ডা. আশিকুর রহমান রুপম

ডা. আশিকুর রহমান রুপম

এমবিবিএস, বিসিএস (স্বাস্থ্য)
মেডিকেল প্রাবন্ধিক ও জেনারেল ফিজিশিয়ান


৩০ নভেম্বর, ২০২০ ০১:৪১ পিএম

ঘরে বসেই জানুন ডায়াবেটিস হয়েছে কি না?

ঘরে বসেই জানুন ডায়াবেটিস হয়েছে কি না?

বাংলাদেশে বর্তমানে সবচেয়ে বহুল পরিচিত রোগ হল ডায়াবেটিস। দক্ষিণ এশিয়ার এই অঞ্চলের মানুষ মূলত ভাত বা শর্করা নির্ভর খাদ্যভাসে নির্ভরশীল। এই ভাত বা শর্করার জন্যই রক্তের সুগার সব সময় বেশি থাকার একটা প্রবণতা থাকে। এছাড়াও ভাত বেশি খাওয়ার জন্য আমাদের দেশের মানুষদের রক্তে ইনসুলিনের মাত্রা বেশি থাকতে হয়। একে বলে ইনসুলিন স্পাইক। অর্থাৎ অগ্নাশয় বা প্যানক্রিয়াসের বিটা সেল, যেখান থেকে ইনসুলিন তৈরী এবং নিঃসরণ হয়, এই বিটা সেলকে বেশি বেশি কাজ করতে হয়। বেশি বেশি কাজ করতে করতে এক সময় এই বিটা কোষগুলো ক্লান্ত হয়ে যায়। তখন তারা আর ঠিক মত ইনসুলিনের যোগান দিতে পারে না। তৈরী হয় ডায়াবেটিস।

ডায়াবেটিস মূলত রক্তে শর্করা বা সুগার আধিক্য হওয়া রোগ। বাংলায় অনেকে এটাকে বহুমূত্র রোগ বলে থাকে। যদিও এটা কোনো মূত্র বা প্রস্রাবের রোগ নয়। এটা রক্তে সুগার নিয়ন্ত্রণহীনতার রোগ। এর সাথে জড়িত থাকে প্রধানত অগ্নাশয় এবং ইনসুলিন। ডায়াবেটিস রোগীদের ঘন ঘন প্রস্রাব হয় বিধায় বাঙালীরা একে বহুমূত্র রোগ বলে। এই রোগে ওজন কমে যায়, মাংশ পেশি কমে যায় বলে অনেকে শরীর শুকিয়ে যাওয়া রোগ বা হাওয়া বাতাস লাগা রোগও বলত। তাই এই লেখার উদ্দেশ্য হল বাসাতে বসেই কিভাবে বুঝবেন যে আপনি ডায়াবেটিসে আক্রান্ত কি না?

শুরুতে জেনে নেওয়া যাক কারা ডায়াবেটিসের ঝুঁকিতে আছে?

সর্বপ্রথম মনে রাখতে হবে একদিনের বাচ্চারও ডায়াবেটিস হতে পারে। যাকে বলে টাইপ-১ ডায়াবেটিস (যাদের ইনসুলিন তৈরীই হয় না)। বেশিরভাগ আমরা যে ডায়াবেটিস রোগী দেখতে পাই, তারা মূলত টাইপ-২ ডায়াবেটিস। যাদের ইনসুলিন কম তৈরী হয়, অথবা ইনসুলিন ঠিক মত কাজ করতে পারে না।

