
ডা. তারিক আলম অনি
রেজিস্ট্রার
ডিপার্টমেন্ট- এক্সিডেন্ট এন্ড ইমার্জেন্সী,
গ্ল্যাডস্টোন হাসপাতাল।
সেন্ট্রাল কুইন্সল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া।
৩০ অক্টোবর, ২০২১ ১০:২৭ এএম
অফথালমোলজি, কটন উল হেমোরেজ, কলিজা সিঙ্গারা এবং একটি ঘটকালি

এই গল্পের কোন চরিত্রই কাল্পনিক নয়। কোনো কাহিনী বা ঘটনার সঙ্গে আংশিক বা সম্পূর্ণ মিল মোটেও কাকতালীয় নয়। আসুন গল্পে প্রবেশ করি।
সময়টা ২০১০, ইন্টার্ন করছি। প্লেসমেন্ট পরেছে অফথালমোলজি (চক্ষু) বিভাগে। আউটডোরে আবাসিক সার্জনের রুমে ক্লাস হতো। এক বড় ভাই খুব যত্ন নিয়ে আমাদের রোগী দেখাতেন এবং পড়াতেন। পূর্বপরিচিতির সুবাদে সেই বড় ভাইয়ের সাথে এখনও আমার ভালো খাতির। ভাইয়া এখন দেশের একজন জনপ্রিয় চক্ষু বিশেষজ্ঞ।
এমনই একদিন সুন্দর ঝলমলে সকালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অফথালমোলজি (চক্ষু) আউটডোরে রোগী দেখা এবং ক্লাস চলছে। ভাইয়া প্রথমে নিজে রোগী দেখেন, তারপর নিজে রোগীর চোখ স্লিটল্যাম্প যন্ত্রে পরীক্ষা করে রেটিনার (চোখের পিছনের একটি স্তর) ফাইন্ডিং বের করে শেখানোর জন্য আমাদের দেখতে বলেন। বইয়ের সাথে মিলিয়ে হাতে কলমে শিক্ষা।
আমরা রোগী দেখি, স্লিট ল্যাম্পে রোগীর চোখের ভিতরের নানা রোগের নিদর্শন দেখি। আমি প্রায় সময়ই কিছু বুঝিনা। না বুঝেই ডান-বাম মাথা নাড়ি। তার উপর সকালবেলা নাস্তা করে যাইনা, মাথায় ঘুরতে থাকে ক্যান্টিনের কলিজা সিংগারার কথা। ভাইয়া স্লিট ল্যাম্পে রোগীর চোখ দেখিয়ে বলেন, “দেখেছো রেটিনাতে কেমন তুলার মত রক্তক্ষরণ… এর নাম ‘কটন উল হেমোরেজ’, এই রোগীর নার্ভ ড্যামেজ হয়েছে বুঝলা …?”
আমি স্লিট ল্যাম্প যন্ত্রের আইপিসে চোখ রেখে তুলার মত কিছুই দেখিনা, দেখি হলুদ রং এর সুস্বাদু সিংগারার ভিতরে কলিজা আর মশলা দেওয়া আলু, নার্ভ ড্যামেজ খুঁজে পাইনা। কি একটা অবস্থা!
দু’ঘন্টা ক্লাস-রোগী দেখার পর ভাইয়া আধা ঘন্টার ব্রেক দিলেন। মেয়েরা ক্যান্টিনের দিকে গেল, আমরা কয়েকজন ছেলে রয়ে গেলাম। মেয়ারা চলে যাওয়া মাত্রই ভাইয়া মূল আলাপ পাড়লেন। আমাকে জানালেন তাঁর এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু সম্প্রতি মেডিসিনে এফসিপিএস পাশ করেছেন, বিয়ের জন্য ডাক্তার পাত্রী খুঁজছেন। আমাদের ব্যাচের একজন ইন্টার্ন মেয়েকে ভাইয়ার বেশ পছন্দ হয়েছে, প্রাথমিকভাবে নির্বাচনও করে ফেলেছেন বন্ধুর জন্য। আমার কাছে তিনি পাত্রী সম্পর্কে আরও জানতে চান।
- তারিক, তোমাদের ব্যাচের এই রোল নম্বরের মেয়েটা কেমন?
- খুবই ভালো মেয়ে বস।
- হুম, দেখতে শুনতে তো বেশ ভালো, শান্ত শিষ্ট টাইপ।
- জ্বী বস, খুবই শান্ত শিষ্ট মেয়ে। কোন ভেজালে নাই । কারও সাতে পাচে নাই...
- বেশ বেশ… তা মেয়ের বাড়ি কই ? বাবা কি করে? নিজের বাড়ি? ভাই বোন কয়জন? ভাই কি করে? পরিবার কেমন? বংশে পাগল টাগল নাই তো? নামাজি পরিবার? রাজনৈতিক ব্যাপার স্যাপার নাই তো? ব্যবসায়িক পরিবার? উকিল পরিবার? মেয়ে কোন সাবজেক্টে ক্যারিয়ার করতে চায়? ইত্যাদি ইত্যাদি...
