
ডা. শামসুল আলম
অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী চিকিৎসক,
সাবেক শিক্ষার্থী, ওসমানী মেডিকেল কলেজ, সিলেট।
১৬ জুলাই, ২০১৮ ১২:২০ পিএম
ডাক্তারই একমাত্র ফ্রি!

প্রিয় হাসিব,
অনেক দিন পর কাউকে চিঠি লিখছি। শুনেছি তোমার মন খারাপ, মাত্র ডাক্তারি পাশ করে বের হয়েছো। অনেক কষ্ট করে রাত-দিন পড়াশুনা করে অবশেষে ডাক্তার কিন্তু তোমার সন্মান, তোমার মেধা ও শ্রম আজ প্রশ্নের মুখে। তোমার মত আমার পরিস্থিতি হলে আমারও খুব মন খারাপ হতো। কিন্তু কী উপায় বলো? কে তোমাকে পথ দেখাবে?
এই চিঠি তোমার মন ভালো করার জন্য লেখা।
এক সময় খুব চিঠি লিখতাম, আমরা যে সময়ে ডাক্তারি পড়েছি সে সময়ে আমাদের কোন ফেসবুক ছিল না, সবার হাতে মোবাইল এসেছিল আরো অনেক পরে। মেডিকেল কলেজের সেই হোস্টেলের দিনগুলিতে কোনো কোনো বৃষ্টির দিনে গল্পের বই আর প্রিয়জনদের চিঠি লেখা ছিল অনেক আনন্দের আর ভালোবাসার। সেসব চিঠিতে থাকতো আমাদের সুখ-দুঃখ ও হাসি আনন্দের সব স্মৃতি। মাকে আমি প্রায়ই লিখতাম। ছোট বোনটি বলতো, মা চিঠি পেলে খুব খুশি হতেন। বার বার পড়তেন, বালিশের নীচে যত্ন করে রেখে দিতেন সেই চিঠি।
একদিন হয়তো লিখলাম, জানো মা, আজ সন্ধ্যায় হসপিটালে ইমার্জেন্সি অপারেশন দেখতে গিয়েছিলাম, গিয়ে দেখলাম একটা শুকনো রুগ্ন দেহের রিকশাওয়ালা পেটের ব্যথায় চিৎকার করে কাঁদছিল। মা গো, সে কি কষ্ট তুমি যদি দেখতে। একটা চার বছর বয়সী মেয়ে বাবার হাতটা ধরে বসে ছিল, তার চোখেও পানি।
আমাদের ইন্টার্নি ভাইয়াটা বললেন, লোকটা সারাদিন রিকশা চালানোর পর যখন শরীর খুব ব্যথা হয়ে যেত তখন ফার্মেসি থেকে উল্টো-পাল্টা ব্যথার ওষুধ কিনে খেত। এমনই একটা ব্যথার ওষুধ তার পাকস্থলী ফুটো করে দিয়েছে। এখন অপারেশন করে সেই ফুটো বন্ধ করতে হবে কিন্তু তার কাছে কোনো টাকা পয়সা নেই।
অপারেশনের জন্য যেসব ওষুধপত্র ও সুতার প্রয়োজন সেসব কেনার কোনো সামর্থ্য নেই। তুমি জানো মা, মানুষ মনে করে সরকারি হাসপাতালে সব ফ্রি আসলে কিন্তু তা নয়। এখানে ডাক্তারই একমাত্র ফ্রি, বাকি আরো অনেক কিছু তাদের কিনতে হয়। তবে তুমি জেনে খুশি হবে মা, লোকটার কিন্তু শেষ পর্যন্ত অপেরেশন হয়ে ছিল। এখানে ওয়ার্ডে ডাক্তারদের একটা পুওর ফান্ড থাকে, অন্য রোগীদের অব্যবহৃত ও ফেলে যাওয়া ওষুধপত্র তারা জমিয়ে রাখে তাই দিয়ে তারা এসব গরিব ও অসহায় রোগীদের জরুরি অপারেশন করেন।
একটা ইন্টার্নি আপুকে আবার দেখলাম অন্য অপারেশন টেবিলের একটু ধনী একটা রোগীর একটা বাড়তি স্যালাইন চুপিসারে চুরি করে রিকশাওয়ালা রোগীটাকে দিয়ে দিল। আমি দেখে ফেলায় আমার দিকে তাকিয়ে একটু মুচকি হাসি দিয়ে ঠোটের ওপর আঙ্গুল দিয়ে ইশ...শ... করে চুপ থাকতে বললেন। এই দৃশ্য তুমি যদি দেখতে মা, চুরি অথচ পৃথিবীর সুন্দরতম দৃশ্য। সৃষ্টিকর্তাও হয়তো দেখে হেসেছেন।
