(স্মৃতির পাতা থেকে)
আমার রোগী সেবা

আমি প্রথমে মানুষ হলাম। এম বি বি এস পাস করে হলাম ডাক্তার। এম ফিল প্যাথলজি পাস করে হয়ে গেলাম প্যাথলজিস্ট। তাই, আমি এখন একই সাথে একজন মানুষ, ডাক্তার ও প্যাথলজিস্ট। এই পেসায় এসে মানুষ হিসাবে মানব সেবা করতে গিয়ে অনেক বিচিত্র অভিজ্ঞতা হয়েছে। মাঝে মাঝে সেসব অভিজ্ঞতার কথা স্মরন করে মজা পাই। প্যাথলজিস্ট হবার আগে মেডিকেল অফিসার থাকাকালীন অনেক রোগী দেখতাম উপজেলার চেম্বারে। অফিস টাইমেও উপস্থিত থাকতাম সঠিক সময় পর্যন্ত। সবার আগে উপস্থিত হতাম অফিস চেম্বারে। বন্ধু কলিগদের কেউ কেউ সকাল নয়টা দশটা পর্যন্ত ঘুমিয়ে উঠে বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁত ব্রাশ করে নাস্তা করে রিলাক্স মুডে আসতো অফিসে। অফিসে এসে কিছুক্ষণ রাজনীতির পেঁচাল পেড়ে কিছু রোগী দেখে লাঞ্চে চলে যেতো। তারা যখন ঘুম থেকে উঠতো তখন হয়তো আমার অর্ধেক রোগী দেখা হয়ে গেছে। তারা আমাকে বুঝাতে যাইতো "এতো কাজ করে লাভ নেই। তুমি যতো কাজ করবে চাইবে তোমাকে দিয়ে ততোই কাজ করাবে। তুমি একটা গাধার মতো। গাধায় দেখো না কেমন সারাজীবন বোঝা বেয়েই চলে। কাজেই রিলাক্স করো। কিচ্ছু হবে না এসব করে। এদেশে টিকে থাকতে হলে ধান্দাবাজি করে চলতে হবে।"
কথায় কান না দিয়ে গাধার মতো কাজ করে যেতাম। আমার মেয়েটাকে ওরা বেশ আদর করতো। একদিন আমার শিশু মেয়েটি বললো: আব্বু, অমুক চাচ্চু সকাল ১০ টার সময় উঠে বারান্দায় দাঁত ব্রাশ করতে করতে বলেন 'আমরা যদি না জাগি মা কেমনে সকাল হবে?
ছুটিতে গ্রামের বাড়ী গেলেও অনেক রুগী দেখতাম। তখন এলাকায় তেমন ডাক্তার ছিল না। ছিল না তেমন পরীক্ষা নিরীক্ষার ব্যবস্থা। বাড়ী গেলে সকাল বেলায় রোগী এসে ভিড় করতো। দেশের মানুষ। রোগের আলাপ করতে করতে তাদের সংসারের আলাপও করতাম। টাকা পয়সা নিতাম না। অনেকে আসতো রোগের কথা বলার জন্য। এখন তাদের কোন রোগ নাই। তিন মাস আগে আগন মাসে রোগ হয়েছিল, সেই কথা আমার কাছে বলার জন্য এসেছে তিন চার কিলোমিটার দূর থেকে। কিছু না পেয়ে দুচারটে ভিটামিন ট্যাবলেট লিখে বিদায় করে দিতাম।
প্রায় বিশ বছর আগের কথা। একবার গ্রামে এক বিয়ে খেতে গিয়েছিলাম। রাতে বউ আনা হয়েছে। সকালে বউকে উঠানে বের করা হয়েছে। সবাই এসেছে বউ দেখতে। আমিও গেলাম। একজন বউকে নির্দেশ দিলেন পা ছুয়ে সেলাম করতে। আমি বললাম যে দাঁড়িয়ে সবাইকে সালাম দিতে। সবাইকে পা ছুঁয়ে সালাম করলে বউয়ের কষ্ট হবে। মুরুব্বি বললেন: আমরা বউকালে পা ছুঁয়ে সেলাম করেছি না? আমাদের কষ্ট হয় নাই? আমি বললাম: আপনারা কষ্ট করেছেন বলে আমাদের বউদেরও কষ্ট করতে হবে?