  • যদি কোনো পরিবারের বাবা মায়ের ডায়াবেটিস থাকে তবে ৫০% ঝুঁকি থাকে সন্তানদের হবার। এটা জেনেটিক বা বংশগত ব্যাপার।
  • যারা সব সময় স্ট্রেস বা মানসিক চাপযুক্ত কাজ করেন।
  • যারা কায়িক পরিশ্রম কম করেন।
  • শারিরিক ব্যায়াম একদমই করেন না।
  • শর্করা জাতীয় খাবার যেমন- ভাত বেশি খান, চিনি বেশি খান, ফাস্ট ফুড, জাঙ্ক ফুড বেশি খান।
  • যাদের অগ্নাশয়ের কোনো অসুখ আছে। যেমন টিউমার।
  • যাদের অন্যান্য কোনো হরমন গত সমস্যা আছে বা অন্য হরমন শরীরে বেশি থাকলে তা ডায়াবেটিস ঘটাতে পারে। যেমনঃ থাইরয়েডের অসুখ (হাইপারথায়রয়েডিজম), গ্রোথ হরমন (এক্রোমেগালী), এড্রেনালিন হরমন ( ফিওক্রোমোসাইটোমা), অগ্নাশয়ের গ্লুকাগোন হরমন (গ্লুকাগোনোমা) ইত্যাদি।
  • গর্ভাবস্থায়ও ডায়াবেটিস হতে পারে। একে বলে জেস্টাশনাল ডায়াবেটিস।
  • কিছু ওষুধ যারা নিয়মিত এবং দীর্ঘদিন ধরে খান। যেমন- এজমা বা হাটু ব্যাথার জন্য স্টেরয়েড, ব্যাথার ওষুধ, মূত্রবর্ধক ওষুধ- থায়াজাইড, খিচুনি বা মানসিক রোগের ওষুধ- ফিনাইটইন গ্রুপের ওষুধ ইত্যাদি।
  • কিছু জেনেটিক অসুখ। যেমন- ডাউন সিন্ড্রোম (অটিস্টিক), ৩য় লিঙ্গের মানুষদের (ক্লিনফিল্টার বা টার্নার সিন্ড্রোম) ইত্যাদি।
  • এ ছাড়াও জেনেটিক কারনে যদি অগ্নাশয়ের বিটা সেল বা ইনসুলিন ঠিক মত কাজ করতে না পারে।

এখন বাসায় থেকেই কিভাবে নির্ণয় করবেন ডায়াবেটিস হয়েছে কি না?

প্রথমে লক্ষন-উপসর্গ আছে কি না মিলিয়ে নিনঃ

  • হঠাৎ কোনো কারণ ছাড়াই অতিরিক্ত দূর্বল লাগা।
  • অল্প কাজ করলেই কাহিল হয়ে যাওয়া। উদ্দাম না পাওয়া।
  • চেহারা শুকিয়ে যাওয়া।
  • ঘন ঘন প্রস্রাব, পিপাসা এবং ক্ষুধা লাগা।
  • ঘুমের সমস্যা হওয়া।
  • কোনও ক্ষত বা ঘা শুকাতে না চাওয়া। বিশেষ করে পায়ে।
  • যৌনাঙ্গে বা শরীরের ভাজ যুক্ত জায়গায় যেমন- কুঁচকিতে ঘা হওয়া ইত্যাদি।

এই উপসর্গগুলো থাকলে আপনি বাসাতেই টেস্ট করতে পারবেন আপনার ব্লাড সুগার।

 এই জন্য আপনার লাগবে একটি গ্লুকোমিটার। বিভিন্ন কোম্পানীর পাওয়া যায়। ৮০০-১৫০০ টাকার মধ্যেই পেয়ে যাবেন। এর সাথে থাকে সুগার মাপা স্ট্রিপ। আর তার সাথে নিডল বা সুই এবং তুলা ও স্পিরিট বা হেক্সিসল।

নিয়মঃ

নিডলটি ট্রিগাররের সাথে লাগান। ব্লাড সুগার স্ট্রিপটা গ্লুকোমিটারের সাথে লাগান। এবার আপনার যে কোনো হাতে মধ্য অথবা রিং ফিংগারের ডগায় ছোট্ট একটা ফুটা বা প্রিক করে এক ফোটা রক্ত স্ট্রিপের নির্দিষ্ট চিহ্নিত জায়গায় দিন। এবার ৫-৭ সেকেন্ড অপেক্ষা করুন। আপনার সুগারের মাপ চলে আসবে।

ধরুন আপনার মান এল ৬ মিলি মোল/ লি। এককটা আপনার ওতো গুরুত্ব না দিলেও চলবে। ৬ এলে কি আপনার ডায়াবেটিস? এর উত্তরঃ না। আপনি ভাল আছেন।

