দেড় যুগেও পদোন্নতি পাননি বিএসএমএমইউর ২৫০ চিকিৎসক
মুন্নাফ রশিদ: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) আড়াইশ’ চিকিৎসক দেড় যুগের বেশি সময় ধরে পদোন্নতি বঞ্চিত হয়ে আছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। দেশের প্রথম ও সবচেয়ে বড় চিকিৎসা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এসব চিকিৎসক সেবা কার্যক্রম চালিয়ে গেলেও মানুষিকভাবে বিপর্যস্ত তারা। অধ্যাপক হওয়ার স্বপ্ন দেখা এসব চিকিৎসকের অনেকেরই অবসরে যাওয়ার সময় হয়ে এসেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চিকিৎসা পেশায় স্ব স্ব ক্ষেত্রে সহকারী, সহযোগী বা অধ্যাপক হিসেবে পদোন্নতি পাওয়ার জন্য যতগুলো শর্ত রয়েছে সবই পুরণ করছেন তারা। চিকিৎসা শাস্ত্রের ওপর উচ্চতর ডিগ্রিও নিয়েছেন সবাই। এর পরও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের একটি আইন রহিত ঘটনায় আটকে আছে সবার পদোন্নতি।
এমন পরিস্থিতিতে আগামীকাল রোববার (২৮ ফেব্রুয়ারি) অনুষ্ঠেয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮১তম সিন্ডিকেট সভায় তাদের পদোন্নতির শতভাগ আশ্বাস দিতে পারছেন না কর্তৃপক্ষ। তারপরও আশায় বুক বেঁধেছেন বঞ্চিত চিকিৎসকরা।
তারা বলছেন, দেশের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস কোর্স শেষে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে বিএসএমএমইউর চিকিৎসক হয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত চিকিৎসক হিসেবে দেড় যুগের বেশি সময় ধরে রোগীদের নিরলসভাবে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন।
তাঁরা বলছেন, হাতে-কলমে সেবা দেওয়ার পাশাপাশি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্নে একাধিক বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রিও সম্পন্ন করেছেন। দেশি-বিদেশি মেডিকেল জার্নালে চিকিৎসা গবেষণা বিষয়ক তাদের একাধিক আর্টিকেল প্রকাশিত হয়েছে। তবে এতকিছুর পরও মেডিসিন, নিউরোমেডিসিন, নিউরোলজি, নিউরোসার্জারি, গাইনি, কার্ডিওলজি, অর্থোপেডিকস ও রিউম্যোটোলজিসহ প্রায় ৫৪টি বিভাগের আড়াইশ’ জন চিকিৎসক পদোন্নতি পাননি।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দেশের প্রথম ও সর্বোচ্চ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের এই চিকিৎসকরা এফসিপিএস, এমডি ও এমএস বিষয়ের ওপর পোস্ট-গ্রাজুয়েশন সম্পন্ন করেও সাধারণ মেডিকেল অফিসার পদে কাজ করছেন। পদোন্নতি বঞ্চিতদের অনেকের অবসর নেওয়ার সময় ঘনিয়ে আসছে।
অন্যদিকে তাদের সঙ্গে পাস করে বের হওয়া সহপাঠীরা অন্যান্য সরকারি প্রতিষ্ঠান ও মেডিকেলে সহকারী, সহযোগী অধ্যাপক ও অধ্যাপক পদমর্যাদায় উন্নিত লাভ করছেন। আর তাদের দীর্ঘ বছর পদোন্নতি না হওয়ায় অন্য সহকর্মীদের থেকে পদবীতে ছোট হয়ে যাচ্ছেন। দক্ষ চিকিৎসক হওয়ার পরও সামাজিক মর্যাদা পাচ্ছেন না।