এই ছিল কোন একদিন মাকে লেখা চিঠি, আজ লিখছি তোমাকে। মাকে আমিও স্বপ্ন দেখিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছিলাম। আমরা আসলে স্বপ্ন নিয়েই বেঁচে থাকি হাসিব। মানুষ আর এখন আগের মত নেই তারা সবকিছু এখনই চায়, আজই সবকিছু ঠিক হয়ে যেতে হবে, কাল যেন আর ফিরে আসবে না। মানুষ এখন অসহিষ্ণ হয়ে গেছে এবং এটা শুধু বাংলাদেশে নয়, সারা পৃথিবীতেই একই অবস্থা। আজকের এই আলোচনা, প্রতিবাদ হয়তো একদিন পরিবর্তন নিয়ে আসবে তোমার কাজ সেই দিনের প্রতীক্ষায় থাকা। হতাশ হয়ে তুমি যদি ভেঙে পড়ো তাহলে পরিবর্তন হয়তো আসবে কিন্তু সেই পরিবর্তনের সুফল তুমি পাবে না।
তুমি কী জানো, ইংলেন্ডের একদল সমাজ বিজ্ঞানী পৃথিবীতে মানুষের কাজের ভূমিকার ওপর গবেষণা করে বলেছেন, এই পৃথিবীর হিরো হলো আসলে তৃতীয় বিশ্বের ডাক্তারগন। তাঁদের ধারণা এত স্বল্প সুবিধা আর কঠিন পরিস্থিতিতে তাঁরা মানুষকে যে সেবা দিয়ে থাকেন তা আর অন্য কারো পক্ষে দেয়া সম্ভব নয়।
সুতরাং নিজেকে বার বার হিরো প্রমান করার খুব একটা প্রয়োজন নেই। আকাশের সূর্যকে কি আমরা রোজ ধন্যবাদ দেই? নাকি সূর্যের ধন্যবাদের প্রয়োজন? তাঁর ধর্ম আলো দিয়ে যাওয়া, সে তাই করে। সেই সূর্যের সৃষ্টিকর্তার প্রতি মানুষ যদি সত্যিকার ভাবে কৃতজ্ঞ থাকতো তাহলে আলোটা আরো সুন্দর হতো এই কথাটুকু সত্যি কিন্তু তাই বলে সূর্যের কোনো অভিমান নেই। একটা সত্যি কথা কী জানো, ‘Life is not how successful you are,life is all about how grateful you are.’
ভাইরে তুমিই সেই হিরো, মানুষ জন্মেও তোমার কাছে আসে আর মৃত্যুও তোমার সামনেই হয়। তুমি শুধু বিশ্বাসটুকু ধরে থেকো। এই অকৃতজ্ঞ সমাজে তুমি যদি একটু আলো হয়ে, ভালোবাসা হয়ে এবং ভালো মানুষ হয়ে বেঁচে থাকো তাহলেই পরিবর্তন চলে আসবে।
ভয় পেয়ো না, জীবন একটা উত্তাল সাগরে তরী। এখানে ঢেউ থাকবে, তুমি যদি শুধু হালটি ধরে রাখো, কিছু কিছু ঢেউ আসলে তোমাকে ডুবিয়ে দিবে না বরং সামনে এগিয়ে নিয়ে যাবে।
সাগরে জোয়ার শেষে কিছু শামুক তীরে আটকা পরে যায়, এর মাঝেই কিছু শামুক শক্তি নিয়ে সাহস নিয়ে খুব ধীরে ধীরে সমুদ্রের দিকে এগিয়ে যায়। তারাই আবার সাগরে ফিরে যেতে পারে আর কিছু শামুক পরবর্তী জোয়ারের অপেক্ষায় থাকে কিন্তু আসলে তারা সেই তীরেই হারিয়ে যায়। ফিরে যাওয়া আর হয়ে উঠে না।
তোমাকে সেই শামুক কিংবা ঝিনুক হতে হবে। তোমার ভিতর এক লুকানো মুক্তো তাঁকে রক্ষা করতে হবে। তুমি নীরবে এগিয়ে যাও, তোমার সামনে বিশাল সমুদ্র।
আমি সেই সাগরে তোমার পথ চেয়ে রইলাম। ভালো থেকো, তোমার মঙ্গল কামনায়।
ইতি-
শাহীন।

পিতাকে নিয়ে ছেলে সাদি আব্দুল্লাহ’র আবেগঘন লেখা
তুমি সবার প্রফেসর আবদুল্লাহ স্যার, আমার চির লোভহীন, চির সাধারণ বাবা

কিডনি পাথরের ঝুঁকি বাড়ায় নিয়মিত অ্যান্টাসিড সেবন
বেশিদিন ওমিপ্রাজল খেলে হাড় ক্ষয়ের ঝুঁকি বাড়ে