আমি হাসিমুখে খুবই আগ্রহের সাথে ধৈর্য নিয়ে এক এক করে সবগুলো প্রশ্নের উত্তর দিয়ে গেলাম। সব তথ্য জানার পর ভাইয়া প্রাথমিকভাবে নির্বাচিত পাত্রীটিকে পদোন্নতি দিয়ে বন্ধুর জন্য মাধ্যমিকভাবে নির্বাচিত করলেন। পাত্রী এককথায় ‘পারফেক্ট’। বন্ধুর সাথে কথা বলে পছন্দ হলেই সেটা উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে যাবে, এরপর পারিবারিকভাবে মুরুব্বিদের মাধ্যমে সেটা বিশ্ববিদ্যালয়ের চুড়ান্ত ডিগ্রি ‘বিবাহ’ সনদ গ্রহণ করবেন। প্ল্যান বেশ ভালো। এত দ্রুত বন্ধুর জন্য পাত্রী পাওয়া যাবে এটা ভাইয়া ভাবেননি, তিনি যারপরনাই খুশি। আমিও ভাইয়াকে সঠিক তথ্য দিয়ে সাহায্য করতে পেরে খুশি।
ভাইয়া নিজের পয়সায় গরম গরম স্পেশাল কলিজা সিঙ্গারা আনিয়ে ফেললেন। আমার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো, আমি তো সিংগারার জন্যই সেই সকাল থেকে অপেক্ষা করে আছি। তিনি ফুরফুরে মেজাজে সিংগারায় কামড় দিলেন। আমি ও হাসিমুখে সিংগারা খাচ্ছি। তথ্য প্রদানকারী হিসেবে আমার এখন আলাদা খাতির। চাইলে সবগুলো সিংগারা খেয়ে ফেলতে পারি। আরও পাঁচটা সিংগারা পার্সেল চাইলেও ভাইয়া না করার কথা না।
আজকের সিংগারাগুলো বেশ ভালো। আমি সিংগারা খাচ্ছি আর ভাবছি সিঙ্গারার ভিতরের কলিজাটা আগে খাবো নাকি আলুটা আগে খাবো। তবেএখনও আলু আর কলিজা একসাথে মিলে সেই স্লিট ল্যাম্পের ‘কটন উল হেমোরেজ’ এর মতোই লাগছে। নাহ, এই কঠিন ‘অফথালমোলজি’ বিষয়টি আমাকে দিয়ে বোধহয় আর হলো না। রোগীর চোখের ভিতর তাকিয়ে কলিজা সিঙ্গারা আলু-কলিজা দেখলে চিকিৎসা দিব কি? অ্যান্টিবায়োটিক? রোগী তো অন্ধ হয়ে যাবে!
রোগী অন্ধ হোক আর যাই হোক, ‘কটন উল হেমোরেজ’ কলিজা সিঙ্গারাগুলো খেতে বেশ ভালো, এ জাতীয় উচ্চমার্গীয় চিন্তা করতে করতে চোখ বন্ধ করে সিঙ্গারা চাবাচ্ছি এমন সময় ভাবনায় ছেদ পড়লো। হঠাৎ ভাইয়া বললেন,
- এই তারিক, আসল কথাই তো জিজ্ঞেস করা হয়নাই।
- কি আসল কথা বস?
- তোর এই ব্যাচমেটের অ্যাফেয়ার-ট্যাফেয়ার নাই তো? মানে প্রেম-টেম?
- জ্বী বস। আছো তো...!
ভাইয়ার সিঙ্গারা খাওয়া নিমেষেই থেমে গেল। তিনি মনে হল সিংগারার বাটিটাও একটু নিজের দিকে টান দিয়ে সরিয়ে নিলেন।
- বলিস কি! তুই আগে বলবিনা মেয়ের অ্যাফেয়ার আছে!
- বস, ওইটা তো জিজ্ঞেস করেন নাই।
- তাও ঠিক! তা, কার সাথে অ্যাফেয়ার এই মেয়ের?
- ইয়ে, মানে বস; আমার সাথেই অ্যাফেয়ার!
ভাইয়া শূন্য দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন। ‘অধিক শোকে পাথর’ টাইপ চাহনি। সেটা বন্ধুর পাত্রী হারানোর শোক, নাকি আমি ইতিমধ্যে দুটো বিশাল ‘কলিজা সিঙ্গারা’ সাবাড় করে ফেলার শোকে সেটা ঠিক বোঝা গেল না। একটু আগে নার্ভ ড্যামেজ হওয়া রোগীটারও একইরকম চাহনি ছিল।
আমি কালবিলম্ব না করে তৃতীয় সিংগারার দিকে হাত বাড়ালাম। আমার চোখ উজ্জ্বল, মুখে হাসি। দুটো বিশাল সাইজের সিংগারা খেয়ে আমার মস্তিষ্কে এখন যথেষ্ট পরিমাণ সুগার চলে এসেছে, মস্তিষ্ক দৌঁড়িয়ে কাজ করছে। এখন ‘অফথালমোলজি’ বিষয়ে আমার ধারণা পরিস্কার হয়ে গেছে। আমি আমার প্রশ্নের উত্তরও পেয়ে গেছি। আমি আবিষ্কার করে ফেলেছি সিঙ্গারা খাওয়ার সময় আলাদা করে আলুও আগে খেতে নেই, কলিজাও আগে খেতে নেই, দুটো একসাথে বিশাল কামড়ে মুখে পুরলেই সবচেয়ে বেশি মজা!