিয়ে চালানো হয়। ইন্টার্নদেরকে দিয়ে যে প্রচুর পরিশ্রম করানো হয়, সে তুলনায় ১৫ হাজার টাকা বেতন কিছুই না। এ অবস্থায় আমাদের বেতন বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। বিভিন্ন মেডিকেলের ইন্টার্ন হাসপাতাল পরিচালক বরাবর বেতন বৃদ্ধির জন্য দাবি করতেছে। এজন্য সম্মিলিত প্রয়াস দরকার। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ইন্টার্নদের বেতন বৃদ্ধি করা হোক।’
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ইন্টার্ন চিকিৎসক শাইকা শফিক বলেন, ‘ঢাকার সব শিক্ষার্থীই কমবেশি টিউশনি করান। তারা টিউশনি করে যত টাকা সম্মানি পান, আমরা তারও অনেক কম ভাতা পাই। ইন্টার্নশিপ শুরু করার পর থেকে সপ্তাহের প্রতিদিনই কোনো না কোনোভাবে হাসপাতালে যুক্ত থাকা লাগে। আমাদের সবার পরিবারের অবস্থা ভালো না, অনেকের পরিবার আমাদের টাকার উপর নির্ভর করে। সারাদিন ডিউটি পালন করার পর বাইরের কিছুই করা যায় না। এ সময়ের সাথে আমদের বেতনটা খুব কমই হয়ে যায়। স্যারদের আমরা জানানোর পর তারা আশ্বাস দিয়েছেন, এখনও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা রোগীদেরকে সর্বোচ্চটুকু দিয়ে সেবা করে যাচ্ছি। আর যাদের কাজ শেখার আগ্রহ থাকে, তারা কাজের প্রতি আরও বেশি নিবেদিত। হাসপাতালে একজন রোগীর সার্বক্ষণিক মনিটরিং করেন ইন্টার্ন চিকিৎসক। তারপরও কেন আমাদের ভাতা বাড়ানো হবে না?’
বেসরকারিতে ১৫ হাজার টাকাও দেওয়া হয় না
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কুমিল্লার ময়নামতি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের এক চিকিৎসক বলেন, ‘প্রাইভেট মেডিকেলের যে নিয়মটা আছে, ইন্টার্ন করার জন্য ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা ফি দিলে, তাকে ১৫ হাজার টাকা বেতন দেওয়া হয়। আর যারা এমবিবিএসে ভর্তি বা ইন্টার্ন শুরু করার সময় যারা ফি দেয়নি, তাদের বেতন দেওয়া ছয় হাজার, আট হাজার, ১০ হাজার টাকা দেওয়া হয়। ইন্টার্ন শুরু করার পর বাড়ি থেকে লজ্জায় টাকাও আনতে পারি না। যে টাকা বেতন দেওয়া পাই, তা দিয়ে চলাফেরা করতে খুবই কষ্ট হয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘ইন্টার্নশিপের সময় এ টাকা দিয়ে চলাফেরা করা যায় না। মাসে মেস ভাড়া দিতে হয় তিন হাজার টাকা, খাবারের খরচ আছে তিন হাজার টাকা। ইন্টার্নদের যেসব সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার কথা আমরা তা পাই না।’
কর্তৃপক্ষের ভাবনা
বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) মহাসচিব এবং বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যা বিষয়ক উপ-কমিটির সদস্য ডা. ইহতেশামুল হক চৌধুরী দুলাল মেডিভয়েসকে বলেন, ‘আমরা তাদের বক্তব্যের সাথে সম্পূর্ণ একমত। বর্তমান প্রেক্ষাপট ও বাজার দর অনুযায়ী বেতন পান ইন্টার্ন চিকিৎসকরা, তাদের বেতন বৃদ্ধি পাওয়া সময়ের দাবি। এ ব্যাপারে আমরা স্বাস্থ্যমন্ত্রী মহোদয়ের সাথে কথা বলেছি, আমাদের একটা দাবি মধ্যে অন্যতম ইন্টার্নদের বেতন বাড়ানো। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নজরে বিষয়টি আনার জন্য চেষ্টা করেছি, দুর্ভাগ্যবশত দুই বছর করোনা থাকায় বিষয়গুলো পাদ-প্রদীপের আলোয় আসছে না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের সাথে আলাপ-আলোচনা করতে পারছি না। আমরা আশাবাদী, অতি শিগগিরই করোনা এ উর্ধ্ধগতি চলে যাবে। এরপর আমরা স্বাস্থ্যমন্ত্রীর সাথে কথা বলবো।’