সবাই ভিড় করে বউ দেখছিল। বউ চেয়ারে নিচের দিকে দৃষ্টি দিয়ে বসেছিল। এতগুলি মানুষ এক যোগে বউয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। বউয়ের জন্য এক অসস্তিকর অবস্থা। হঠাৎ একটা বেখাপ্পা ঘটনা ঘটে গেলো। আমি যে দিকে বসেছি তার উলটা দিকে বউয়ের পিছনে ভিড়ের মধ্যে দাঁড়ানো পাড়ার এক চাচী সম্পর্কের মহিলা আমার দিকে চেয়ে চোখ ইশারা দিলেন এবং হাত দিয়ে ইশারা দিলেন বেরিয়ে আসতে। আমি ব্যাপারটার কিছুই বুঝতে পারলাম না। আমি দৃষ্টি অন্য দিকে সরালাম। মহিলার দিকে আবার তাকালে তিনি আবার ঐ রকম করলেন। আবার দৃষ্টি অন্য দিকে দিলাম। আবার তাকালে তিনি আগের মতোই করলেন। আমি এর রহস্য কিছু বুঝলাম না। চাচী সম্পর্কের মুরুব্বী মানুষ এমন অসস্তিকর কারবার করছেন কেন? কেউ দেখে ফেললেই বা কেমন হবে?
বউ দেখা শেষ করে বাড়ী চলে এলাম। দেখি অনেক রোগী অপেক্ষা করছে। রোগী দেখতে বসে গেলাম। সেই মহিলা আমার উলটা দিকে দাঁড়িয়ে রোগীর ভিড়ের পিছন থেকে দুই তিন বার আগের মতো ইশারা দিলো। আমি পুরা রহস্যের জগতে পড়ে গেলাম। একসময় আমার পায়খানার বেগ চাপলো। আমি লেট্রিনে যাবো বলে রোগীদের থেকে বিদায় নিয়ে অন্দরমহলে চলে এলাম। দেখলাম সেই মহিলা আমার পিছু পিছু লেট্রিন পর্যন্ত এলেন। লেট্রিনের কাজ শেষ করে টিউবওয়েল পাড়ে গোসলখানায় প্রবেশ করলাম। আমাদের টিউবওয়েলের সাথে পাকা করা গোসলখানা ছিল। এটার চতুরদিকে টিনের বেড়া। দুইটি টিনের দরজা। একটি ভিতরের দিক থেকে, আরেকটি বাইরের দিক থেকে প্রবেশের জন্য। আমি গোসল খানায় ঢুকে একটি দরজার সিটকিনি লাগিয়েছিলাম। আরেকটি ভুলে লাগাই নি। গোসল শেষ করলাম। গামছা দিয়ে গা মুছলাম। গামছা পরে ভিজা লুঙ্গী খুলে বালতিতে রাখলাম। ঝট করে ঢুকে পড়লেন সেই মহিলা। চমকে গেলাম। এ কোন মহা ঝামেলায় পড়লাম রে! মহিলা পাগল হয়েছে না কি? আমি বললাম: একি করছেন? গোসল খানায় ঢুকছেন কেনো? মানুষ কি বলবে? বেরিয়ে যান। মহিলা হাকিহুকি করে বললেন: শরমের কথা। কবার পারতাছি না সবার সামনে। তাই, এই খানে আইছি।
- কি শরমের কথা?
- ধাতু।
- ধাতু?
- হ, ধাতু। খালি ধাতু যাইতাছে।
- ধাতু কি রকম?
- ধাতু বুঝেন না? ধাতু।
- না, আমি ধাতু বুঝি না। ভাইংগা কন কি অইছে।
- এলা! ধাতু বুঝে না। ডাকতর মানুষ ধাতু বুঝে না।
- হ, ধাতু বুঝি না। কি সমস্যা তাই কইন।
- ঝাউড়াডায় কয় কি? ধাতু বুঝে না।
- হ, বুঝি না। কিবা নাগে তাই কইন।
- ধাতু।
- আবার কয় ধাতু! কিবা নাগে তাই কইন।
- শরম। শরম।
- আবার কয় শরম!
- যেনদিয়া পেসাব করি হেনদিয়া খালি সাদা বিজল বাইর অয়। শর্মে কইতে পারি না।
- খাইজায়?
