ডা. মো. তাহমিদুল ইসলাম তমাল

ডা. মো. তাহমিদুল ইসলাম তমাল

সহকারী কমিশনার এবং নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, খুলনা

(৩৭তম বিসিএস প্রশাসনে মেধা তালিকায় তৃতীয়)

সাবেক সহকারী সার্জন (৩৫তম বিসিএস )

রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (২০০৮-০৯)


০৬ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ০৮:১৯ পিএম
চৌগাছা-ঝিনাইদহ মডেল 

চিকিৎসাসেবায় জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণের গল্প  

চিকিৎসাসেবায় জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণের গল্প  

যশোরের চৌগাছা হাসপাতালে ১৯৮৫ সালে কর্মজীবন শুরু করেন ডা. মো. ইমদাদুল হক। ১৯৮৮ সালে তিনি চলে যান লোহাগড়ায়। ১৯৯৫ সালে আবার ফিরে আসেন চৌগাছায়। এখানে জনগণের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে তিনি বিভিন্ন সমস্যার মুখোমুখি হন। সমস্যা থেকে উত্তরণের উপায় হিসেবে তিনি হাসপাতালের সঙ্গে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে চিকিৎসাসেবার পরিবর্তন ঘটাতে সচেষ্ট হন এবং স্থানীয় জনগণের সম্পৃক্ততা এবং আর্থিক সহায়তায় হাসপাতালের সেবার মান বৃদ্ধিতে সফলতা লাভ করেন। কার্যকর এই উদ্যোগের জন্য তিনি উপজেলা পর্যায়ে প্রসূতিসেবায় বারবার পুরস্কৃত হন। 

চৌগাছা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স স্বাস্থ্য সেবা অধিদদপ্তরের মহাপরিচালক এবং ইউনিসেফের দ্বারা খুলনা বিভাগে প্রসূতিসেবায় সেরা হাসপাতাল হিসেবে যৌথভাবে ২০০৫ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত একটানা পুরস্কৃত হয়। ২০০৮ সালে তৎকালীণ স্বাস্থ্যসচিব চৌগাছা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সকে মডেল স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স হিসেবে ঘোষণা করেন। 

২০১০ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক ড. মার্গারেট চ্যান চৌগাছা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স পরিদর্শন করে স্বাস্থ্যসেবায় এই পদ্ধতিকে একটি অনুকরণীয় মাইলফলক হিসেবে অভিহিত করেন। 

২০১১ সালে TQM- Total Quality Management এর আওতায় আসে হাসপাতালটি। জনগণকে সাথে নিয়ে হাসপাতালের সমস্যা নিরসনের এই মডেলটি সামগ্রিকভাবে দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে চৌগাছা মডেল নামে।

ডা. ইমদাদুল এরপর সিনিয়র কনসালট্যান্ট (গাইনি) পদোন্নতি নিয়ে ২০১২ সালে ঝিনাইদহ সদর হাসপাতালে যোগ দেন। দেখেন হাসপাতালটি নানা সমস্যায় জর্জরিত। হাসপাতালে প্রয়োজন ৩৬ জন ক্লিনার, কাজ করেন ৬ জন। আয়া, ওয়ার্ডবয়, গার্ড, গার্ডেনার, ট্রলিম্যান ও ইলেকট্রিশিয়ানের কোনো পদই নেই। 

এসবের দায়িত্ব পালন করেন ধার করা লোকজন। তাদের কোনো সম্মানী নেই, মাস শেষে কর্তৃপক্ষ ৩০০ থেকে ৪০০ করে টাকা হাতে ধরিয়ে দেয়। তাঁদের আয়-রোজগারের পথ ছিল রোগীদের ওপর জোরজুলুম করে টাকা নেওয়া। টাকা না দিলে সদ্য জন্ম নেওয়া শিশুটিকে তার মাকে দেখতে দেওয়া হতো না। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণ না মেনে তারা চলতেন খেয়ালখুশি মতো। এ কারণে রোগীদের সঙ্গে প্রায়ই তাদের বিবাদ বাধত। তাদের অনেকে রোগী ভাগিয়ে নেওয়ার কাজে ক্লিনিকের দালালিও করতেন। জনবলের অভাবে হাসপাতাল ছিল অপরিচ্ছন্ন-দুর্গন্ধময়। রোগীরা সরকারি হাসপাতাল থেকে মুখ ফিরিয়ে ছুটছিলেন বেসরকারি ক্লিনিকগুলোয়। এভাবেই চলছিল ঝিনাইদহ সদর হাসপাতাল।

