অবস্টেট্রিসিয়ানদের নাইটমেয়ার!
মাতৃত্বের পথে রক্তক্ষরণ

পাঠ্যপুস্তক পড়ার মত বিস্বাদ এবং বিষাদময় আর কিছুই নেই। তবে ফেসবুক পড়া খুব মজার। তাই সকাল সাড়ে সাতটায় এমবিবিএস ক্লাসে কাক পক্ষীটিও থাকেনা, কখনও দু'একটা সোনাপাখি থাকে। কারণ ওরা সারা রাত ফেসবুক পড়ে। আর সারাদিন না ঘুমালে সারারাত জাগবে কি করে? কি আর করা। এস বাবারা, মা-রা তোমরা ফেসবুকই পড়।
আমাদের গাইনী অবস এর জীবন্ত কিংবদন্তী প্রফেসর টি এ চৌধুরী স্যারকে চেনে না চিকিৎসক সমাজে এমন কেউ নেই। তবে শিক্ষক হিসেবে তিনি কেমন তা শুধু একটি বাক্যে বলব, "স্যারের ক্লাস যদি কোন গাইনোকলজিস্ট না করে থাকেন; তাহলে তার জীবন ষোল আনাই মিছে"।
স্যারের যাদুকরী ক্লাশের মোহনীয় শব্দটি হচ্ছে WHY, এই WHY যার মাথায় না থাকবে সে চিকিৎসাবিজ্ঞানের কিছুই শিখবে না।
এস দেখি মা হতে গিয়ে কেন মেয়েরা মারা যায়?
অনেক কারণের মধ্যে আজ গুরুত্বপূর্ণ একটি কারণ নিয়ে বলি, যা চিকিৎসককে একেবারেই সময় দিতে চায় না। তা হলো মাতৃত্বের পথে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ। এ থেকে ইররিভারসিবল শক, কার্ডিয়াক এরেস্ট এবং মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।
কেন রক্তক্ষরণ হয়?
গর্ভকালীন প্রথম ৬ থেকে ৮ সপ্তাহ।
একটোপিক প্রেগন্যান্সিঃ
জরায়ুর বাইরে ভ্রুণ ইমপ্লানটেশন হওয়া। মোস্ট কমন জায়গা হলো ফেলোপিয়ান টিউব। এর কমনেস্ট জায়গা হলো এম্পুলা। টিউব জরায়ুর মত বাড়তে পারেনা বলে একসময় ফেটে যায়। সাধারণত ৬ সপ্তাহের মধ্যেই।
ইস্থমাস হলো টিউবের সবচেয়ে চিকন অংশ। সেখানে হলে আরও আগেই ফেটে যায়। অনেক সময়ে টিউব থেকে এবরশন হয়ে পেটের ভিতরে পরে যায়।
ফেলোপিয়ান টিউব ফেটে গেলে অনবরত পেটের ভিতরে রক্তপাত হতে থাকে। এবরশন পুরোপুরি হলে রক্তপাত বন্ধ হয়ে যায় কিন্তু আংশিক এবরশন হলে রক্তপাত হতেই থাকে।
উপসর্গ ও লক্ষণ:
তলপেটে অসম্ভব ব্যথা, ঘনঘন ফেইন্টিং এটাক, অজ্ঞান হয়ে যাবার মত অবস্থা, হঠাৎ পেটের মধ্যে রক্তপাতের ফলে ব্যথা। যার নিয়মিত মাসিক হয় তার মাসিক বন্ধ হওয়া এবং প্রেগনেন্সির লক্ষণগুলির সাথে এত ব্যথা একটোপিক প্রেগনেন্সির ধারণা দেয়।
এ রকম উপসর্গ ও লক্ষণ থাকলে মেয়ে বিবাহিত কিংবা অবিবাহিত, স্বামী দেশে আছে কিংবা বিদেশে থাকে কিছু বিবেচনা না করে রক্তের বিটা এইচ.সি.জি এবং আল্ট্রাসনোগ্রাম করে শনাক্ত করতে হবে।
