ডা. হামীম ইবনে কাওছার
এমডি, পিএইচডি, এফএসিপি
হেমাটোলজি এন্ড অনকোলজি
ইউনিভার্সিটি অব ক্যানসাস যুক্তরাষ্ট্র।
২৪ মার্চ, ২০২১ ০৫:২৮ পিএম
কেন এবং কীভাবে নিজেকে জানবেন?
আমাদের বেশির ভাগ ছেলেমেয়েরা ডাক্তারি পড়ে পরিবারের ইচ্ছায়, বাবা-মায়ের স্বপ্ন পূরণের জন্য। আমিও ব্যতিক্রম নই। কিন্তু প্রথম বর্ষে গাইটনের ফিজিওলজি পড়তে যেয়ে আমার ব্যক্তিগত আগ্রহ তৈরি হয় চিকিৎসা বিজ্ঞানে। গাইটনের প্রেমে পড়ে যাই। এই বইতে লেখা ছিল আমি কেন ঘুমাই, আমি কেন স্বপ্ন দেখি, আমার কেন ক্ষুধা লাগে, ব্যায়ামের পরে কেন গায়ে ব্যাথা হয়, হার্ট এটাকে কেন এনজিনা হয়।
আমি মোহাচ্ছন্ন হয়ে যাই। আমার না জানা সব কথা কী সুন্দর করে এই বইয়ে লেখা। গাইটন থেকে রবিন্স-কুমার-ক্লার্ক। পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা শরীরের স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হলে কেন হয়, কিভাবে হয়- তার বিস্তারিত ধারাভাষ্য। আমি বুঁদ হয়ে যাই আগ্রহে, মুখরিত থাকি অন্তরে, কৌতূহলের মায়াবী নেশায়। প্রথমে শরীর, দেহ, মস্তিস্ক। এরপর অঙ্গ-প্রতঙ্গ। তার পর কোষ। আগ্রহের সুদের চক্রবৃদ্ধি হয়, নেশা ধরে সেন্ট্রাল ডগমায়- ডিএনএ-আরএনএ-প্রোটিনে।
সবার মতো আমাকেও প্রায়ই মানুষ জিজ্ঞেস করেছে যে কেন আমি চিকিৎসা বিজ্ঞান পড়েছি? এই আমেরিকার সব ইন্টটারভিউতেই বলেছি যে আমি চিকিৎসা বিজ্ঞান এবং মলিওকুলার বায়োলজি পড়েছি নিজের আগ্রহে, নিজেকে জানার নেশায়। অন্যকে চিকিৎসা করার মুখ্য উদ্দেশ্যে নয়। এ বিদ্যা দিয়েই আমি জেনেছি আমি কে, আমার তৃষ্ণা কেন লাগে, কেন স্বপ্ন দেখি, কেন আমার ব্যাথা লাগে, কেন আমি মেয়েদের প্রতি আকৃষ্ট হই, কেন আমার জ্বর হয়, কেন আমার মন খারাপ থাকে, কেন আমি ফেসবুকে আসক্ত হই।
এই বিদ্যাতে আমি জেনেছি কিভাবে একটি স্বাভাবিক কোষ থেকে ক্যান্সার হয়, কিভাবে জীন মিউটেশন হয়, কেন তা মেরামত হয় না। আমি চোখ বুজলে পরিষ্কার দেখি আমার শরীরে, কোষে, নিউক্লিয়াসে, ক্রোমোজোমে, জীনে বা ডিএনএ-তে কখন কি হচ্ছে। যেখানেই আমি একথা বলেছি, প্রশ্নকর্তা কিছুটা বিস্মিত হয়েছেন। তাদের বিস্ময় থেকে আমার ব্যাপারে তাদের আগ্রহ তৈরি হয়েছে।
গ্রীক তিনটি প্রাচীনতম প্রবাদের একটি হলো ‘নো দাইসেল্ফ’। নিজেকে জানো। সক্রেটিস একথা বলতেন, প্লেটোও একথা সক্রেটিসকে বলতে শুনেছেন। এই নো দাইসেল্ফ মানে কি? নিজের সম্পর্কে কি জানা? নিজেকে জানা, না কি নিজে কি জানি না তাই জানা? নিজেকে জানা, না কি স্রষ্টাকে জানা? আমরা আর স্রষ্টা কি একই? আমরা কি সৃষ্টি, না কি স্রষ্টা, না কি দুটোই। খ্যাতনামা সুফী ইরানী দার্শনিক মনসুর আল-হাল্লাজ স্রষ্টার ধ্যান করতেন, স্রষ্টার সান্নিধ্য সন্ধান করতেন। অবশেষে তিনি উপলব্ধি করেন যে তার সবকিছুই স্রষ্টার সৃষ্টি, তিনি নিজে বলতে কিছু নেই। তিনি ধ্যানের মধ্যে বলে ফেলেন ‘আনাল হক্ব’ অর্থাৎ আমিই পরম সত্য, প্রকান্তরে আমিই স্রষ্টা! তার এই নিজেকে চেনা তার মৃত্যুদণ্ডের কারণ হয়। তাকে হত্যা করা হয় নিজেকে স্রষ্টা বলার জন্য।
আসলে নিজেকে জানা কী? নো দাইসেল্ফ বিষয়টা কী? নিজের সম্পর্কে কি জানাকে নো দাইসেল্ফ বলে? আমার ওজন কত? আমার উচ্চতা কত? আমার চুলের রং, চোখের রং- এসব? না কি আমার মন কি? মেধা কি? আমার শরীর-কোষ-জীন কী? আমার স্রষ্টা কী? আমি কী চাই? আমার ভালোলাগা, দুঃখ, কষ্ট, নিঃসঙ্গতা? প্রেম- ঘৃণা-একাত্বতা-শূন্যতা? আমার ইচ্ছে, অনিচ্ছে, স্বপ্ন? কোনটা? সবগুলো?