আরেকজনের করলেন তার এল ৭.৪ । তার কি ডায়াবেটিস? এই উত্তর সরাসরি দেওয়া যাবে না। আবার ধরেন আপনার আরেকজনের করলেন তার এল ১৫.১ । তার কি ডায়াবেটিস? উত্তরঃ হ্যা। তার হবার সম্ভাবনা ৯৯%। (যদিও গ্লুকোমিটার দিয়ে একদম এক্যুরেট মাপ বলা যায় না। তবে ১৫ হলে ধরে নিতে হবে, তার ডায়াবেটিস হয়ে গেছে।)

এখন নিশ্চয় প্রশ্ন জাগছে যে, কেন একজনের ৬ হল, সে ডায়াবেটিস নন, ৭.৪ এলে বলা গেল না, কিন্তু ১৫ এলে বলে দেওয়া গেল যে ডায়াবেটিস। নিশ্চয় এর একটা রেঞ্জ বা মাত্রা আছে। আসুন এটাই এবার খোলা মনে জেনে নেওয়া যাক।

 সারা রাত (অর্থাৎ কম পক্ষে ৮ ঘন্টা) না খেয়ে থেকে সকালে কোনো কিছু না খেয়ে সুগার মাপলে তা হতে হবে ৩.৫০ ৬.১০ এর মধ্যে। তাহলে আপনি সুস্থ।

কিন্তু ৬.১০-৭.০০ এর মধ্যে এলে আপনি প্রি-ডায়াবেটিস বা ডায়াবেটিসের উচ্চ ঝুঁকির মধ্যে আছেন। একে বলে ইম্পেয়ারড ফাস্টিং সুগার। কিন্তু যদি সাতের বেশী হয়ে যায়, তবে আপনি ডায়াবেটিসে আক্রান্ত।

এবার আসেন, আপনি সকালে আপনার যা যা পছন্দ তা দিয়ে ভরপেট নাস্তা করলেন। কোনও নিষেধাজ্ঞা নেই। মাছ মাংস, ডিম দুধ, পায়েশ, রসুগোল্লা যা খুশি তাই খেলেন। এরপর ঠিক ২ ঘন্টা পর আবার সুগার মাপলেন।

দেখলেন, তা ৭.৮ এর নিচে আছে। অর্থাৎ ৭.১ বা ৭.৫ বা ৬.২ ইত্যাদি তাহলে আপনি সুস্থ। আপনার শরীর খাবারের শর্করাকে আচ্ছা মত বিপাক করতে পারছে। কিন্তু দেখলেন তা আছে ৭.৮-১১.১ এর মধ্যে। যেমন- ৮.১ বা ৯.২ বা ১০.১ ইত্যাদি তাহলে আপনি প্রিডায়াবেটিস বা ডায়াবেটিসের উচ্চ ঝুঁকির মধ্যে আছেন। একে বলে আইজিটি (ইম্পেয়ারড গ্লুকোজ টলারেন্স)। আপনার শরীর ঠিক মত খাবারের শর্করাকে বিপাক করতে পারছে না। তবে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু যদি দেখেন যে এটা ১১.১ এর বেশি হয়ে গেছে। যেমন ১২.১ বা ১৩ বা ১৫ ইত্যাদি। তবে আপনি ডায়াবেটিসে আক্রান্ত।

বোঝার সুবিধার্থে একটা ছঁকেই পুরো বিষয়টা দেখানোর চেষ্টা করা হল:-

খাবারের আগে/পরে

সুগারের মাত্রা

(সুস্থ মানুষ)

প্রিডায়াবেটিস

(ঝুকিপূর্ণ ব্যক্তি)

ডায়াবেটিস

(আক্রান্ত)

 

নাস্তার পূর্বে

৩.৫-৬.১

৬.১-৭

৭ এর বেশি

নাস্তার ২ ঘন্টা পর

৭.৮ এর কম

৭.৮-১১.১

১১.১ এর বেশি

দিনের যে কোনো সময়/ খাবারের সাথে সম্পর্ক নাই।

৭.৮ এর কম

৭.৮-১১.১

১১.১ এর বেশি

 

এখন একটা প্রশ্ন থেকেই যাই যে, আমার একদিন হঠাৎ ইচ্ছে হল, মেপে দেখলাম ১১ বা ১২ আসলো। তাহলে আমি কি ডায়াবেটিস? উত্তরঃ না। ডায়াবেটিস নিশ্চিত হতে গেলে অবশ্যই দুইবার সুগার চেক করতে হবে। খালি পেটে এবং খাবারের ২ ঘন্টা পর। দুই ক্ষেত্রেই যদি নির্দিষ্ট মাত্রার বেশি থাকে। তবেই আপনি ডায়াবেটিসে আক্রান্ত।