- খাইজায়, জ্বলে।
- কয়দিন ধইরা?
- দুই তিন দিন ধইরা।
- ঠিক আছে। সামনে গিয়া বহুন গা। কাপড় পইরা আইয়া আপনের ঔষধ লিখা দিতাছি। (আমি গামছা পরা অবস্থায়ই রোগীর হিস্ট্রি নিয়ে ফেললাম। জামাকাপড় পরে এসে রোগীর প্রেস্ক্রিপশন করলাম)
প্যাথলজিস্ট হবার পর প্রফেশনালি রোগী দেখার চেম্বার করা হয় না। তবে বাড়ী গিয়ে আগের মতোই রোগী দেখি। কিন্তু সখিপুরে এখন প্রচুর চিকিৎসা সুবিধা থাকার কারনে বাড়ীতে তেমন রোগী আসে না। অনেকেই জেনে গেছে আমি এখন পরীক্ষা নিরিক্ষার ডাক্তার। প্রেস্ক্রিপশন খুব কম করি। তবে এখন দেশের রুগীদেরকে অন্যভাবে সেবা দেই। জন্মস্থান আমার সখিপুর, দাদা, নানা, বুবু, বোনদের বাড়ী কালিহাতি। শশুরবাড়ী ঘাটাইল, মুধুপুরে আমার টেকনিশিয়ানদের বাড়ী, নকলায় আড়াই বছর মেডিকেল অফিসারের চাকরী করেছি, প্রাক্টিস করেছি, ভালুকার বাটাজোর বি এম হাই স্কুলে পড়েছি। এই সব অঞ্চল ময়মনসিংহ শহর থেকে এক দেড় শ কিলোমিটার দুরত্বের মধ্যেই হওয়াতে অনেক পরিচিত বন্ধু বান্ধব নিজে রোগী হয়ে অথবা রোগী নিয়ে আমার ময়মনসিংহের তালুকদার প্যাথলজির চেম্বারে আসেন। তাদের দেখতে পেয়ে, তাদের সাথে কথা বলতে পেরে আমার ভালো লাগে। সেল্ফি উঠাই। ফেইসবুকে পুরাতন বন্ধুদেরকে দেখাই। আমারও ভালো লাগে তাদেরও ভালো লাগে। আমি তাদের মাধ্যমে এলাকার আরও আপনজন ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের খবর নেই। ফোন নাম্বার লিখে নেই। বাল্যবুন্ধু কেউ কেউ সম্মান করে আপনি বললে বলি: তোমার পেটে একটা গুতা মারমু।
- কেন?
- তুমি কবে আমায় আপনি বলছো যে এখানে এসে আপনে আপনে বলছো?
- আচ্ছা, ঠিক আছে দোস্তো, তোমার ছেলে-মেয়ে কয়জন? কি করছে?
- আমার দুই মেয়ে। বড় মেয়ে কম্পিউটার সাইন্সে বি এস সি করে এম বি এ পাস করেছে। কোম্পানিতে চাকরি করতো। নাতী হবার পর ছুটিতে আছে। বড় মেয়েজামাই কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং -এ অস্ট্রেলিয়া থেকে পি এইচ ডি পাস করে ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক। ছোট মেয়ে এম বি বি এস পাস করেছে দিনাজপুর মেডিকেল কলেজ থেকে। বিসিএস লিখিত পরীক্ষায় পাস করে ভাইবা দিয়েছে। রেজাল্ট হয় নাই। সে ডায়াবেটিস রোগ চিকিৎসার উপর একটা সার্টিফিকেট কোর্সও করেছে। তা তোমার কি খবর?
এইভাবে চলে আমার আলাপ। কয়েকবছর আগে এক মহিলা রোগী এলেন। আমার চেম্বারের সুবিধা হলো ল্যাবের সাথেই একটা রুম রেখেছি দেশ থেকে আসা রোগী ও লোকজনের বিশ্রামের জন্য। খাওয়া দাওয়া ও গড়াগড়ি করে বিশ্রাম নেয়ার ব্যবস্থা আছে এই রুমে। সকাল থেকেই রোগীরা সিএনজি-রিক্সা ও মাইক্রোবাস নিয়ে আসতে থাকে। এখানে বিশ্রাম নেয়। আমার জন্য অপেক্ষা করে। আমি এসে কাজ শুরু করে দেই মাইক্রোস্কোপ নিয়ে। মাইক্রোস্কোপ দেখার ফাঁকে ফাঁকে রোগীর কষ্টের কথা শুনে উপযুক্ত বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের কাছে চিঠি লিখে পাঠিয়ে দেই। গত প্রায় ২৭ বছর ধরে আমি মেডিকেল কলেজে শিক্ষকতা করছি। ইতিমধ্যে আমার ছাত্ররা প্রায় ৪ হাজার ডাক্তার হয়েছে। এরমধ্যে অনেকেই পোস্টগ্রাজুয়েট করে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার হয়েছে। যারা ক্লাসে ভালো ছিল তাদের আমি চিনে রেখেছি। তারা যদি ভালো পদোন্নতি নাও পেয়ে থাকে তাদের আমি ভালোই মনে করি। তাদের কাছে আমি রোগী পাঠাই। পরীক্ষা লাগলে আমিই করে দেই। তাতে রোগী দের খরচ কম হয়। সন্ধার সময় প্রেস্ক্রিপশন নিয়ে একে একে চলে যায় যার যার গ্রামে। এক রোগী চলে গিয়ে আরেক রোগী পাঠায়। যাহোক মহিলা রোগীটি আমার সামনে বসলেন। আমি মাইক্রোস্কোপে চোখ রেখেই জিজ্ঞেস করলাম: বলুন, কি সমস্যা? (কোন জবাব পেলাম না)
- বলুন আপনার কেমন লাগে? (কোন জবাব পেলাম না)
- আপনার শরীরে কেমন কেমন লাগে বলুন। (কোন উত্তর পেলাম না)
- কথা বলুন। কথা না বললে বুঝব কিভাবে যে আপনার কি হয়েছে। (তারপরও জবাব না পেয়ে চোখ তুলে রোগীর মুখের দিকে তাকালাম। রোগী মিটিমিটি হাসছিল। চেনাচেনা লাগছিল)
- কথা বলছেন না কেনো?
- দেখছি, কেমন করে রোগী দেখো?
- ও, সরি, আমি মাইক্রোস্কোপে পরীক্ষা করছি তো, তাই, না চেয়েই প্রশ্ন করছি।
- মাইক্রোস্কোপে কি দেখো?
- ক্যান্সার কোষ দেখছিলাম। একটা ক্যান্সারের সেম্পল পরীক্ষা করছি। চেনা চেনা মনে হচ্ছে?
- চিনতে পারো নাই? আমি তো ঠিকই চিনতে পারছি।
- কিছু কিছু চেনা মনে হচ্ছে।
- আমি অমুক। তোমার সাথে ক্লাস ফাইফ পর্যন্ত পড়েছিলাম। তারপর বিয়ে হয়ে যায় এই মাস্টারের সাথে। আর পড়া হয় নাই।
- এখন চিনেছি। তা তোমার অবস্থা এমন হলো কেমনে? (তার মুখটা মলিন হয়ে গেলো)
মাস্টার সাব বললেন: ও এমন ছিল না। আমাদের ক্লাস নাইনে পড়ুয়া এক ছেলে ছিলো। সাপে কাটার জন্য মারা গেছে। সেই শোকে তার এই অবস্থা। ওকে একটু চেক আপ করাতে নিয়ে এসেছি। আপনার কথা বলাতে ও বলছিলো “এক সাথে প্রাইমারীতে পড়েছি অবশ্যই চিনবে আমাকে”। আপনি না তাকিয়ে তাকে প্রশ্ন করছিলেন, তাই সে উত্তর দেয় নি।
- বুঝতে পেরেছি। সরি। সাপে কাটা আমাদের পাহাড় অঞ্চলের জন্য একটা বড় সমস্যা। কয়েকদিন পরপরই একটা দুইটা রোগী আসছে সাপে কাটা নিয়ে। বেশ কিছু লোক মারাও গেছে এলাকায়।
আরেকদিন এক মহিলা রোগী এলেন বৃদ্ধ বয়সের। আমি খুব ব্যস্ত ছিলাম কাজ নিয়ে। বললাম: আপনার কি কি সমস্যা আছে তাড়াতাড়ি বলুন। অনেক কাজ।
- সমস্যা তো ভরা। কয়ডা কমু।
- একটা একটা কইরা কইন।
- পোলা বিদেশ তিগা টাকা পাঠায়। আমার আতে দেয় না। কিবায় কুনু খরচা করে কিছুই কয় না।
- আমি অই সমস্যার কথা জিগাই নাই। কষ্টের কথা কইন।
- কষ্টের কথাই কবার চাইতাছি তা তো হোন্তে চাইন না।
- আপনের কিব নাগে হেইডা কইন।
- আমার যে কিবা নাগে তা কপ্পামু না।
- কবার না পাইলে রোগও ধরা যাইবো না। কইন তাত্তারি।
- অবা করুন ক্যা? আপনে তো অবা করবাইনই। আপনেতো আমারে চিনবাইন না। আপনের বাপে বাইচা থাকলে আইজ চিঠি নেইখা দিতো। চিনতাইন। আহ হা রে! আপনের বাপে কতো ভালা মানুষ আছিলো। আমাগো বাইত্তে কতো যাইতো! আইজকা বাইচা নাই, আর আমগো কেউ চিনে না। গাড়ীতে আবার সুম এই কথাই কইতাছিলাম গেদার বাপের কাছে। কইছি দলুর পোলায় যদি চিনে তাইলে আমাগো কাছ তিগা এক টাকাও নিবো না। না যদি চিনে তাইলে টাকা পয়সা নিবো। যদি না চিনে তাইলে কয়ডা কথা হুনাইয়া দিমু।
- ঠিক আছে চিনছি, চিনছি। টাকা পয়সা নাগবো না। রোগের কথা কইন।
এইভাবে আমার গ্রামের রোগী ম্যানেজ করতে হয়। কত রকম কাইন্ডই যে করে কত জনে! আমার এক আত্বীয় বড় ভাই (ছদ্মনাম দিলাম হিরুভাই) একদিন তার মেয়ের শাশুড়িকে নিয়ে এলেন রোগী হিসাবে। তার মানে তাদের সম্পর্ক বিয়াই-বিয়ানির। সাথে অন্য কেউ আসে নি। বিয়ানির মাথা খারাপ হয়েছে। অর্থাৎ পাগল রোগী। বললাম: ভাই, আপনি পাগল রোগী নিয়ে এলেন সাথে করে। তাও আবার বিয়ানি সম্পর্ক। আর কেউ ছিল না?
- কি করব? বিয়াই বেচে নেই। মেয়ে-জামাই বিদেশে চাকরী করে। মেয়ে-বিয়ানী এক ঘরে থাকে। বাড়ীতে আর কেউ নেউ। বিয়ানী পাগল হয়েছে। কবে না আমার মেয়েটাকে মাথায় বারী দিয়ে মেরে ফেলে। তাই, আমিই নিয়ে এলাম।
ডাক্তার দেখায়ে শেষ করতে রাত দশটা বেজে গেলো। এখন পাগল রোগী রাখি কোথায়? বুঝিয়ে হোটেলে পাঠিয়ে দিলাম ভাতিজার সাথে। তারা যেতে চাইলেন না। বললেন যে হোটেলে তো কোনদিন থাকি নাই। ভয় করে। ভাতিজা হোটেলে রেখে বুঝিয়ে দিয়ে এলো যে রাতে কেউ দরজা ধাক্কালে খুলবেন না। খারাপ মানুষ আছে ময়মনসিংহে। পরেরদিন শুক্রবার ছুটির দিন ছিল। বেশী করে কেনাকাটা করার জন্য বাজারে গিয়েছিলাম। সকাল ১১ টার দিকে পকেটে রাখা মোবাইলটি বেজে উঠলো।
- হ্যালো।
- স্যার, আমি হোটেলের ম্যানেজার বলছি। আপনার গত রাতে যে দুইজন গেস্ট আমাদের হোটেলে উঠেছিলেন তারা এখনো দরজা খুলছে না। কোন সাড়াশব্দ করছে না। তাড়াতাড়ি আসুন।
- আমি বাজার করছি। আসছি।
আমি সংক্ষেপে বাজার শেষ করে হোটেলে ছুটে গেলাম। নিশ্চই পাগলে খুনুখুনি করে ফেলেছে। বিস্তারিত শুনলাম। রাতে গেস্টের নাম ঠিকানা রেজিস্টারে উঠাতে গেলে তারা দরজা বন্ধ করে দেন। জানালা দিয়ে খাতা পাঠালে খাতা ধাক্কা দিয়ে বের করে দিয়ে জানালা দরজা আটকিয়ে দিয়ে লাইট অফ করে দেন। রেজিস্টারে নাম না থাকলে পুলিশে চেক করলে আমাদের বিপদ হতো। তাদের দুইজনের মধ্যে সম্পর্ক কি তাও আমরা জানি না। স্যার, তাদের মধ্যে সম্পর্ক কি?
- বিয়াই-বিয়ানি।
- বিয়াই-বিয়ানি কি এক রুমে থাকতে পারেন, স্যার?
- কি করবে? বিয়ানিটা পাগল। চিকিৎসা করার তার কেউ নেই এই বিয়াই ছাড়া। বেচে আছে তো?
- আছে হয়তো। ভেন্টিলেটর দিয়ে লাইট ফেললে খাটের নিচে পালায়।
- দুইজনই পাগল হলো না কি।
- ওনার নাম কি, স্যার?
- হিরু।
- এই হিরু ভাই, এই হিরু ভাই, স্যার এসেছেন, দরজা খুলুন।
- এই হিরু ভাই। দরজা খুলুন। ভয় নাই। আমি এসেছি।
আমাদের ডাক শুনে আশে পাশের মানুষ ভিড় করতে লাগলো। নানা রকম মন্তব্য ছুড়তে লাগলো।
- কি? আত্বহত্যা করেছে?
- প্রেমিক প্রেমিকা?
- পুলিশকে খবর দেয়া উচিৎ ছিল।
- দরজা ভাঙ্গেন।
- এই সব হোটেলে এইগুলিই হয়।
- ভাঙ্গ দরজা।
আমি বিব্রতবোধ করলাম। সবাইকে বুঝাতে চেষ্টা করলাম। ম্যানেজার টেবিলের উপর দাঁড়িয়ে ভেন্টিলেটর দিয়ে টর্চের লাইট ফেলে বললেন: স্যার, বেচে আছেন। লাইট দেখে খাটের নিচে পালালেন হিরু ভাই। আমিও টেবিলে দাঁড়িয়ে ভেন্টিলেটর দিয়ে লাইট ফেলে দেখতে চেষ্টা করলাম। কাউকে দেখতে পেলাম না। এদিকে জুম্মার নামাজের টাইম হয়ে যাচ্ছে। টেনশন বাড়তেই লাগলো। মাথায় একটা আইডিয়া এলো। লাইট রুমে না ফেলে আমার মুখের উপর ফেলে বললাম: হিরু ভাই, এই দিকে দেখুন আমি সাদেক। এই যে আমার মুখ দেখুন। ভয় নাই। আমি আছি।
- সাদেক আইছো?
- হে, হে, এই যে দেখুন, আমার মুখ।
হিরু ভাই খাটের নিচ থেকে বের হয়ে দাড়ালেন। আমি দরজার ছিটকিনির উপর লাইট ফেললাম। দরজা খুলে হিরু ভাই ও তার বিয়ানিকে বের করে আনলাম। হিরু ভাই বললেন: সকাল হয়ে গেছে?
- সকাল না, এখন দুপর।
- রুমের ভিতর ঘুটঘুটে অন্ধকার। আমি মনে করেছি সকাল হয় নাই। মান্নান বলে গিয়েছিল যে রাতে দরজা খুইলেন না। কোন সময় সকাল হয়েছে তা টেরও পাইনি।
আমার রাগে দুঃখে শরীর জ্বলে যাচ্ছিল। বলে ফেললাম: পাগল রোগী নিয়ে এখনি চলে যান। আর যেন কোনদিন না দেখি যে রোগী নিয়ে এসেছেন। (হিরু ভাই তার বিয়ানিকে নিয়ে দ্রুত চলে গেলেন। আমিও দ্রুত সরে পড়লাম)
এই ব্যাপারটি নিয়ে আমি অনেকবার ভেবেছিলাম যে হিরু ভাই এমন করলেন কেনো? আমি মনে কষ্টও পেতাম এই ভেবে যে আমি হিরু ভাইর সাথে খারাপ ব্যবহার করে বিদায় দিলাম। অনেকদিন পর হিরু ভাইর সাথে দেখা হলে বিস্তারিত জানলাম। জেনে দুই জনে মিলে হাসাহাসি করলাম। আলাপ করে যা জানতে পাড়লাম তা হলো রুমে উঠে তারা দরজার শিটকিনি বন্ধ করে দেন। রিলাক্স হয়ে শুইবার পর ম্যানেজার খাতা নিয়ে আসেন নাম লিখবার জন্য। দরজায় করা নাড়লে ভাতিজার সতর্কবাণীর কথা মনে পড়ে। তাই দরজা খোলা হয় না। নিরুপায় হয়ে যখন জানালা দিয়ে খাতা দিয়ে সই করতে বলেন তখন তারা ভয় পেয়ে যান। গ্রামের মানুষ সই করাকে অনেক ভয় করে। খাতা ধাক্কা দিয়ে বের করে দিয়ে জানালা লাগিয়ে লাইট অফ করে দেয়া হয়। রুম ঘুট ঘুটে অন্ধকার হয়ে যায়। অন্ধকারে তারা দরজা জানালার ছিটকিনি আর খুঁজে পান না। সকাল হয়ে দিন হলেও রুম অন্ধকারই থেকে যায়। কাজেই বিয়াই বিয়ানিদের রাত আর পোহায় না। তারজন্য এই নাটক। হা হা হা।
সেই ম্যানেজার একদিন একটি মেয়ে নিয়ে আমার চেম্বারে এলেন।
- মেয়েটি কে?
- রোগী। আমার ভায়রার মেয়ে। ভায়েরা অমুক ক্লিনিকের ম্যানেজার ছিল। যে বেতন পেতো তা দিয়ে তার চার সন্তান ও স্ত্রী নিয়ে বাড়ী ভাড়া নিয়ে সংসার চলছিল না। অনেক ঋণ করে ফেলছিল। তাই, সবাইকে রেখে পালিয়ে গিয়েছে। আমি আমার চার বাচ্চা নিয়েই সংসার চালাতে পারি না। তার উপর আবার ভায়েরার ফ্যামিলির খরচও আমাকে দিতে হচ্ছে। কি যে বিপদে আছি, স্যার। আরে তুই পালাবি কেন? তুই চাকরি বাদ দিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে দুই চারটা রোগী ধরতে পারলেই তো তর সংসার চলে।
- রোগী ধরবে মানে?
- মানে, দালালি করা। দালালি করে দুইএকজন এখন ক্লিনিকের মালিক হয়ে গেছে। কাচা বাজারের দোকান বাদ দিয়ে এখন অনেকেই রুগীর দালালি করছে। এই পেশা এখন লাভজনক পেশা।
- খারাপ কাজ সব সময়ই খারাপ। দালালি একটা খারাপ কাজ। এটাকে সাপোর্ট করবেন না।
- স্যার, আপনার সেই রোগীর খবর কি? তারা কি আরো এসেছিলেন?
- না, আর আসেন নি। কি লজ্জায়ই যে পড়েছিলাম সেদিন!
- স্যার, আরেকটা কথা তো জানেনই না। তারা প্রশ্রাব করে খাটের নিচ ভাসিয়ে ফেলেছিলো। বড় মানুষের প্রস্রাব। শুকানোর পর খাটের নিচ থেকে দুর্ঘন্ধ আসছিল। ব্লিচিং পাউডার দিয়ে ধুইতে হয়েছে।
আমি সব খুলে বললাম। বুঝালাম তারা অতক্ষণ প্রশ্রাব আটকিয়ে রাখতে পারেনি। তাদের রাত্রি শেষ হচ্ছিল না। তারা আর আসবে না আপনার হোটেলে।
স্বাস্থ্য খাতের সংস্কার প্রতিবেদনে সুপারিশ
রোগী থেকে সরাসরি টাকা গ্রহণ নয়, চিকিৎসক হবেন বেতনভুক্ত কর্মচারী

পিতাকে নিয়ে ছেলে সাদি আব্দুল্লাহ’র আবেগঘন লেখা
তুমি সবার প্রফেসর আবদুল্লাহ স্যার, আমার চির লোভহীন, চির সাধারণ বাবা

কিডনি পাথরের ঝুঁকি বাড়ায় নিয়মিত অ্যান্টাসিড সেবন
বেশিদিন ওমিপ্রাজল খেলে হাড় ক্ষয়ের ঝুঁকি বাড়ে
