
মঈনুল ইসলাম
মেডিকেল শিক্ষার্থী,
চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতাল মেডিকেল কলেজ।
০৫ জুলাই, ২০২০ ০৯:১৯ পিএম
স্ট্রোক কেন এবং কিভাবে হয়?

প্রতি দুই সেকেন্ডে পৃথিবীর কোন না কোন প্রান্তে কেউ না কেউ স্ট্রোক করছেন এবং প্রতি ছয়জন মানুষের মধ্যে একজন তার জীবনের যে কোন একটা পর্যায়ে এসে স্ট্রোক করেন। স্ট্রোক মানে হলো আমাদের মস্তিষ্কের মাঝে অক্সিজেনের সাপ্লাই কমে যাওয়া এবং এটি পৃথিবীতে মৃত্যুর খুব সাধারণ কারণগুলোর মধ্যে একটি। মৃত্যুর পাশাপাশি এটা মানুষকে বিকলাঙ্গ করে দেয় এবং ব্যক্তির কর্মজীবনের ইতি টানে।
কেউ স্ট্রোক করলে তাকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসা করানোটা খুবই জরুরি। এই সিদ্ধান্ত যত দ্রুত নেওয়া যাবে, মস্তিষ্কের ক্ষতি হবার সম্ভাবনাও ততো কমে আসবে।
যে কারণে স্ট্রোক সংগঠিত হয়:
আমাদের মস্তিষ্ক সারা শরীরের ওজনের মাত্র দুই ভাগ বহন করে থাকে। কিন্তু এই ছোট্ট যন্ত্রটি সারা শরীরের মোট অক্সিজেনের বিশ ভাগ একাই খরচ করে থাকে। অক্সিজেন কিছু রক্তনালি বেয়ে যেমন- ক্যারোটিড ধমনী, মেরুদন্ডের ধমনী হয়ে মস্তিষ্কে প্রবেশ করে। ক্যারোটিড ধমনী আমাদের মস্তিষ্কের সামনের দিকের অংশে এবং মেরুদন্ডের ধমনী মস্তিষ্কের পেছনের দিকের অংশে রক্ত চলাচল বজায় রাখে। মেরুদন্ড ও ক্যারোটিড ধমনী একসাথে যোগ হয়ে মস্তিষ্কের ভেতরে একটা কাঠামো তৈরি করে, একে আমরা বলি সার্কেল অফ উইল, যেটা পরবর্তীতে অনেকগুলো ছোট ছোট শাখায় বিভক্ত হয়ে পুরো মস্তিষ্কের কোটি কোটি নিউরনে অক্সিজেন, গ্লুকোজের সাপ্লাই দিয়ে প্রয়োজনীয় চাহিদা মেটায়।
যদি এই রক্তনালিকাগুলো দিয়ে রক্ত প্রবাহিত হতে না পারে কিংবা আংশিক প্রবাহিত হতে পারে, তাহলে মস্তিষ্কের কোষগুলো ঠিকমতো অক্সিজেন পায়না৷ তখন মস্তিষ্কের কোষগুলো অক্সিজেনের অভাবে মৃত্যুবরণ করে।
দুইটি পদ্ধতিতে এই পুরো ব্যাপারটা ঘটতে পারে:
ক. হেমোরেজিক স্ট্রোক: যখন কোন রক্তনালি ছিদ্র হয়ে যায় এবং সেই ছিদ্র দিয়ে রক্ত বের হয়। এটা তুলনামূলকভাবে কম ঘটে।
খ. ইস্চেমিক স্ট্রোক: এটা খুব বেশি ঘটে থাকে। যখন রক্তনালি ব্লক হয়ে যায় কিংবা রক্ত রক্তনালি দিয়ে ঠিকমতো প্রবাহিত হতে পারেনা, তখন ইস্চেমিক স্ট্রোক হয়। রক্তনালি যে উপাদানগুলো জমে ব্লক বা বন্ধ হয়ে যায়, একে আমরা ক্লট বলি।
হার্টের চারটা চেম্বার থাকে। কোন কারণে উপরের চেম্বারগুলো যদি ঠিকমতো কাজ না করতে পারে তখন রক্তপ্রবাহ ধীর গতিসম্পন্ন হয়ে যায়। ফলে প্লেটলেট, ক্লটিং ফ্যাক্টর, ফিব্রিণ একসাথে মিলে গিয়ে তৈরি করে ক্লট। এই ক্লট হার্ট থেকে রক্তের মাধ্যমে ভেসে গিয়ে সোজা মস্তিষ্কে চলে যেতে পারে। ক্লট মস্তিষ্কের রক্তনালিতে আটকে যায়, এই ঘটনাটাকে বলা হয় অ্যামবোলিজম। এতে রক্ত সামনের দিকে যেতে পারেনা, ফলে মস্তিষ্কের কোষগুলো অক্সিজেন সাপ্লাই পায়না ।
মজার ব্যাপার হলো, আমাদের মস্তিষ্কের কোষগুলোতে কোন পেইন রিসেপ্টর নেই। তাই, রক্তনালিগুলো ব্লক হয়ে গেলেও ব্যক্তি ব্যথা অনুভব করেন না। কিন্তু অক্সিজেনের সাপ্লাই কমে যাওয়ায় মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা ধীরে ধীরে কমে যেতে থাকে। এটা হঠাৎ দেখা দিতে পারে এবং সবাই বুঝতে পারে যে কিছু একটা ওলট-পালট হচ্ছে।
যেমন, যদি মস্তিষ্কের স্ট্রোকের জায়গাটা কথা বলার সেন্টারে (স্পিচ সেন্টার) হয়, তাহলে ব্যক্তির কথা জড়িয়ে আসবে। যদি মস্তিষ্কের স্ট্রোকের জায়গাটা ব্যক্তির পেশিকে নিয়ন্ত্রণ করে তেমন কোন জায়গা হয়, তাহলে পেশিগুলো দুর্বল হয়ে যাবে। এটা শরীরের যে কোন এক দিকের পেশি হবার সম্ভাবনা বেশি।
স্ট্রোক হবার সাথে সাথে আমাদের মানবদেহ চায় সেটাকে যতটুকু সম্ভব দমিয়ে রাখতে বা ক্ষতিপূরণ করতে। তাই শরীরের সিস্টেমগুলো তখন বেশি বেশি রক্ত প্রবাহ ঠেলে দিতে চায় ক্ষতিগ্রস্ত মস্তিষ্কের অংশে। কিন্তু এই অতিরিক্ত রক্তপ্রবাহ তখন আর তেমন কোন ভালো ফলাফল বয়ে আনতে পারেনা।
ধীরে ধীরে অক্সিজেন না পেয়ে মস্তিষ্কের কোষগুলো মারা যেতে থাকে, ফলে স্থায়ী ব্রেন ড্যামেজ হতে পারে। এ কারণেই স্ট্রোকের রোগীদের খুব দ্রুত হাসপাতালে নেওয়া জরুরি।