এভাবেই বাসায় বসেই আপনি আপনার লক্ষণ-উপসর্গ এবং সাথে গ্লুকোমিটার দিয়ে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত কি না তা চেক করতে পারবেন। বাসায় থাকা যে কোনও বয়সীদেরই এটা করা যায়। তবে এক নিডল দিয়ে সবার প্রিক করা কখনোই উচিৎ নয়।

বাসাতেই জেনে গেলেন যে, আপনি ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়ে গেছেন। আপনি কি ওষুধ শুরু করে দেবেন? উত্তরঃ না। আপনি মোটামুটি মানসিক প্রস্তুতি রাখবেন যে আপনি ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়েছেন। তবে ওষুধ শুরু করার আগে বা আদৌ ওষুধ লাগবে কি না, এটা নিশ্চিত করার জন্য আপনাকে কোনো ভাল ল্যাব থেকে রক্তের সুগার, মূত্রের সুগার এবং HbA1c এই টেস্ট করে নিতে হবে। কারণ ডায়াবেটিসের শুরুর দিকে সুগারের মাত্রা কম থাকলে ডাক্তারগণ ওষুধ দিতে চান না। খাবারের ডায়েট প্ল্যান চেঞ্জ করে দেন এবং নিয়মিত ব্যায়াম বা ৪০ মিনিট হাটার পরামর্শ দেন। কিছু দিন এই প্র্যাক্টিস করে বাসাতেই ঐ গ্লুকোমিটার দিয়েই মেপে মেপে কাগজে লিখে রাখতে বলেন। যদি দেখা যায়, শুধু খাদ্যাভাস এবং ব্যায়াম বা হাটাহাটি করেই সুগার নিয়ন্ত্রণে আছে। তবে আপনি বেচে গেলেন।

আর ওষুধ লাগল না। কিন্তু ঐভাবে চিরকাল নিয়মের মধ্যে খাদ্য এবং ব্যায়াম চালিয়ে যেতে হবে। কিন্তু যদি দেখা যায় যে, সুগার নিয়ন্ত্রণে থাকছে না। তবে মেটফরমিন জাতীয় ওষুধ দিয়ে আপনার ডায়াবেটিসের চিকিৎসার যাত্রা শুরু করা হয়। এই ওষুধের একটা সাইড ইফেক্ট এখানে উল্লেখ না করলেই নয়। তা হল এতে এসিডিটির ভাব হয়। এ জন্য এটা খেতে হয় ভরা পেটে। তবে খাবারের মাঝে খেতে পারলে বেস্ট হয়। তবে এই সমস্যা কিছুদিনের মধ্যে এডজাস্ট হয়ে যায়। তবে সুগারের পরিমাণ অনেক বেশি থাকলে যেমন- ১৮ বা ২০ থাকলে সাধারণত অল্প কিছুদিনের জন্য ইনসুলিন শুরু করে তা নিয়ন্ত্রণে এনে মুখে ওষুধ চালিয়ে যাওয়া হয়।

যাই হোক, যেহেতু এখন প্রতিটা ঘরে ঘরেই ডায়াবেটিসের রোগী। প্রত্যেকেরই উচিৎ হবে বাসাতেই একটা গ্লুকোমিটার কিনে রাখা। ডায়াবেটিসের যারা রোগী আছেন তাদের অন্তত প্রতি সপ্তাহে অথবা প্রতি মাসে সুগার চেক করা উচিত। এসব ক্ষেত্রে ডায়াবেটিস রোগীদের বাসার সবার একাত্মতা এবং সহযোগীতা বিশেষ ভাবে প্রয়োজন হয়।

মেডিভয়েসের জনপ্রিয় ভিডিও কন্টেন্টগুলো দেখতে সাবস্ক্রাইব করুন MedivoiceBD ইউটিউব চ্যানেল। আপনার মতামত/লেখা পাঠান [email protected] এ।
  ঘটনা প্রবাহ : ডায়াবেটিস
  এই বিভাগের সর্বাধিক পঠিত