তবে কর্তৃপক্ষের দাবি, মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পরবর্তীতে যারা পোস্ট গ্রাজুয়েশন সম্পন্ন করবেন, এ ধরনের চিকিৎসকদের পদোন্নতির ক্ষেত্রে একটি নীতিমালা ছিল। যেখানে পোস্ট গ্রাজুয়েশন সম্পন্ন করার পর তাদেরকে স্ব-বেতনে সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি দেওয়া হতো। পরবর্তীতে ডিপার্টমেন্টের প্রয়োজন অনুযায়ী সেই পদে আত্মীকরণ করা হতো। কিন্তু ২০০৯ সালে সেই আইনটি রহিত করা হয়। এ অবস্থায় বিএসএমএমইউ দেশের প্রথম শ্রেণির মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হলেও স্থায়ীভাবে নিয়োগকৃত চিকিৎসকদের পদোন্নতির সুনির্দিষ্ট নীতিমালা না থাকায় পদোন্নতি বঞ্চিত হচ্ছেন এই চিকিৎসকরা।
পদোন্নতি পেতে বঞ্চিতদের উদ্যোগ
পদোন্নতির দাবিতে ২০১৯ সালের ১ ডিসেম্বর চিকিৎসকরা বিএসএমএমইউর ভাইস চ্যান্সেলর বরাবর স্মারকলিপি প্রদান ও অবস্থান ধর্মঘট পালন করলে কর্তৃপক্ষ দ্রুত সমস্যা সমাধানের আশ্বাস দেয়।
তবে দীর্ঘ অপেক্ষার পর দাবি পূরণ না হওয়ায় ২০২০ সালের ১৪ জানুয়ারি আরও একবার স্মারকলিপি দিয়ে দাবি দাওয়া পেশ করা হয়। সেবার (২০২০ সালের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত) বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭৬তম সিন্ডিকেট সভায় চিকিৎসকদের পদোন্নতির নীতিমালা প্রণয়নের জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়। তবে ওই উদ্যোগ কার্যক্রমে ভাটা পড়ায় ১৩ আগস্ট তৃতীয়বারের মতো মানববন্ধন শেষে ভাইস চ্যান্সেলর বরাবর স্মারকলিপি দেন।
সেবার ওই কমিটি একটি সুনির্দিষ্ট সুপারিশমালা তৈরি করে, যা আজকের সিন্ডিকেট বৈঠকে আলোচনার মাধ্যমে সর্বস্মতিক্রমে পাস হলে আড়াই শতাধিক সিনিয়র চিকিৎক দীর্ঘ দিনের পদোন্নতি বঞ্চনা থেকে মুক্তি পাবেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক চিকিৎসক মেডিভয়েসকে বলেন, তাদের বঞ্চনার এই বিষয়টি মানবিকভাবে বিবেচনা করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, উপ-উপাচার্য, কোষাধ্যক্ষ, সব সিন্ডিকেট সদস্য, সব বিভাগেরপ্রধান, স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের কেন্দ্রীয় সভাপতি, বিশ্ববিদ্যালয় শাখা স্বাচিপ সভাপতি-সেক্রেটারি ও প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক এবিএম আব্দুল্লাহসহ সব পর্যায়ের নীতি-নির্ধারণী ব্যক্তিদের কাছে উপস্থাপন করা হয়েছে। যারা প্রতিবারই পদোন্নতির আশ্বাস দিয়েছেন।
চিকিৎসকরা ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়াসহ করোনার এই পরিস্থিতিতে টেলিমেডিসিন সেবা, বহির্বিভাগের সেবা, ইনডোরে রাউন্ড, করোনা আক্রান্ত রোগীদের জন্য বিশেষায়িত ফিভার ক্লিনিক এবং কোভিড ইউনিটের রোগীদের সেবা প্রদানের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্যসেবার মানকে সমুন্নত রাখার ক্ষেত্রে তারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছেন। এসব বিবেচনায় রোববার সকাল ১১টায় হতে যাওয়া বিএসএমএমইউর সিন্ডিকেট সদস্যদের আলোচানা সভায় সর্বসম্মতিক্রমে পাস হলে পদনোন্নতিতে আর কোনো বাধা থাকবে না।