বিটা এইচ সি জি পজিটিভ কিন্তু আল্ট্রাসনোগ্রামে জরায়ু খালি এবং পেটের ভিতরে ফ্রী ফ্লুইড (ব্লাড) থাকা একটোপিক প্রেগনেন্সির ডায়াগনস্টিক ফিচার।
২৮ সপ্তাহ পর্যন্ত:
১. এবরশন : ইনকমপ্লিট ও থ্রেটেন্ড এবরশন।
২. মোলার প্রেগন্যান্সি বা হাইডাটিডিফর্ম মোল। প্লাসেন্টাল টিউমার। আংগুরের থোকার মত সিস্টের সাথে প্রচুর ব্লিডিং।
২৮ সপ্তাহের পরে:
১. এপিএইচ: গর্ভাবস্থায় প্লাসেন্টা বা ফুল জরায়ুগাত্র থেকে সরে গিয়ে রক্তক্ষরণ। (এ্যবরাপসিও প্লাসেন্টা, প্লাসেন্টা প্রিভিয়া)।
প্রসবের সময়:
১. প্লাসেন্টা জরায়ুগাত্র থেকে সরে গেলে।
২. জরায়ু ফেটে গেলে (Ruptured Uterus)।
বাচ্চা প্রসবের পরে:
১. পিপিএইচ
ক) জরায়ু সংকুচিত না হলে।
খ) প্লাসেন্টা পুরোটা বের না হলে (রিটেইন্ড প্লাসেন্টা)
গ) জরায়ুগ্রীবা কিংবা জন্মপথের কোথাও ইনজুরি হলে।
ঘ) রক্ত জমাটবাঁধায় কোন ত্রুটি থাকলে।
রক্তক্ষরণ যে কারণেই হোক তার কমন ম্যানেজমেন্ট হল...
১. পালস, ব্লাড প্রেসার দেখ, ইতিহাস জান এবং সাথে সাথে সিনিয়রকে জানাও।
২. টিমের লোকদের সাহায্য চাও।
৩. সবুজ ক্যানুলা (১৮) দিয়ে আই ভি চ্যানেল ওপেন করো (প্রয়োজনে দু’হাতে)।
৪. ব্লাড গ্রুপিং, ক্রসম্যাচিং এ পাঠাও এবং পার্টিকে ব্লাডের জন্য তাড়া দাও।
৫. ব্লাড না আসা পর্যন্ত হার্টম্যান, নরমাল স্যালাইন, ডিএনএস, হেমাক্সিল পেলে চালাও। ব্লাড আসার সাথে সাথে ব্লাড দাও। মনে রাখবে ব্লাড ফর ব্লাড। প্রয়োজনে হাইড্রোকরটিসোন দাও।
৬. ক্যাথেটার দাও ইউরিন আউটপুট দেখার জন্য (একিউট রেনাল সাট ডাউনের সম্ভাবনা থাকে)।
৭. পিপিএইচ হলে অক্সিটোসিন, আরগোমেট্রিন, সাইটোমিস দাও।
৮. ইনকমপ্লিট এবরশন হলে অক্সিটোসিন, আরগোমেট্রিন দাও
৯. আই ভি এন্টিবায়োটিক দাও।
১০. এনেস্থেটিস্টকে জানাও।
১১. ওটি স্টাফদের জানাও।
১২. কনস্ট্যান্ট মনিটরিং করো।
১৩. পার্টিকে কাউন্সেলিং করে অপারেশনের সম্মতি নিয়ে রাখো।
এর মাঝেই রেস্পেক্টিভ সিনিয়র ডাক্তার এসে স্পেসিফিক ব্যবস্থা নিবেন। তোমরা ঝাঁপিয়ে পড়ো তোমার জ্ঞান, নিষ্ঠা, একাগ্রতা, ধৈর্য্য ও সহানুভূতি নিয়ে। ইনশাআল্লাহ মা ফিরে আসবে।
যার হাতে আমার ট্রেনিং, যিনি আরেকজন কিংবদন্তী শিক্ষক; সেই শ্রদ্ধেয় বায়েছ ভুঁইয়া স্যারের কথাঃ
“তুমি এনাটমি জান, ফিজিওলজি জান, প্যাথলজি জান, তুমি জান পরানটা কোন কোন রাস্তা দিয়ে বাইর হইয়া যায়। আটকাইয়া দাও সেইসব রাস্তা, ইনশাআল্লাহ পরান বাইর হইবো না!”
( এপ্রিল-মে ২০১৬ সংখ্যায় প্রকাশিত )