আচ্ছা, আপনি কি জানেন আপনি যা করেন তা কি নিজের ইচ্ছেয় করেন? অন্যের ইচ্ছেয় করেন? পারিপাশ্বিকতার চাপে পড়ে করেন? সামাজিক প্রয়োজনে করেন? যদি আপনি সম্পূর্ণ স্বাধীন থাকতেন, আপনি কী তাহলে এখন যা করছেন তাই করতেন? অন্যকিছুর করতেন?
আপনি কি জানেন, আপনি কে? আপনার স্রষ্টা কে? আপনার কেন অজানা কারণে মন খারাপ হয়? কেন সমুদ্রে গেলে আনন্দ হয়, বসন্তের বাতাসে মন ভালো হয়? আপনি কি আসলেই নিজের সম্পর্কে কিছু জানেন? আপনি কি জানেন আপনার রেস্টিং হার্টবিট কত? আপনি দিনে কয়বার প্রশ্রাব করেন? আপনার শরীরে লাইপেজ এনজাইম আছে- এরপরও আপনি কেন নিরামিষাশী? আপনার শুক্রাণুর সংখ্যা কত? আপনি পানিতে নামলেই কেন প্রস্রাবের বেগ আসে? কেন আপনার স্তনদ্বয় অসম?
আপনি কি জানেন আপনার জেনেটিক ল্যান্ডস্কেপ কি? আপনার জিনোমিক মিথাইলেশন ম্যাপ? আপনার কয়টি জীন আছে, আপনার ক্রোমোজোমের দৈর্ঘ? আপনার জীন এক্সপ্রেশন প্রোফাইল? আপনার সিঙ্গল নিউক্লিওটাইড পলিমরফিজম? আপনার জীন কপি নাম্বার ভ্যারিয়েশন? আপনার শরীরের মাইক্রোবায়োম? ওরাল ফ্লোরা? ভ্যাজাইনাল ফ্লোরা? কেন আপনার মলদ্বার মুখের চেয়েও পরিষ্কার?
আমরা প্রায়শই বলি যে সারা জীবন সংসার করেও আমরা আমাদের সঙ্গীকে চিনতে পারি না। কথাটা কি সত্য? আমরা আমাদের সঙ্গীকে যতটা চিনি ততটা কী নিজেকে চিনি? আপনি আপনার সংসার, পাড়া, শহর, দেশ, বিশ্বকে যতটা চেনেন, নিজেকে কি ততটা চেনেন? আপনি বিশ্বের মানচিত্র জানেন, আপনি কি আপনার শরীরের, মনের, ভাবনার, কল্পনার, অনুভবের মানচিত্র চেনেন?
আপনি মঙ্গল গ্রহের মাটি দেখেছেন, আপনি কি আপনার ক্রোমোজোমের হিস্টোন দেখেছেন? ক্রোমাটিন? নিউরোট্রান্সমিটার? হরমোন? এনজাইম? আসলে কি নিজেকে জানা সম্ভব? নিজেকে জানার মত বুদ্ধি-জ্ঞান কি আমাদের আছে? এরিস্টটল, সক্রেটিস, প্লেটোরা কি আসলে নিজেকে চিনতেন?
আপনি কি আপনাকে চেনেন, জানেন? ড্যু ইউ নো দাইসেল্ফ? আচ্ছা, কেউ-ই কি তাকে নিজেকে চেনে? নিজেকে জানে?
আল্লাহুম্মা ইন্নী আস-আলুকা ঈলমান নাফিয়া, ওয়া রিজক্বান তায়্যেবান ওয়া আমালান মুতাকাব্বালান।