 

হাসপাতালের এই পরিস্থিতি দেখে ডা. ইমদাদুল এ থেকে পরিত্রাণের পথ খুঁজতে শুরু করেন। এর আগে যশোরের চৌগাছা হাসপাতালে তিনি স্থানীয় জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে ফল পেয়েছিলেন। এখানেও চৌগাছার আদলে হাসপাতালে স্থানীয় জনসাধারণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার উদ্যোগ নেন। শুরু করেন একের পর এক বৈঠক। শিক্ষক, চিকিৎসক, রাজনৈতিক নেতা, জনপ্রতিনিধি, এনজিও কর্মীসহ সব শ্রেণী-পেশার মানুষের সঙ্গে মতবিনিময় করেন।

মাত্র তিন বছরেই পাল্টে যায় ঝিনাইদহ সদর হাসপাতালের পুরো চিত্র। স্থানীয়ভাবে নিয়োগ দেওয়া কর্মীরা কাজ করতে থাকেন। যারা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থেকে শুরু করে জরুরি বিভাগেও দায়িত্ব পালন করেন, তাদের বেতন দেন স্থানীয় লোকজনই। এখন আর চিকিৎসা নিতে এসে কাউকে পয়সা দিতে হয় না। গোটা হাসপাতাল এলাকা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিরাপত্তা বেড়েছে। বার্ষিক রাজস্ব বেড়েছে। বহির্বিভাগের পাশাপাশি ভর্তি রোগীর সংখ্যাও বেড়েছে দ্বিগুণ। আর প্রসূতি ভর্তির হার বেড়েছে কয়েক গুণ। আয়া-ক্লিনার থাকায় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ফিরে আসে। শিশু ওয়ার্ড আলাদা করে গড়ে তুলেন। হাসপাতালের ভাঙা সীমানা-প্রাচীর মেরামত করান। তার এসব কাজে পৌরসভার মেয়র সাইদুল করিম, শিল্পপতি নাসের শাহরিয়ার জাহেদী ওরফে মহুল, তাহজীব আলম সিদ্দিকী এমপি, ডা. আবদুর রহমান, সাবেক মেয়র আনিছুর রহমানসহ অনেকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন। বর্তমানে হাসপাতালটিতে স্থানীয় লোকজনের দেওয়া সম্মানিতে ৫৩ জন কর্মী কাজ করছেন।

আমাদের দেশের হাসপাতালগুলোতে সীমাবদ্ধতার শেষ নেই। এসব হাসপাতালের কর্তাব্যক্তিরা অনেক সময় জনগণের চাহিদা পূরণ করতে পারেন না। এসব ক্ষেত্রে তারা চৌগাছা-ঝিনাইদহ মডেল ব্যবহার করে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, সরকারি কর্মকর্তা, চিকিৎসক, সাংবাদিক, এনজিও কর্মকর্তা, শিক্ষকসহ বিভিন্ন শ্রেনি-পেশার জনসাধারণের সম্পৃক্ততা এবং অংশীদারিত্বের মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবাসহ সামগ্রিক মানোন্নয়নের চেষ্টা করতে পারেন। শুধু প্রয়োজন ডা. ইমদাদুল হকের মতো দৃঢ়চেতা আত্মবিশ্বাস ও নেতৃত্বের।

  এই বিভাগের সর্বাধিক পঠিত
এক দিনে চিরবিদায় পাঁচ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক
করোনা ও বার্ধক্যজনিত অসুস্থতা

এক দিনে চিরবিদায় পাঁচ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক