মঈনুল ইসলাম
মেডিকেল শিক্ষার্থী,
চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতাল মেডিকেল কলেজ।
০৩ জুলাই, ২০২০ ১২:০৭ পিএম
অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স
ব্যাকটেরিয়াগুলো যেভাবে বুদ্ধিমান ও শক্তিশালী হয়ে ওঠে
আমাদের পৃথিবীতে ব্যাকটেরিয়া প্রাচীনতম জীবিত জীবের মাঝে একটি। এরা সবথেকে ক্ষুদ্র প্রাণ যার মাঝে আমরা জীবন আছে বলে ধরে নেই এবং ব্যাকটেরিয়াকে সর্বত্রই পাওয়া যায়। বেশিরভাগ ব্যাকটেরিয়াই আমাদের শরীরের জন্য ক্ষতিকর নয়। আমাদের শরীরে ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন পরিমানের ব্যাকটেরিয়া আছে যারা শরীরের সিস্টেমগুলোকে বাঁচিয়ে রাখতে প্রতিনিয়ত সাহায্য করছে।
কিন্তু, কিছু ব্যাকটেরিয়া আছে যারা মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর। তারা মানবদেহে আক্রমণ করে, খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে, এমনকি মৃত্যুও ঘটাতে পারে। ব্যাকটেরিয়াল ইনফেকশনের কারণে প্রতিবছর মিলিয়ন মিলিয়ন মানুষ মারা যায়। কিন্তু, বর্তমান পৃথিবীর কাছে একটা সুপার অস্ত্র আছে যেটা এই চরম ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়াগুলোকে মারতে সাহায্য করে,যার নাম অ্যান্টিবায়োটিক। ভ্যাক্সিনেশনের সাথে সাথে অ্যান্টিবায়োটিক মেডিকেল সায়েন্সে বিপ্লব নিয়ে এসেছে এবং একসাথে কোটি মানুষের প্রাণ বাঁচিয়েছে।
অ্যান্টিবায়োটিক শরীরে আক্রমণ করা ব্যাকটেরিয়াকে ব্যাপক পরিমাণে ধ্বংস করতে পারে খুবই দ্রুততম সময়ে।কিছু ব্যাকটেরিয়া অ্যান্টিবায়োটিক কাজ করার পরও যদি বেঁচে যায়,আমাদের রোগ প্রতিরোধক ব্যবস্থাপনা তখন সহজেই বাকিদেরকে মেরে ফেলতে সক্ষম হয়।
আমরা একটু জানবো অ্যান্টিবায়োটিক কিভাবে ব্যাকটেরিয়াকে হত্যা করে:
ধরে নিলাম,ব্যাকটেরিয়া একটি জটিল যন্ত্র যার ভেতরে দুর্বোধ্য অনেক জিনিস লুকানো আছে।জটিল যন্ত্রপাতি গুলো ব্যাকটেরিয়াকে বেঁচে থাকতে এবং একটিভ রাখতে সাহায্য করে থাকে।এন্টিবায়োটিক এই জটিল কাঠামোটাকে আক্রমণ করে ভেঙে ফেলে। যেমন, ব্যাকটেরিয়ার মেটাবলিজমের প্রক্রিয়ায় ব্যাঘাত ঘটিয়ে। কিছু অ্যান্টিবায়োটিক ব্যাকটেরিয়ার ডিএনএকে আক্রমন করে, এতে নতুন কোন ডিএনএর কপি তৈরি হয় না, ব্যাকটেরিয়া মারা যায় এবং পুনরায় বংশবৃদ্ধি করতে পারে না।
কিছু এন্টিবায়োটিক আবার ব্যাকটেরিয়ার বাহিরের আবরণকে (Capsule) নষ্ট করে ফেলে, এতে ভেতরের জিনিসপত্র সব বাহিরে বের হয়ে আসে ও ব্যাকটেরিয়া দ্রুত মারা যায়। এসব কিছুই করা হয় শরীরের প্রয়োজনীয় কোষের কোন ক্ষতিসাধন না করেই।
কিন্তু, পৃথিবীর আবিষ্কার বর্তমানে এই ব্যাপারকেই জটিল থেকে জটিলতর করে তুলেছে। প্রযুক্তি এগিয়েছে, মানুষের কাজ করার সক্ষমতা বেড়েছে এবং দুনিয়া সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। কিছু কিছু ব্যাকটেরিয়াও অধুনিক যুগে বুদ্ধিমান হয়ে উঠেছে। তারা নিজেদেরকে এন্টিবায়োটিকের কাছ থেকে আত্মরক্ষার জন্য নতুন নতুন রূপে সাজাচ্ছে। এতে আমাদের শরীরে প্রয়োগকারী অ্যান্টিবায়োটিক আর আগের মতো কাজ করতে পারছেন। যেমন-
১. অ্যান্টিবায়োটিককে তার কাজের আগেই ব্যাঘাত ঘটানো বা ব্যাকটেরিয়ার আণবিক পরিবর্তনের মাধ্যমে। এতে অ্যান্টিবায়োটিক সেই বুদ্ধিমান ব্যাকটেরিয়ার জন্য অকেজো হয়ে যাচ্ছে।
২. অ্যান্টিবায়োটিক ব্যাকটেরিয়ার ভেতরে গিয়ে কাজ করার আগেই তাকে ব্যাকটেরিয়া তার নিজস্ব পাম্পের মাধ্যমে শক্তি খাটিয়ে বের করে দেয়। তাই ব্যাকটেরিয়ার কোন ক্ষতিই হচ্ছে না।
অল্প সংখ্যক ব্যাকটেরিয়া হলে আমাদের ইমিউন সিস্টেম তাদেরকে মেরে ফেলতে পারে সহজে। কিন্তু,আমাদের শরীরের সিস্টেম যদি তাদেরকে মারতে না পারে, বেঁচে যাওয়া ব্যাকটেরিয়াগুলো আরো শক্তিশালী ও বুদ্ধিমান হয়ে ওঠে শরীরের ভেতরেই।
ব্যাকটেরিয়া যেভাবে এতো বুদ্ধিমান ও শক্তিশালী হয়ে ওঠে:
প্রথমতো, ব্যাকটেরিয়ার দুই ধরনের ডিএনএ থাকে। ক্রোমোজম এবং প্লাসমিড। প্লাসমিড হলো ব্যাকটেরিয়ার ভাসমান একটা ডিএনএর ছোট্ট টুকরো। ব্যাকটেরিয়াগুলো নিজেদের মাঝে প্লাসমিডের আদান-প্রদান করতে পারে, এতে তাদের অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার সক্ষমতা বেড়ে যায়। তাই কোন একটা ব্যাকটেরিয়া যদি বুদ্ধিমান হয়ে ওঠে, সে তার পাশের ব্যাকটেরিয়া গুলোকে প্লাসমিড শেয়ারের মাধ্যমে তাকেও বুদ্ধিমান করে তুলতে পারে।
দ্বিতীয়ত, ট্রান্সফরমেশন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে জীবিত ব্যাকটেরিয়া মৃত ব্যাকটেরিয়ার কাছ থেকে ডিএনএ নিয়ে নিতে পারে। এই ট্রান্সফরমেশন প্রক্রিয়াটি দুটি ভিন্ন প্রজাতির ব্যাকটেরিয়ার মাধ্যমেও হতে পারে, এতে একটি ব্যাকটেরিয়াই বিভিন্নভাবে বিভিন্ন জাতের ব্যাকটেরিয়া থেকে বুদ্ধিমত্তা অর্জন করে ফেলে। ফলে, এক জাতের ব্যাকটেরিয়া কয়েকধরণের এন্টিবায়োটিককে চিনে ফেলে এবং তাদেরকে অকেজো করে দিতে সক্ষম হয়। একটা ব্যাকটেরিয়াকে মারতেই তখন অনেক অ্যান্টিবায়োটিক লেগে যায়।
পৃথিবীতে বর্তমানে বেশ কিছু ব্যাকটেরিয়া আছে, যারা মানুষের তৈরি বেশির ভাগ অ্যান্টিবায়োটিককেই পরোয়া করে না, এদেরকে আমরা সুপারবাগ (Superbug) বলি।
বর্তমান যুগ প্রি-এন্টিবায়োটিকের যুগকে পেছনে ফেলে চলে এসেছে, যে যুগে ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণেই অনেক মানুষ মারা যেতো। আমরা অ্যান্টিবায়োটিককে মেডিসিন সায়েন্সের একটা মারাত্নক পরিবর্তন হিসেবেই দেখি, এটা আমাদের জন্য জীবন বাঁচানোর নতুন দুয়ার খুলে দিয়েছে।
কিন্তু, এই অ্যান্টিবায়োটিকের যত্রতত্র ব্যবহারে দেখা দিতে পারে মারাত্মক অসুবিধা। উন্নত অনেক দেশেই অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহারকে জনগনের কাছে সীমিত আকারে ধরে রাখা হয়েছে। অপরদিকে অনেক দেশেই মানুষ না বুঝে অ্যান্টিবায়োটিক খেয়ে ফেলছেন, এটাকে খুব সহজেই প্রেসস্ক্রাইবডও করা হচ্ছে। অ্যান্টিবায়োটিককে অন্য ধরনের ওষুধ কাজ না করার ফলে ব্যাকটেরিয়া দমনে শেষ হাতিয়ার হিসেবেই ব্যবহার করা উচিত।