যা বলছেন সিন্ডিকেট কমিটি ও বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্টরা:
এ ব্যপারে জানতে চাইলে পদোন্নতির জন্য গঠিত সুপারিশ কমিটির সভাপতি, সংসদ সদস্য ও বিএসএমএমইউর সিন্ডিকেট সদস্য অধ্যাপক ডা. মো. আব্দুল আজিজ মেডিভয়েসকে বলেন, ‘এই চিকিৎসকদের বিষয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছিল। সেই কমিটির পক্ষ থেকে একটি রিপোর্ট দেওয়া হয়েছে।’
ইতিবাচক সিদ্ধান্তের আশ্বাস দিয়ে তিনি বলেন, ‘যেহেতু তারা দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসা সেবা দিচ্ছেন। সেহেতু চাকরির বিধি মোতাবেক স্ববেতনে পদোন্নতির জন্য আমরা সুপারিশ করছি। সেখানে জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে পদন্নোতির কথাও বলা হয়েছে। তবে পাস হবে কিনা সেটা বলা যাচ্ছে না, সিন্ডেকেটে যারা আছেন তারা সিদ্ধান্ত নেবেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘সরকারি প্রতিষ্ঠানে পদোন্নতির জন্য যথেষ্ট পোস্ট থাকে। তবে স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানে পদোন্নতির ক্ষেত্রে কিছুটা সমস্যা হয়। কেননা স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানে পদের চেয়ে প্রার্থীর সংখ্যা বেশি থাকে। এসব চিকিৎসকের সাথে ঠিক তেমনটিই ঘটেছে।’
কিছু জটিলতার কাথা উল্লেখ করে অধ্যাপক ডা. আব্দুল আজিজ বলেন, ‘বিএসএমএমইউতে গণহারে ৩৫০ চিকিৎসক নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল, যা আদৌ প্রয়োজন ছিল না। এদের অনেকেই এখন হাসপাতালে আসেন না, কাজও করেন না। কিন্তু মাসে মাস শেষে ঠিকই বেতন তুলে নিচ্ছেন বলে আমাদের কাছে অভিযোগ এসেছে।’
তবে যেসব চিকিৎসক পদোন্নতি পাচ্ছেন না তাদের ব্যাপারে সিন্ডিকেট সভা থেকে একটি সিদ্ধান্ত আসতে পারে বলে জানিয়েছেন সিন্ডিকেট সদস্য অধ্যাপক ডা. আব্দুল আজিজ।
জানতে চাইলে বিএসএমএমইউর রেজিস্ট্রার ও সিন্ডিকেট সদস্য অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল হান্নান মেডিভয়েসকে বলেন, ‘পদোন্নতির বিষয়ে আলোচনা করা হবে। সেখানে গুরুত্বের সঙ্গে বিষয়টা বিবেচনা করা হবে। সুতরাং তাদের হতাশ হওয়ার তেমন কিছু নেই।’
পদোন্নতির ব্যাপারে কিছু জটিলতার কথা উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘এখানে তো ব্যক্তিগত ব্যাপারসহ অনেক কিছুই থাকে। যোগ্যতা, শৃঙ্খলা ও আনুগত্য থাকতে হবে।’
অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল হান্নান বলেন, ‘গত সিন্ডিকেটে তাদের বিষয়ে কমিটি গঠন করা হয়েছিল। তারা একটি প্রতিবেদন দিয়েছে। সেই প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সিন্ডিকেটে এগুলোর সুপারিশ যাবে, তারপর সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’
তবে এ বিষয়ে জানতে একাধিকবার চেষ্টা করেও বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক ডা. কনক কান্তি বড়ুয়াকে মুঠোফোনে পাওয়া যায়নি।