বেসরকারি চিকিৎসকদের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি আরও বলেন, ‘বেসরকারিদের বিষয়ে আমরা আলাপ-আলোচনা করবো। আসলে করোনার কারণে সবকিছুতেই সমস্যা হয়ে গেছে। এই মহামারি চলে গেলে বা সহনীয় পর্যায়ে আসলে এ দুটি বিষয়ে আলোচনা করে একটা পর্যায়ে যাবো।’
ওয়ার্ড বয়ের চেয়েও কম বেতন পান ইন্টার্ন চিকিৎসকরা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি আরও বলেন, বিষয়টি খুবই বিব্রতকর। দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মকর্তা বা কর্মচারী কি বেতন পান। একজন ওয়ার্ড বয়, সেবিকা বা সিস্টার কত টাকা বেতন পান, এসব বিবেচনায় এনে বেতনগুলো নির্ধারণ করার চেষ্টা করবো।
জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিকসমূহ) ডা. ফরিদ হোসেন মিয়া মেডিভয়েসকে বলেন, ‘ইন্টার্ন চিকিৎসকরা চাকরি করে তারা ট্রেনিং করেন। সাথে একটা সম্মানিও পান। এটার সাথে কারও বেতনের তুলনা করা ঠিক হবে না। হতে পারে ইন্টার্নদের ভাতা কম। আমরা যে সময় ইন্টার্ন করেছি, সে সময় আমরা অনেক কম সম্মানি পেতাম। বর্তমান প্রেক্ষাপটে অনেক গুণ বেড়েছে।’
তবে এর আগে গত বছরের ৮ আগস্টে ইন্টার্ন চিকিৎসকদের সম্মানি বাড়ানোর বিষয়ে জানতে চাইলে ডা. ফরিদ হোসেন মেডিভয়েসকে বলেন, ‘ইন্টার্ন চিকিৎসকদের সম্মানি বাড়ানোর জন্য আমরা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠিয়েছি। আর আর্থিক লেনদেনের বিষয়টা সম্পূর্ণ মন্ত্রণালয়ের এখতিয়ারাধীন, মন্ত্রণালয় অনুমোদন দিলে ইন্টার্ন চিকিৎসকদের সম্মানি বাড়ানো যাবে।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (আর্থিক ব্যবস্থাপনা ও অডিট অনুবিভাগ) মোহাম্মদ শাহাদত হোসেন মেডিভয়েসকে বলেন, এ বিষয়টি বাজেট শাখা দেখাশোনা করে। এটি তাঁর আওতাধীন নয়। বাজেট শাখার সাথে কথা বললে সঠিক তথ্য জানা যাবে।
এ বিষয়ে স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের যুগ্মসচিব (বাজেট-১ ও ২ অধিশাখা) ড. মো. এনামুল হক মেডিভয়েসকে বলেন, ‘গত দুই বছর আগে ইন্টার্ন চিকিৎসকদের বেতন বাড়ানো হয়েছে। এখন তারা পনেরো হাজার টাকা করে ভাতা পান। এর মধ্যে তাদের ভাতা বাড়বে বলে কারও কাছ থেকে কিছু শুনিনি, তাহলে বলতে পারতাম। তবে ইন্টার্ন চিকিৎসকদের ভাতা বাড়ানো সিদ্ধান্ত হলে আমরা বরাদ্দ দিয়ে দিব।’
এর আগে ২০১৬ সালে সরকারি হাসপাতালে কর্মরত ইন্টার্ন চিকিৎসকদের মাসিক ভাতা ৫ হাজার টাকা বাড়িয়ে ১৫ হাজার টাকা করা হয়।
ওই বছরের ৪ আগস্ট বিকেলে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অফিসার পরীক্ষিৎ চৌধুরী স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তির বর্ণনা অনুযায়ী, চলমান মাস থেকেই এই ভাতা কার্যকর হয়। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, সরকারি হাসপাতালে কর্মরত ইন্টার্ন চিকিৎসকদের মাসিক ভাতা বিদ্যমান ১০ হাজার টাকা থেকে ১৫ হাজার টাকা পুনর্নির্ধারণ করা হয়েছে।
এর আগে ২০০৯ সালে ৬ হাজার ৫০০ টাকা ইন্টার্নশিপের ভাতা বাড়িয়ে ১০ হাজার টাকা করে সরকার।
এসএইচ/এমইউ
-
২৭ সেপ্টেম্বর, ২০২২
-
১৩ ফেব্রুয়ারী, ২০২২