সবথেকে বড় ঝুঁকির ব্যাপার হলো, ব্রয়লার মুরগী কিংবা অনেক পশুর ফার্মেই গবাদিপশুকে অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ানো হচ্ছে। মাংসকে সহজলভ্য করার জন্য মানুষেরা গবাদিপশুকে খাওয়াচ্ছে অ্যান্টিবায়োটিক। পশুপাখিদের অপরিষ্কার স্থানে থাকার কারণে সহজেই রোগ জীবাণু তাদের শরীরে ঢুকে যায়। তাই, গবাদি পশুকে অ্যান্টিবায়োটিক দেয়া হয় যাতে সেটা বেশি বেশি ব্যাকটেরিয়াকে মারতে পারে, এতে পশুগুলো সুস্থ থাকে। আমরা সেই পশুর মাংস খাচ্ছি, এতে প্রচুর পরিমাণের রেসিস্টেন্ট ব্যাকটেরিয়া আমাদের শরীরের মাঝেও প্রবেশ করতে পারছে।
আমাদের শরীরের বেড়ে যাওয়া রেসিস্টেন্ট ব্যাকটেরিয়া গুলোর জন্য আমরা বিভিন্ন অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগ করছি। কিন্তু, দিন দিন ব্যাকটেরিয়া শক্তিশালী হয়েই চলেছে। কিছু কিছু এমন শক্তিশালী অ্যান্টিবায়োটিক আছে, যা এই সুপারবাগগুলোকে মেরে ফেলে, তবে তাদেরকে খুব সাবধানতার সাথে ব্যাবহার করা হয়।
২০১৫ সালে চিনা গণমাধ্যম প্রকাশ করে যে, Colistin নামক সবথেকে শক্তিশালী একটি অ্যান্টিবায়োটিকের রেসিস্টেন্ট ব্যাকটেরিয়া তারা খুঁজে পেয়েছেন। এটি খুবই বিরল একটি ওষুধ, যেটাকে সচরাচর ব্যবহার করা হয় না, কারণ এটা লিভারের ক্ষতি করে থাকে। হাসপাতালে ভর্তি হওয়া কিছু রোগীকে এই ওষুধটা দেয়া হয়। এই শেষ একটা সম্বলকেও ব্যাকটেরিয়া কাবু করে ফেলতে সক্ষম হয়েছে। এভাবে যদি শক্তিশালী অ্যান্টিবায়োটিকগুলোর বিরুদ্ধে ব্যাকটেরিয়ারা জিতে যায়, তাহলে লক্ষ লক্ষ মানুষ শুধু ব্যাকটেরিয়ার কারণে সাধারণ জ্বর ঠান্ডায় কিংবা ব্লাডার ইনফেকশনে আক্রান্ত হয়ে মারা যাবে। কোন ওষুধই আর বাকি থাকবে না পৃথিবীতে কাজ করার।
আমাদেরকে একটা কথা অবশ্যই মনে রাখতে হবে, আমাদের মানব শরীরে কোন কিছুর রেসিস্টেন্ট তৈরি হয় না, রেসিস্টেন্ট তৈরি হয় শুধুমাত্র ব্যাকটেরিয়াতে।
যেই যেই ফ্যাক্টরগুলো অ্যান্টিবায়োটিক রেসিস্টেন্টকে দিনের পর দিন বাড়িয়ে দিচ্ছে:
১. অ্যান্টিবায়োটিক যদি ব্যাকটেরিয়াল ইনফেকশনে ব্যবহার না করে ভুলবশত ভাইরাল কিংবা ফাংগাল ইনফেকশনে ব্যবহার করা হয়। কিংবা দুর্বল কোন ব্যাকটেরিয়াল ইনফেকশন যেটা শরীর নিজ থেকেই সারিয়ে নিতে সক্ষম।
২. ভাইরাল জ্বর ঠান্ডার কারণে ফার্মেসি থেকে ধুম করে অ্যান্টিবায়োটিক এনে খাওয়া এবং রোগীর কোর্স শেষ না করা। ভাইরাল জ্বরে অ্যান্টিবায়োটিক কাজ করবে না, এটা শুধুমাত্র ব্যাকটেরিয়াকেই মারতে পারে।
৩. গবাদিপশুকে ইচ্ছেমতো অ্যান্টিবায়োটিক খাইয়ে ফেলা, যেটা পরবর্তীতে মানবদেহে অ্যান্টিবায়োটিক রেসিস্টেন্ট ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণ ঘটাতে পারে।
যতোটা দ্রুততার সাথে ব্যাকটেরিয়া বুদ্ধিমান হয়ে রেসিস্টেন্ট হচ্ছে অ্যান্টিবায়োটিকের প্রতি, ততোটা দ্রুত কিন্তু নতুন নতুন অ্যান্টিবায়োটিক তৈরি হচ্ছে না! তাই আমাদের সচেতনতা এবং এ বিষয়ে শিক্ষাই পারে অ্যান্টিবায়োটিকের সঠিক এবং পরিমিত ব্যাবহারকে নিশ্চিত করতে এবং সুস্থ জাতি হিসেবে বাংলাদেশকে পৃথিবীর বুকে স্থান দিতে।
-
২২ নভেম্বর, ২০২৩
-
২৬ ফেব্রুয়ারী, ২০২৩
-
৩০ অগাস্ট, ২০২০